Advertisement
২২ নভেম্বর ২০২৪
Political Leaders

ধনী না হলে প্রার্থী নয়

২০১৯ সালের ভারতের সাধারণ নির্বাচনের মোট ব্যয়ের আনুমানিক পরিমাণ ছিল ৮.৫ বিলিয়ন ডলার। পরের বছর আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ব্যয় হয়েছিল আনুমানিক ১৪ বিলিয়ন ডলার।

—প্রতীকী ছবি।

সব্যসাচী রায়
শেষ আপডেট: ০১ মে ২০২৪ ০৮:৩৬
Share: Save:

দেশের সবচেয়ে দরিদ্র বিধায়ক পশ্চিমবঙ্গের নির্মল কুমার ধারা। নেই কোনও গাড়ি-বাড়ি বা ব্যাঙ্কে গচ্ছিত টাকা। কিন্তু, তেমন গরিব বিধায়ক-সাংসদ দেশে ক’জনই বা আছেন! এই পশ্চিমবঙ্গেই ২৯২ জন বিধায়কের মধ্যে ১৫৮ জন কোটিপতি, শতকরা হিসেবে ৫৪ শতাংশ। সাইকেলে চড়ে নির্বাচনী প্রচার করছেন বা হাতে লেখা পোস্টার নিজে দেওয়ালে সাঁটছেন, ভারতের নির্বাচনের ময়দানে এ-ধরনের প্রার্থীর দিন ফুরিয়ে যাচ্ছে। হুডখোলা এসইউভি চড়ে রোড-শো আজ নিউ নর্মাল। সামাজিক-রাজনৈতিক বিবর্তনে নির্বাচনে জনসংযোগের গতিপথ যেমন পাল্টেছে, তেমনই বেড়েছে অর্থবলের মহিমা।

২০১৯ সালের ভারতের সাধারণ নির্বাচনের মোট ব্যয়ের আনুমানিক পরিমাণ ছিল ৮.৫ বিলিয়ন ডলার। পরের বছর আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ব্যয় হয়েছিল আনুমানিক ১৪ বিলিয়ন ডলার। সেটা ছিল বিশ্বের এ-যাবৎ সবচেয়ে ব্যয়বহুল নির্বাচন। অনুমান, আমাদের দেশের এ বারের লোকসভা নির্বাচন সেটাকেও ছাপিয়ে যাবে। আর এটা নির্বাচন আয়োগের ভ্রুকুটির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। পেশিশক্তি (মাসল পাওয়ার), অর্থশক্তি (মানি পাওয়ার), ভুল তথ্য (মিসইনফর্মেশন) ও আদর্শ আচরণবিধি (মডেল-কোড-অব কনডাক্ট): এই চার ‘এম’-কে মাথায় রেখে নির্বাচন আয়োগ দেশের সর্ববৃহৎ গণতান্ত্রিক ম্যারাথন আয়োজনে সলতে পাকানোর কাজে ব্যস্ত।

নির্বাচনী বন্ড পর্দাফাঁসে দেশে হইহই হলেও এতে আমল দিতে রাজি না অভিযুক্ত দলগুলি। মনোযোগটা বরং প্রার্থী বাছাই ও নির্বাচনী প্রচারেই। দলের সম্পদের মতোই গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে প্রার্থী বাছাই। দেখা যাক প্রার্থীর ব্যক্তিগত সম্পদ বিষয়ক তথ্য কী বলছে। ২০১৯ সালের সাধারণ নির্বাচনে জয়ী সাংসদদের গড় সম্পদ ছিল চার কোটি, যা সেই বছরের দেশের গড় মাথাপিছু আয়ের প্রায় তিনশো গুণ, ২০১৪ সালের তুলনায় ৪০ শতাংশ বেশি। এ বার তা সাড়ে চার কোটি ছাড়িয়ে যাবে বলে অনুমান।

২০১৯-এর সাধারণ নির্বাচনে, প্রাপ্ত ভোটের হিসেবে, শীর্ষ দু’জন প্রার্থীর গড় সম্পদের পরিমাণ ছিল চার কোটির উপর। ২০১৯-এর নির্বাচনে বিজয়ীদের মধ্যে ৮৮ শতাংশের গড় সম্পদ এক কোটির উপর ছিল, যেখানে প্রার্থীদের সম্পদের গড় মাত্র ২৫ লাখ। ২০০৯ থেকে ২০১৯ পর্যন্ত, কোটিপতি প্রার্থীর অনুপাত ১৬ শতাংশ থেকে বেড়ে হয়েছে ২৯ শতাংশ। এ বারে ১৯ এপ্রিলের প্রথম পর্যায়ের নির্বাচনে এক-তৃতীয়াংশ প্রার্থী কোটিপতি। কেবল লোকসভা নির্বাচন নয়— পাঁচ রাজ্যের সাম্প্রতিক বিধানসভা নির্বাচনে বিজয়ী ৬৭৮ জন বিধায়কের মধ্যে ৫৯৪ জনই কোটিপতি: ৮৮ শতাংশ। পশ্চিমবঙ্গ থেকে নির্বাচিত ৪২ জন সাংসদের মধ্যে ৩১ জন কোটিপতি।

সম্পদশালী প্রার্থীর সঙ্গে তাল মিলিয়ে বেড়েছে অপরাধের অভিযোগসম্পন্ন প্রার্থীর সংখ্যাও। বিপত্তির সঙ্কেতটা এখানেই। অ্যাসোসিয়েশন ফর ডেমোক্র্যাটিক রিফর্মস (এডিআর)-এর সমীক্ষা বলছে যে, চলতি লোকসভার সাংসদের মধ্যে ৪৪ শতাংশের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা রয়েছে, তাঁদের মধ্যে ২৮ শতাংশ গুরুতর অভিযোগে অভিযুক্ত, যে হার ২০১৪ সালের ছিল ২১ শতাংশ। ২২৫ জন রাজ্যসভার সাংসদের মধ্যে চালানো এডিআর-এর সমীক্ষা অনুসারে ৩৩ শতাংশ সাংসদের ঘোষণাপত্রে ফৌজদারি মামলার উল্লেখ রয়েছে, তাঁদের মোট সম্পত্তির পরিমাণ ১৯ হাজার কোটি টাকা। পশ্চিমবঙ্গও পিছিয়ে নেই। ২০১৯ সালে পশ্চিমবঙ্গের ৩১ জন কোটিপতি সাংসদের মধ্যে ২৩ জন অপরাধের অভিযোগে অভিযুক্ত ছিলেন। ৪২-এর মধ্যে শতকরা হিসেবে ৫৫ শতাংশ, যা জাতীয় গড় থেকে অনেকখানি বেশি।

ক্ষমতা, সম্পদ ও দুর্বৃত্তায়ন, এগুলি থেকে আরও কিছু আশঙ্কা দানা বাঁধে। প্রথমত, ধনী প্রার্থীদের জয়ের সম্ভাবনা যত বেশি হচ্ছে সেই অনুপাতে নির্বাচনে ধনের অন্তর্বাহ বাড়ছে। দেশের জনসংখ্যার বৃহদংশ জনপ্রতিনিধিত্বের সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। দ্বিতীয়ত, ধনী প্রার্থীর গুরুত্ব বৃদ্ধিতে প্রার্থী বাছাই প্রক্রিয়া প্রভাবিত হচ্ছে, প্রভাবিত হচ্ছে নীতিনির্ধারণে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের ভূমিকাও। বিপদগ্রস্ত হচ্ছে অন্তর্দলীয় গণতন্ত্র, দলে নীতিগত সিদ্ধান্ত নেওয়ার বিশেষাধিকার কেবল অভিজাতগোষ্ঠীর মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকছে, পথ হারাচ্ছে যোগ্য প্রতিনিধি বাছাইয়ের প্রক্রিয়া। তৃতীয়ত, নির্বাচনকে এক ধরনের বিনিয়োগ হিসাবে দেখা হচ্ছে। পরিণামে তাদের আর্থিক পৃষ্ঠপোষকদের কাছে বেশি উত্তরদায়ী হতে হচ্ছে। সম্পদ ও বিজয়ের সম্ভাবনার মধ্যে রৈখিক সম্পর্ক এক ঋণাত্মক ধনতান্ত্রিক রাজনীতি তৈরি করেছে, যার অভিঘাতে রাজনীতির দুর্বৃত্তায়ন বাড়ছে। ক্ষমতার গণতন্ত্রায়নের পরিবর্তে সম্পদশালীদের ক্ষমতায়নে সাধারণ মানুষের পরিসর সঙ্কুচিত হয়ে পড়ছে।

নির্বাচনী বন্ডের বাইরেও রাজনীতিতে তাই কালো টাকার ধারাবাহিক প্রবাহ, যা রুখতে এক ব্যাপক প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার অপরিহার্য। দুর্ভাগ্য, হিসাববহির্ভূত অর্থায়নের বিষয়টি এড়াতে রাজনৈতিক দলগুলি উটপাখির মতো বালিতে মুখ গুঁজে রাখছে। “ঈশ্বর তাঁর স্বর্গে আছেন, তাই পৃথিবীতে সব ঠিকই আছে!”, ‘সব চাঙ্গা সি’— এমন আশ্বাস ছড়িয়েই নেতারা ক্ষমতার অলিগলিতে ঘোরাফেরা করছেন।

অন্য বিষয়গুলি:

Politics Wealth
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy