Advertisement
২৪ নভেম্বর ২০২৪
Manipur Violence

বিরাট দুঃসাহসের উঁকি

কী ভাবে বদলে গেল প্রতিবাদের মেজাজ? বীরেন প্রথম থেকেই সংঘর্ষ সামলাতে ব্যর্থ। এত দিন সংগঠিত মেইতেই যৌথ মঞ্চ সুপরিকল্পিত ভাবে নেতৃত্ব দিয়েছে আন্দোলনকে।

An image of Manipur Protest

মণিপুরের প্রতিবাদ সভা। —ফাইল চিত্র।

রাজীবাক্ষ রক্ষিত
শেষ আপডেট: ০৩ অক্টোবর ২০২৩ ০৪:৫০
Share: Save:

এক্স-রে ইমেজটা হাতে নিয়ে চমকে উঠেছিলেন ছেলেটার বাবা। খুলির চার দিকে গর্তের চিহ্ন। মাথা, কান, ঘাড়েও ক্ষত। তত ক্ষণে মাথায় সেলাই পড়েছে, রক্ত বন্ধ হয়েছে। কিন্তু ভিতরের চেহারাটা দেখে কথা বন্ধ সকলের। ছেলেটার ডান হাত খুব কাছ থেকে শটগানের গুলিতে ছিন্নভিন্ন, এক্স-রে দেখাচ্ছে ভিতরে পেলেট-এর দানা ভর্তি। তাকে অ্যাম্বুল্যান্সে তোলা হচ্ছিল, রাস্তায় দৌড়ে বেড়ানো নিরাপত্তা বাহিনীর চোখ পড়তে ‘রে রে’ করে তেড়ে এল তারা। স্ট্রেচার ফেলে অন্যরা পালালেন। তাতেও রক্ষা নেই, উদ্যত লাঠি পুরুষ-মহিলা ভেদ করে না।

কাশ্মীরে বিক্ষোভ দমনের এমন চেহারা মাঝে-মধ্যে সংবাদপত্রে দেখে শিউরে উঠতেন ভারতবাসী। ইম্ফল সেই সব ছবি আবারও জীবন্ত করে তুলল। এত দিনের সংঘর্ষে মেইতেইদের পূর্ণ সমর্থন পেয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী এন বীরেন সিংহ ও বিজেপি সরকার। কিন্তু মণিপুরের টেরা টংব্রাম লেইকাইয়ের বাসিন্দা, বছর কুড়ির ফিজাম হেমজিৎ ও তার প্রেমিকা, সতেরো বছরের এইচ লিংথোইংগাম্বি মণিপুরের সংগ্রামের মুখ ঘুরিয়ে দিল— প্রাণ দিয়েই। গত বুধবারের ইম্ফল দেখল বীরেনের কুশপুতুল পোড়াচ্ছে মেইতেইরা, রাস্তায় হাতে কুকরি নিয়ে তাঁকে অকথ্য গালি পাড়ছে কেউ। সরকারের ব্যর্থতার প্রতিবাদে বিজেপি থেকে ইস্তফা দিলেন মণিপুরি চিত্রতারকা রাজকুমার কাইকু ওরফে সোমেন্দ্র। খোদ বীরেনের কেন্দ্র থৌবালে জনতা বিজেপির মণ্ডল অফিস জ্বালিয়ে দিল।

কী ভাবে বদলে গেল প্রতিবাদের মেজাজ? বীরেন প্রথম থেকেই সংঘর্ষ সামলাতে ব্যর্থ। এত দিন সংগঠিত মেইতেই যৌথ মঞ্চ সুপরিকল্পিত ভাবে নেতৃত্ব দিয়েছে আন্দোলনকে। অভিযোগ, সরকারি মদতে পুষ্ট আরাম্বাই টেঙ্গল বাহিনী অবাধে অস্ত্র লুট করে, পুলিশের গাড়িতে পুলিশেরই অস্ত্র হাতে ঘুরে নিজেদের মেইতেই-রক্ষক বলে প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছিল। ক্ষোভের অভিমুখ সরকারের ব্যর্থতার দিক থেকে পাহাড়ে কুকিদের দিকে ঘোরাতে সফল হয়েছিল সরকার-যৌথ মঞ্চ-সশস্ত্র বাহিনীর ত্রিফলা। সঙ্গে সুযোগ্য মদত দিয়েছে মহিলা বাহিনী মেইরা পাইবি। কিন্তু খানিক বদল এল ২৬ সেপ্টেম্বর। দুই ছাত্র-ছাত্রী তথা প্রেমিক-প্রেমিকার হারিয়ে যাওয়ার খবর আগেই পেয়েছিল তাদের বন্ধুরা। নাবালিকা কিশোরীর বাবা পুলিশের কাছে অভিযোগ করেছিলেন, ওই তরুণ তাঁর মেয়েকে ফুসলিয়ে পালিয়েছে। বন্ধুরা ভাবছিল, হয়তো পরিবারের অমতে প্রেমিকাকে গোপনে বিয়ে করতে নিয়ে গিয়েছিল হেমজিৎ। সে সব ৬ জুলাইয়ের ঘটনা, রাজ্যে আন্তর্জাল বন্ধ। ২৫ সেপ্টেম্বর সরকার তা চালু করতেই হিংসা, সংঘর্ষ, অগ্নিসংযোগের ঘটনার পাশাপাশি দুটো ছবি ছড়িয়ে পড়ল: একটি ছবিতে দেখা যাচ্ছে জঙ্গলে বসা ছেলে ও মেয়েটির পিছনে দাঁড়িয়ে আছে জংলা পোশাক পরা তিন সশস্ত্র যুবক; পরের ছবিতে দু’জনের মৃতদেহ।

কুকিরা দাবি করে, সাম্প্রতিক সংঘর্ষের সঙ্গে ওই ঘটনার যোগ নেই, বরং তা মেইতেইদের ‘অনার কিলিং’ হতে পারে। কুকি যৌথ মঞ্চ জানায়, দু’জনের দেহ উদ্ধার হয়েছে মেইতেই এলাকা বিষ্ণুপুরে। পরে ওই যুগলের একটি ভিডিয়োও ভাইরাল হয় যা ‘সমাজের চোখে আপত্তিকর’। কুকিরা দাবি করে, ভিডিয়োর জেরেই প্রেমিক ও নাবালিকা প্রেমিকাকে মেরেছে ওদের নিজের লোকেরাই, কুকিদের অযথা কাঠগড়ায় তোলা হচ্ছে। কিন্তু পুলিশের তদন্তকারীরা জানতে পারেন, ওই যুগল বাইকে চেপে লাইখা পাথরকুচি কারখানা পেরিয়ে জৌপিতে কুকি গ্রামের কাছে গিয়েছিল। সেখানে তাদের নিজস্বী তুলতে দেখে কুকি স্বেচ্ছাসেবকেরা ফিরে যেতে বলে। কিন্তু তা না করে হেমজিৎ কুকি বাঙ্কারে গিয়ে গাঁজা চায়। এর পরেই কুকি জঙ্গিদের একটি দল তাদের ধরে নিয়ে যায়; পুলিশের দাবি, পরে তাদের হত্যা করে কুকি জঙ্গিরা। পুলিশ জানায়, হেমজিতের মোবাইলের শেষ লোকেশন লামদানে কুকি অধ্যুষিত এলাকায় মিলেছে। এলাকাটি সংঘর্ষ-বিরতিতে থাকা কুকি জঙ্গিদের ঘাঁটি হওয়ায় পুলিশ সেখানে তদন্তে যেতে পারেনি। ওই রিপোর্ট ভাইরাল হতেই গত মঙ্গলবার রাত থেকে উত্তেজনা বাড়ে।

এমন হত্যার ঘটনা গত পাঁচ মাসে রাজ্যে প্রায় দু’শোটি। কিন্তু এ বারে দুই ছাত্র-ছাত্রীর হত্যার বিচার চেয়ে সরাসরি রাস্তায় নামে ছাত্রদল। যুগলের প্রেম কিশোর মনে ‘কমরেডশিপ’-এর জন্ম দিয়েছিল, সংঘর্ষ-জর্জর কৈশোরের কাছে তাদের মৃত্যু শুধু ক্ষোভ নয়, জন্ম দেয় শূন্যতা। সেই জ্বালা জুড়াতেই পুলিশের সঙ্গে লড়তে যায় তারা। অসহায় হয়ে পড়ে নিরাপত্তা বাহিনী, সমস্যায় পড়ে সরকার। এত দিন কূটনীতির প্যাঁচে সমতলের আন্দোলন নিয়ন্ত্রণে সফল হয়েছিল বিজেপি। এ বার কিশলয় আবেগের সামনে দুঁদে রাজনীতিকের প্যাঁচ-পয়জার। কিন্তু সরকার তো পরাজয় মানতে শেখেনি, তাই পুলিশ ঝাঁপিয়ে পড়ে ছাত্রদের উপর, লাঠি, কাঁদানে গ্যাস, পেলেট গান নিয়ে।

সরকারের পীড়ন চোখ খুলে দিয়েছে বাবা-মায়েদের। তাই এই প্রথম মণিপুরের সমতলে বিজেপি-বিরোধী বিক্ষোভ প্রকট হল। কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারের বিরুদ্ধে শাণিত হচ্ছে প্রতিবাদ। বার বার ক্ষমা চাইতে বাধ্য হচ্ছেন বীরেন। বলছেন, সাজা দেবেন ছাত্র-পেটানো পুলিশকে। পাঁচ মাসের ঘটনা যে আসন টলাতে পারেনি, দু’দিনের ছাত্রবিক্ষোভ সেই গদিতে কাঁপুনি ধরিয়ে দিয়েছে। তবে ভয় হয়, এর পরে আর পেলেট নয়, বুলেট বরাদ্দ হবে না তো?

অন্য বিষয়গুলি:

Manipur Violence Student Death Protest Manipur
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy