নির্বাচনের রাজনৈতিক কোলাহলে চাপা পড়ে গিয়েছে ম্যানহোলে আটকে থাকা শ্রমিকদের আর্তনাদ। কলকাতার রিজেন্ট পার্ক এলাকার পূর্ব পুটিয়ারিতে নিকাশি ম্যানহোলে নেমে চার শ্রমিকের মর্মন্তুদ মৃত্যু এ দেশের অসংগঠিত ক্ষেত্রের শ্রমিকদের অসহায়তাকেই তুলে ধরে। এ-ও কিন্তু পরিযায়ী শ্রমিকের মৃত্যু। মালদহ থেকে ওই শ্রমিকরা কাজ করতে এসেছিলেন কলকাতায়। তিন জন একই পরিবারের সদস্য, এক জনের স্ত্রী অন্তঃসত্ত্বা। আরও তিন জন অসুস্থ অবস্থায় উদ্ধার হয়েছেন।
যথাযথ সুরক্ষার ব্যবস্থা না থাকার কারণে দিনমজুরের মৃত্যু প্রতি দিনের ঘটনা। সরকার, পুলিশ, প্রশাসন ও ঠিকাদার, কারও কোনও দায় নেই এই শ্রমিকদের প্রতি। প্রশাসন কিছু টাকা দিয়ে দায় থেকে খালাস পেতে চায়। বছরের পর বছর একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি। নেহাত সংবাদমাধ্যম লেখালিখি করে, তাই বিষয়টি নাগরিক সমাজের নজরে আসে।
কলকাতা কর্পোরেশনের আওতায় কলকাতার পরিবেশ উন্নয়ন লগ্নি প্রকল্পে (কেইআইআইপি) এই কাজ চলছিল। যে কাজে এই শ্রমিকদের ম্যানহোলে নামানো হয়েছিল, তা একান্তই দক্ষ শ্রমিকদের কাজ। কুঁদঘাটের এই পাম্পিং স্টেশনের সামনে মাটির নীচে প্রায় ত্রিশ মিটার গভীরে ময়লা জল জমা হওয়ার জলাধার আছে। সেই জলাধারের সঙ্গে পুরনো পাইপের সঙ্গে নতুন পাইপ সংযুক্তিকরণের কাজ করতেই এই কর্মীদের আনা হয়েছিল। ঠিকাদার সংস্থা জানায়নি, কী ধরনের কাজ করতে হবে। দুর্ঘটনার দিন সকালে ওই তিন যুবক মালদহের বাড়িতে ফোন করে জানিয়েছিলেন, মাটি কাটার কাজ করতে এসেছেন। কাজ শেষ হলে ফিরে যাবেন।
যে শ্রমিকরা ওই কাজে দক্ষ নন, তাঁদের কোনও সুরক্ষাব্যবস্থা ছাড়াই ম্যানহোলে নামানো হল। ম্যানহোলের ভিতরে নামলে কী কী বিপদ হতে পারে, তা নিয়ে তাঁদের ধারণাই ছিল না, প্রশিক্ষণ তো দূরের কথা। পেশাগত সুরক্ষা বিধি কাগজে-কলমে আছে, কিন্তু এ দেশে তা মেনে চলার বাধ্যবাধকতা নেই। এ জন্য কোনও শিল্পপতি, কারখানার ম্যানেজার, ঠিকাদারের শাস্তি হয়েছে, শোনা যায়নি।
ম্যানহোলে নামার কাজের জন্য নির্দিষ্ট সুরক্ষা বিধি আছে। তা ছাড়া সুপ্রিম কোর্টের নির্দিষ্ট নির্দেশাবলি রয়েছে। বাধ্যতামূলক হল সেফটি জ্যাকেট, গ্যাসরোধক মুখোশ, অক্সিজেন সিলিন্ডার ও প্রত্যেক শ্রমিকের কোমরে দড়ির বাঁধন। যে হেতু ম্যানহোলের নীচে অনেক গভীরে নেমে কাজ করতে হয়, সে কারণে নামার আগে পরীক্ষা করে দেখে নিতে হবে কার্বন ডাই-অক্সাইড বা মিথেনের মতো প্রাণঘাতী গ্যাস আছে কি না। এই ব্যবস্থাগুলি বাধ্যতামূলক। কাজ শেষ হওয়া পর্যন্ত সেফটি ইঞ্জিনিয়ার অবশ্যই থাকতে হবে। এ ক্ষেত্রে সে সব সুরক্ষাব্যবস্থা ছাড়াই শ্রমিকদের ম্যানহোলে নামানো হয়েছিল। কাজে নামার আগে শ্রমিকদের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করার নিয়ম থাকলেও হয়নি। সুরক্ষা বিধি মানলে দুর্ঘটনার ঝুঁকি কমে, প্রাণহানির আশঙ্কা কমানো যায়। এশিয়ান ডেভলপমেন্ট ব্যাঙ্কের টাকায় হচ্ছে প্রকল্প, টাকার অভাব ছিল না। তা বলে মজুরের প্রাণ বাঁচাতে টাকা খরচ করবে ঠিকাদার?
ম্যানহোলে নেমে যাঁদের মৃত্যু ঘটল, তাঁরা আগে বেঙ্গালুরুতে কাজ করতেন। লকডাউনে বাড়ি ফিরে আসেন, আর যাননি। এখানে নির্মাণ-সহ নানা কাজ করেছেন। কিন্তু নির্মাণ কর্মী কল্যাণ তহবিলে নাম নথিভুক্ত করা হয়নি। ফলে ইপিএফ, ইএসআই, কোনও সুরক্ষা প্রকল্পের আওতায় ছিলেন না তাঁরা। আইনানুসারে এক জন শ্রমিক এক দিনের জন্য কাজ করলেও তাঁকে ইপিএফ ও ইএসআইতে নাম নথিভুক্ত করতে হবে। এটা ঠিকাদারের দায়িত্ব। যা পালন না-করাই দস্তুর। প্রশাসন ও ঠিকাদারদের মাঝে থাকেন রাজনীতির কুশীলবেরা। নেতাদের স্বজনরা প্রায়ই ঠিকাদারির বরাত পায়। আইনের ভয় থাকে না। তাই দক্ষ শ্রমিক নিয়োগ, কিংবা অদক্ষ শ্রমিকের প্রশিক্ষণে খরচ না করে, অদক্ষ শ্রমিককে দিয়ে ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করানো হয়। ইলেকট্রিক পোস্টে ওঠা থেকে ম্যানহোলে নামা, সবই করেন দিনমজুর। টাকা পান ন্যূনতম মজুরিরও কম। তাঁদের নাম কোনও নথিতে লেখানো হয় না বলে ঠিকাদারদের কোনও দায় থাকে না। পথ দুর্ঘটনায় পরিবহণ কর্মীর মৃত্যু, সিলিকোসিসে খাদান কর্মীর মৃত্যু, শক লেগে ইলেকট্রিক টাওয়ারে কর্মরতদের মৃত্যু, অঙ্গহানি বা অসুস্থতা, সবেরই রফা হয় কিছু টাকায়।
যে হেতু সরকারি প্রকল্পের কাজে শ্রমিকের মৃত্যু ঘটেছে, সে কারণে তদন্ত হবে। অভিযোগ উঠেছে কলকাতা কর্পোরেশন ও কেইআইআইপি-র বিরুদ্ধে। সরকারি তদন্ত কমিটিতে কেইআইআইপি-র ডিরেক্টর জেনারেল ও ডেপুটি মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিক আছেন। অর্থাৎ, যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ, তাদেরই তদন্তের ভার দেওয়া হয়েছে। এই কাজের দায়িত্ব ছিল কেইআইআইপি-র নিযুক্ত ঠিকাদারদের উপরে। নিরপেক্ষ তদন্ত হলেও হয়তো সম্ভাবনা ছিল ঠিকাদারের গাফিলতি ও দুর্নীতি প্রকাশের। এখন হয়তো মৃত শ্রমিকদেরই অভিযুক্ত করা হবে। তাঁরা সুরক্ষাবিধি না মেনে ম্যানহোলে নেমেছিলেন কেন? মৃত্যুতেও শেষ হয় না শ্রমিকের অসম্মান।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy