—প্রতিনিধিত্বমূলক ছবি।
দেবী দুর্গা জলে পড়লে মর্তবাসীর হৃদয় বিদীর্ণ হয়ে যায়। কিন্তু, এ বিদায় নয় চিরবিদায়। চিরবিদায়ের প্রকৃত যন্ত্রণা জানেন সেই সব উমার বাবা-মায়েরা, যাঁরা তাঁদের গৌরী-মাকে শ্বশুরালয়ে দিয়ে এসেছিলেন, আর সেখান থেকেই তাকে ডাক দিয়েছে বিসর্জনের ঘাট। কতশত ঘরের দুর্গা যে রোজ সংসারপথ ধরে এসে দাঁড়িয়েছেন আত্মহননের দুঃখনদীটির পাড়ে, ক’জন তার খবরটুকুও রাখেন?
এই যেমন সে দিনের কথা। দিদিমণি ছাত্রীকে জিজ্ঞেস করলেন, “বাবা-মা কী করেন?” ছাত্রীর উত্তর, “বাবার ব্যবসা আছে৷ মা কিছু করেন না।” দিদিমণি বললেন, “মা তো চব্বিশ ঘণ্টা কাজ করেন। ছুটি নেই কোনও দিন। তাও কিছু করেন না?” ছাত্রী হতভম্ব। আমরাও হতভম্ব ‘ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরো-র (এনসিআরবি) তথ্যে। এই ‘কিছু না করা’ গৃহবধূ, যাঁদের মন ভোলাতে ‘হোমমেকার’ বলা হয়, তাঁরা নাকি বহু বছর ধরে আত্মহত্যায় রেকর্ড গড়ে চলেছেন।
এনসিআরবি জানিয়েছে, ২০২১ সালে ভারতে যত মহিলা আত্মহনন করেছেন (৪৫,০২৬ জন), তার ৫১.৫%-ই (২৩,১৭৮ জন) গৃহবধূ। এ দেশে পেশার নিরিখে আত্মহত্যার হিসাব নেওয়া শুরু ১৯৯৭ সাল থেকে। সেই বছর শুধু মায়েরাই আত্মহত্যা করেছিলেন ২০,০০০ জন (শুধু সরকারি খাতায়)। এর পর সংখ্যাটা বাড়তেই থাকে। এমনিতেই বিশ্বে ১৫-৩৯ বছর বয়সসীমার মধ্যে আত্মঘাতী মহিলাদের ৩৬ শতাংশই ভারতীয় (প্রতি নয় মিনিটে এক জন মহিলা)। তাঁদের মধ্যে গৃহবধূদের অবস্থা আরও খারাপ। ২০১৭ সালে ভারতের আত্মহননকারী মহিলাদের মধ্যে ৫১.৩% ছিলেন ‘হোমমেকার’। ২০১৮-২০২০ বছরগুলিতে এই হার যথাক্রমে ৫৪.১%, ৫১.৫%, ৫০.৩%। অর্থাৎ, ধারাবাহিক ভাবেই ভারতীয় নারীদের মধ্যে অর্ধেকের বেশি আত্মহননের ঘটনা ঘটছে গৃহবধূদের জীবনে। এ কেবলই এক সাম্প্রতিক দুর্ঘটনা নয়। কোভিডকাল হয়তো সেই পটচিত্রে আরও অন্ধকার জুড়েছে।
পরিসংখ্যান কি আর সব সময় সত্যি কথা বলে? ভারতের মতো সমাজব্যবস্থায় সব সময় পরিসংখ্যান ঠিক ভাবে নেওয়াও সম্ভব হয় না। কিন্তু ‘ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল ক্রাইম রেজিস্ট্রি’-র রেকর্ডে পাওয়া পরিসংখ্যান হতবাক করে দেয়। জানা যায়, দেশে প্রতি দিন গড়ে ৬১ জন গৃহবধূ আত্মহত্যা করেন। প্রতি ২৫ মিনিটে আমাদেরই আশপাশে কোনও এক দুর্ভাগা বধূর মৃত্যু ঘটে যায় তাঁর নিজেরই হাতে (এও শুধু সরকারি খাতার পরিসংখ্যান, এর বাইরে কত জন— হিসাব নেই)। প্রশ্ন হল, নিজের হাতে নিজেকে যিনি হত্যা করেন, সত্যিই কি সে হত্যায় তাঁর একারই দায়? না কি আমাদের পরিবার, আমাদের সমাজ আত্মহননের পরিস্থিতি তৈরি করে তাঁকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেয়?
মহিলাদের আত্মহননের প্রধান কারণ বিবাহিত জীবনের সমস্যা। এর মধ্যে বিবাহজনিত সমস্যা এবং আনুষঙ্গিক পারিবারিক সমস্যা, দুই-ই থাকে। ২০২১ সালে শুধু পণ দেওয়া-নেওয়ার কারণে আত্মহত্যা করেন ১৫০৩ জন নারী। তা ছাড়া স্বামী ও শ্বশুরবাড়ির লোকজনের দ্বারা মানসিক ও শারীরিক নির্যাতন, সন্তানহীনতা, ঋতুবন্ধের সমস্যাজনিত হতাশা, অসুস্থতা, অভাব ইত্যাদি তো আছেই। সন্তান বড় হয়ে দূরে চলে গেলে ঘর যখন ‘শূন্য খাঁচা’, সেই শূন্যতাও মহিলাদের আত্মহননে ঠেলে দেয়।
মনোবিদরা দেখিয়েছেন, ১৮ বছরের আশপাশের কিশোরী নববধূদের আত্মহত্যার প্রবণতা সবচেয়ে বেশি৷ জীবনে হঠাৎ আসা পরিবর্তন তাঁদের হতচকিত করে দেয়। মেয়ে থেকে তাঁরা হয়ে যান বধূ, গৃহবধূ, গৃহপরিচারিকা, আরও অনেক কিছু। বেশির ভাগ পরিবারে স্বীকৃতি মেলে না। বদলে সমালোচনা আর নির্যাতন কাহিল করে তাঁদের। লেখাপড়া, জীবনের লক্ষ্য, সব জলাঞ্জলি। সংসার হয়ে দাঁড়ায় যক্ষপুরী। আগে তাও স্বামী কাজে বেরোলে কাউকে একটা ভরসা করে মনের কথা বলে মুক্তি পাওয়া যেত। কোভিড সেই ঘণ্টা কয়েকের খোলা আকাশও কেড়ে নিল। প্রচণ্ড দায়িত্ব, প্রবল লিঙ্গবৈষম্য— সব মিলিয়ে হতশ্বাস অবস্থা। সঙ্গে যোগ হয় নিত্য নির্যাতন। মনোবিদ সৌমিত্র পাথারে-র ভাষায়, পুরুষ বাড়ি ফেরেন। স্ত্রীকে মারধর করেন। স্ত্রী আত্মহনন করেন, যেন এটাই তাঁর ‘প্রতিশোধ’। নিজেকে হত্যা করে তিনি নির্যাতক পুরুষ ও তাঁর পরিবারকে আক্ষেপের সামনে দাঁড় করাতে চান। বেঁচে থাকলে দেখতে পেতেন, কিছুই হয় না। বরং, সম্ভব হলে স্বামী আরও একটি বিয়ে করেন।
অনেকের ধারণা, লেখাপড়া জানা আধুনিক সমাজে শিক্ষিত নারী আত্মহত্যা কম করেন। বাস্তব সে ধারণায় সায় দিচ্ছে না। বিহার, ঝাড়খণ্ড, উত্তরপ্রদেশ ইত্যাদি উত্তর-ঘেঁষা রাজ্য— যারা লেখাপড়ার বড়াই তেমন করে না, নারীর উপর নির্যাতনও যেখানে কম নয়— সেখানে কিন্তু মেয়েরা এত আত্মহত্যা করেন না। বরং দক্ষিণের অধিক শিক্ষিত ও উন্নততর রাজ্যে গৃহবধূরা বেশি আত্মহত্যা করছেন (যেমন তামিলনাড়ু)। মনোরোগ বিশেষজ্ঞ এন এন রাজু বলেছেন, মেয়েরা শিক্ষিত না অশিক্ষিত, তাতে কিছু যায়-আসে না। গ্রাম বা শহরও বিবেচ্য নয়। আসল কথা হল শারীরিক বা মানসিক ভাবে তিক্ত সম্পর্ক, অত্যাচার ইত্যাদি দ্বারা তাঁরা কতখানি পিষ্ট। শিক্ষিত মেয়ের সুস্থ জীবনের প্রতি দাবি, আশা, মূল্যবোধ সবই উন্নততর। কিন্তু সমাজ তাঁকে ফেলে রাখে সেই সামন্ততান্ত্রিক অন্ধকূপে৷ ফলে তাঁর হতাশা অন্যদের চেয়ে অনেক বেশি হয়৷ জীবন অর্থহীন ঠেকে।
এনসিআরবি আত্মহত্যায় সফলদের হিসাব দিয়েছে। আত্মহননের প্রচেষ্টায় ব্যর্থদের সংখ্যা তার বহু গুণ বেশি। সে হিসাব ভারতে সে ভাবে নেওয়াও হয় না। কাজেই, ঠিক মতো কাউন্সেলিং বা অন্য ব্যবস্থা করলে বহু আত্মহনন হয়তো আটকানো যেত। এ ক্ষেত্রে যায় না। অনেক নির্যাতিতাই বারংবার মা-বাবার কাছে আশ্রয় চাইতে যান। দারিদ্র বা সামাজিক লজ্জার ভয়ে তাঁরা মেয়েকে ‘মানিয়ে নেওয়া’-র টোটকা দিয়ে ফিরিয়ে দেন। পরে সেই মেয়েরই মৃতদেহ নিয়ে থানায় যাওয়ার লজ্জা বহন করতে হয়। মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নতির কথা বললে দেশের অধিকাংশ লোক ‘পাগলামি’ বোঝে। কাজেই স্কুল স্তর থেকে মনের স্বাস্থ্যের যত্নের কথা ভাবাই যায় না। বিশেষত সরকারি স্কুলে, যেখানে ভবিষ্যৎ ভারতের বেশির ভাগটাই বসে আছে, সেখানে এ প্রসঙ্গ বাতুলতামাত্র! আর যেখানে মেয়েদের গুণ গাইতে গেলে আগে তাঁদের ছাই উড়তে হয়, সেখানে গৃহবধূ তথা মহিলাদের আত্মহত্যা নিয়ে মাথা ঘামাবে কে! ‘ন্যাশনাল সুইসাইড প্রিভেনশন স্ট্র্যাটেজি’-র অস্তিত্ব সম্পর্কে ক’জন ওয়াকিবহাল? কাজেই কোন গৃহের গরাদে আটক কোন বধূ একটু একটু করে রোজ মরছেন, সে খবর কেউ কানে তোলে না। তার পর যখন তিনি গায়ে কেরোসিন ঢেলে মরে যান অথবা সিলিং ফ্যান থেকে দোলেন পেন্ডুলামের মতো, তখন সকলের খেয়াল হয়, ঘড়িতে একটা অসময় বাজছে।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘দেনাপাওনা’য় পণ দিতে না পারায় নিরুপমার মৃত্যু ‘ক্লিনিক্যালি’ স্বাভাবিক হলেও, আসলে সে-ও তো আত্মহননই ছিল। আজকের নীরব নিরুপমাদের কাহিনিই বা আমরা কত জন জানি? কফিনে শেষ পেরেক মারে সেই পুরুষের পরিহাস, “বাড়ির প্রাইম মিনিস্টার তো গিন্নি। আমি ও সবের খোঁজ রাখি না।” এই খোঁজ না-রাখা অতিসরলীকরণ যে গিন্নিকে চিরতরে নিখোঁজ করে দিতে পারে, সে কথা হয় পুরুষতান্ত্রিক ভারত জানে না, অথবা জেনেও না জানার ভান করে। দুটোই অপরাধ। দুটোই আরও একটা জীবনহানিকে ত্বরান্বিত করে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy