পূর্বাঞ্চল এক্সপ্রেসওয়ে। ফাইল চিত্র।
সুলতানপুর পেরিয়ে ডান দিকে ঘুরে গাড়ি যেই উত্তরপ্রদেশের পূর্বাঞ্চল এক্সপ্রেসওয়েতে উঠল, যুধিষ্ঠিরের রথ যেন— চাকা আর মাটি ছোঁয় না। বছরখানেক আগে এই রাস্তাতেই নেমেছিল প্রধানমন্ত্রীর বিমান, গর্বিত মুখে দাঁড়িয়ে ছিলেন মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ। গর্ব করার মতোই রাস্তা বটে একখানা, ঘণ্টায় একশো কিলোমিটার গতিতে চলা গাড়িতে বসে চা খাওয়া যায় নির্দ্বিধায়, এতই মসৃণ রাস্তা যে, চলকে পড়ার ভয় নেই। ৩৪০ কিলোমিটার রাস্তা, রাজ্যের ন’টা জেলার উপর দিয়ে গিয়েছে— সেই রাস্তায় ঢোকার পথ এগারোটা। গড়পড়তা ৩০ কিলোমিটার দূরে দূরে। এর বাইরে মাছিটি গলার জো নেই। দু’পাশের জমি থেকে দশ-বিশ ফুট উঁচুতে রাস্তা, টানা কাঁটাতার দিয়ে ঘিরে রাখা।
পূর্বাঞ্চল এক্সপ্রেসওয়েতে উঠে পড়ার পর পাপ্পু সিংহের মুখটা ক্রমে ঝাপসা হয়ে যায়। অথচ, খানিক ক্ষণ আগেই জৌনপুরের হাইওয়ের ধারে চমৎকার চা খাইয়েছিল পাপ্পু। ২০২০ সালে তৈরি তার দোকান, সামনের সিমেন্টের দেওয়ালে লেখা তার আর ভাই প্রিন্সের নাম। চায়ে জোয়ানের গন্ধ— জিজ্ঞাসা করায় বলল, শীতকালে জোয়ান দেওয়া চা খেলে শরীর গরম থাকে। এই জৌনপুরেই একদা সৃষ্টি হয়েছিল জৌনপুরী রাগ, শারকি সাম্রাজ্যের শেষ সুলতান ‘গান্ধর্ব’ হুসেন শাহ শারকির হাতে— এক গাল হেসে বছর কুড়ির পাপ্পু জানাল যে, এ সব খবর তার জানা নেই আদৌ। হাইওয়ের ধারে বাবা দোকান করে দিয়েছে দু’ভাইকে, আপাতত এটুকুই। পূর্বাঞ্চল এক্সপ্রেসওয়েতে পাপ্পু সিংহের চায়ের দোকান থাকবে না, স্বাভাবিক। আচমকা ভুঁই ফুঁড়ে সামনে চলে আসা অকিঞ্চিৎকর চায়ের দোকান নয়, ভবিষ্যৎগামী এই রাস্তায় নির্দিষ্ট দূরত্বে থাকা খাবারের দোকানের কথা জানা যায় অন্তত দু’কিলোমিটার আগে থেকেই। এমন রাস্তা ভারত আগে দেখেনি।
অথবা, দেখেছে। আক্ষরিক রাস্তা না হলেও, পথ। উন্নয়নের পথ। যেখানে যার অধিকার ছিল, তাকে সেখান থেকে বিচ্যুত করে, তাকে বাইরে রেখে অলঙ্ঘ্য গণ্ডি টেনে দিয়েই তো উন্নয়ন হয়। বাঁধ তৈরি হবে বলে ভেসে যায় গ্রামের পর গ্রাম, মাটির নীচে আকরিকের সন্ধান পাওয়ামাত্র জঙ্গলের অধিকার খোয়ান জনজাতিরা। শিল্প হবে বলে চাষের জমি ছেড়ে চলে যেতে হয়। কিচ্ছুটি না হয়ে শুধু বহুতল আবাসন হলেও আদি বাসিন্দাদের পক্ষে তার গেটের নিরাপত্তাবেষ্টনী ভেদ করা কতখানি কঠিন হয়, ঘরের কাছের রাজারহাট বিলক্ষণ জানে। উন্নয়ন মানেই তো কাঁটাতার, সেখানে প্রবেশ নিষেধ। সে উন্নয়নের সুফল চুইয়ে কাঁটাতারের গণ্ডি টপকে বাইরে থেকে যাওয়া মানুষজনের কাছে তিলমাত্র পৌঁছয় না, এমন কথা বললে ধর্মে সইবে না। কিন্তু, পূর্বাঞ্চল এক্সপ্রেসওয়ের যত কাছেই বাড়ি হোক না কেন, কোনও পাপ্পু বা প্রিন্সের পক্ষে সে রাস্তার ধারে দোকান খুলে ধাবমান গাড়ির থমকে যাওয়ার অপেক্ষায় থাকা অসম্ভব। তেমনটা সম্ভব হলেই যে সর্বজনের মঙ্গল, সে কথা বলছি না। হাইওয়ে যদি অবাধ হয়, গাড়ির গতিবেগ বাড়ে, এক শহর থেকে অন্য শহরে যদি দ্রুততর পৌঁছয় পণ্য ও মানুষ, তাতেই হয়তো অর্থনীতির মঙ্গল— অভ্যন্তরীণ উৎপাদন বাড়বে দ্রুততর হারে। তবে, সে উন্নতির ফল কার কাছে কতখানি পৌঁছবে, সে হিসাবও মাঝেমধ্যে কষে দেখা ভাল।
হাইওয়ে নাকি ভারতের শিরা-ধমনীর মতো। সব ধমনীতে রক্ত এমন দ্রুতগামী নয়। এই উত্তরপ্রদেশেই, ডেহরি-অন-শোন পেরিয়ে, বিহারের সীমানা ছাড়িয়ে দিল্লি রোড যখন বারাণসীর দিকে এগোয়, সেই রাস্তায় উঠে আসে অটোরিকশা, ছোট ভ্যান, সাইকেল, মালবাহী ‘ছোটা হাতি’— ন্যাশনাল হাইওয়ের গেরামভারী ভাবকে থোড়াই কেয়ার করে দিব্য উল্টো মুখে চলতে থাকে ট্রাক্টর, মোটরবাইক। সব দিক সামলে গাড়ির গতি ঘণ্টায় ষাট কিলোমিটারে রাখা প্রায় অসম্ভব। অধৈর্য লাগে। ভারত নামক দেশটাকে নিয়েই যেমন অধৈর্য লাগে হরহামেশা। এই হাইওয়ে কাঁটাতারে মুড়ে রাখা নয়, পার্শ্ববর্তী মানুষের জীবনে সম্পৃক্ত হতে তার বাধা নেই তাই। এক জনপদ থেকে অদূরের অন্য জনপদে যাওয়ার জন্য এই হাইওয়েতে উঠতে কোনও এন্ট্রি পয়েন্টের অনুমতির প্রয়োজন হয় না।
সেটাই কি ভাল তবে? এই অনন্ত বিশৃঙ্খলা, প্রতি মুহূর্তে গতিময়তার পথ আটকে দাঁড়িয়ে পড়া? মন্দ যদি হয়, কার জন্য মন্দ? ভাল হলেই বা কার জন্য? এই সব কূট প্রশ্নের ধার ধারে না রাস্তা। জীবনও। যে হাইওয়েকে ছোঁয়া যায়, জীবন তাকে বেঁধে ফেলে আষ্টেপৃষ্ঠে। রাস্তার ধারে উবু হয়ে বসে রোদ পোহায় কোলকুঁজো বুড়ো, অনেকখানি জায়গা পেয়ে মাছধরার জাল শুকোতে দেওয়া থাকে। রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে পড়ে দূরপাল্লার ট্রাক, ড্রাইভার আর খালাসি খানিক ক্ষণের ঘরকন্না করে তার পাশেই। কোডারমা থেকে গিরিডি হয়ে ধানবাদের দিকে চলে গিয়েছে যে টু-লেন স্টেট হাইওয়ে, তার অনেকখানি জায়গা জুড়ে বোর্ড লাগানো আছে, হাতির রাস্তা পার হওয়ার পথ। আসলে তো হাতিরই পথ ছিল— হাইওয়ে তাতে দখল বসিয়েছে। তবু, পুরোটা কেড়ে নেয়নি, কাঁটাতারে আটকে দেয়নি হাতিদের পারাপার। জীবন আর রাস্তা কাটাকুটি খেলতে খেলতে এগোয়।
হাইওয়েও ঢুকে পড়ে জীবনে। স্টেট হাইওয়ে ধরে চলা, যাত্রী উপচে পড়া ঢিমে টেম্পোকে অতি দ্রুত টপকে যাওয়ার সময়, রাস্তার ধারের পুকুরে বাসন মাজতে থাকা বধূটিকে পেরিয়ে যাওয়ার সময়, একটা ছাগলের পিছনে ছুটতে থাকা বালিকাকে পিছনে ফেলে এগিয়ে যাওয়ার সময় মনে হয়, সেকেন্ডের ওই ভগ্নাংশের জন্য বুঝি এই জীবনটায় ঢুকে পড়া গেল। পরের সেকেন্ডেই সে জীবন থেকে সরে যাব, জানি, তবু ওই সেকেন্ডটায় ছোঁয়া গেল সেই প্রাত্যহিকতা। হাইওয়ের দ্রুতগতি গাড়ি এগিয়ে যাবে, এই জীবন চলবে তার ধীরগতিতেই। সেই টেম্পো নির্দিষ্ট দূরত্বে গিয়ে আবার ফিরে আসবে নতুন যাত্রী নিয়ে, একই মন্থরতায়। লাল চুলের অতি অপুষ্ট শিশু বসে থাকবে বাড়ির দাওয়ায়, অবশ্য যদি বেঁচে থাকে তবেই। বালিকা ক্রমে কিশোরী হবে, হয়তো সে বেলা পেরোনোর আগেই কাছেপিঠের অন্য কোনও গ্রামে বিয়ে হয়ে যাবে তার। অন্য কোনও দ্রুতগামী গাড়ি তাকে দেখবে অন্য কোনও গ্রামের পুকুরঘাটে। সে গাড়ির দেখার মেয়াদও কয়েক মুহূর্তের। গ্রামের অনন্তের সঙ্গে হাইওয়ের ক্ষণিকের দেখা হয় যে ভাবে।
এক-এক সময় ধাঁধা লাগে— তা হলে কি হাইওয়েটাই দেশ? তৈরি হয়েই চলেছে সে সড়ক— কোথাও আড়েবহরে বাড়ছে, কোথাও তৈরি হচ্ছে নতুন ওভারব্রিজ। ডাঁই করা মাটির পাহাড়, তার উপরেই চলছে জেসিবি। তখন পাশের ভাঙাচোরা ডাইভার্শন দিয়ে যেতে হয়। খানাখন্দের উথালপাথাল পেরোতে হয় একটাই আশ্বাসে, কাল না হোক পরশুর পরের দিন মসৃণ, গতিময় রাস্তা খুলে যাবে। দ্রুতগতিতে যাওয়ার সময় চোখ এড়িয়ে যায় যে সব জনপদের নাম, রাস্তার ধারের প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র অথবা বাজার, ডাইভার্শনের বাধ্যতামূলক শ্লথতা তার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয়। যে জায়গার নাম জানার কথাই ছিল না, তার রাস্তায় সাইকেল হাতে হাঁটতে হাঁটতে আসা স্কুলকিশোরীর দলকে দেখা হয়ে যায়। বিহারে সাইকেল আর রাস্তা গ্রামের মেয়েদের জীবন পাল্টে দিয়েছে অনেকখানি, খবরের কাগজে পড়া এই কথাটাকে চাক্ষুষ করা যায় খানিক ক্ষণের জন্য হলেও। অবশ্য, সে দেখাই যে ঠিক, তেমন ভরসা নেই। মুহূর্তের দেখা, মুহূর্তেরই। তার পলিটিক্যাল ইকনমি নাই।
রাস্তাই যদি দেশ হয়, তা হলে তো দিল্লি রোডও সত্যি, পূর্বাঞ্চল এক্সপ্রেসওয়েও সত্যি। পাশাপাশিই তো থাকে হট্টগোলের পাড়া, আর সিকিয়োরিটি-শোভিত গেটেড কমিউনিটি। কিন্তু এটাও সত্যি যে, সেই সহাবস্থান স্থবির নয়— কাঁটাতার সমানেই চায় আরও বেশি জায়গাকে ঘিরে নিতে, আরও বেশিটুকু দখল করে নিতে আরও অল্প কয়েক জনের জন্য। এটাও সত্যি যে, পূর্বাঞ্চল এক্সপ্রেসওয়ে দিয়ে যদি আমার গাড়ি ঘণ্টায় ১২০ কিলোমিটার বেগে ছোটে, তবুও কোনও না কোনও কাঁটাতারের বাইরে থাকতেই হবে কোনও না কোনও দিন। কোনও এক সীমানার বাইরে দাঁড়িয়ে দেখতে হবে, আগে যে জমিতে হেঁটে যাওয়া জলহাওয়ার মতো সহজ ছিল, এখন সেখানে পৌঁছনোর কোনও উপায় নেই, সে দূরত্ব অসেতুসম্ভব।
রাস্তাই যদি একমাত্র রাস্তা হয়, তা হলে কোন রাস্তা বাছব, বার বার ভেবে নেওয়া ভাল।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy