— ফাইল চিত্র।
মধ্যবিত্তদের সংজ্ঞায়িত করা, আর কবিতার সংজ্ঞা নিরূপণ দুই-ই কঠিন। তায় কবিতার গায়ে আধুনিকতার তকমা থাকলে তার ব্যাখ্যা আরও দুরূহ। রবীন্দ্রনাথের মতে নদীর মতোই, সাহিত্যও যখন গতি বদলায়, সেই বাঁকটাই আধুনিকতা। বিশ শতকের কবিতায় সেই মধ্যবিত্ত সমাজ, ভাবনা এবং নারীস্বর নিয়ে এই নিবন্ধ।
বাংলা সাহিত্যে গীতিকবিতার যুগের পরই সনেটের (চতুর্দশপদী কবিতা) প্রবর্তন। রবীন্দ্রোত্তর কবিতায় রাধারাণী দেবী (ছবি) অন্যতম শ্রেষ্ঠ নারী সনেট কবি। তাঁর কাব্যে নারীজীবনের প্রেম, মধুর ভাব বিকশিত। কিন্তু আত্মমগ্নতার মধ্যেও বাস্তবকে উপেক্ষা করেননি। প্রমথ চৌধুরীর মন্তব্যকে চ্যালেঞ্জ নিয়ে ‘অপরাজিতা দেবী’ ছদ্মনামে প্রবল সাড়া জাগিয়েছিলেন। কবি-সমালোচক আনন্দ বাগচী লিখেছেন, “...বাংলা সাহিত্যে ছদ্মবেশী নারীর বিদ্রোহের সূচনা, এদেশে ফেমিনিস্ট আন্দোলনের মুখবন্ধ তিনিই রচনা করে গিয়েছিলেন।”
চল্লিশের দশকে আলোড়ন তুলেছিল অক্ষরবৃত্ত ছন্দ, গদ্য কবিতা। বিশ শতকের শুরুতেই মেয়েরা লেখাপড়ার সুযোগ পেলেও ব্যক্তিত্ব প্রকাশের পথ প্রশস্ত ছিল না। সেই বেড়া ভাঙলেন বাণী রায়। তাঁর লেখনীতে বাঙালির সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও মানবিক মূল্যবোধের পরিবর্তন চিত্রায়িত, অভিনব ভাষাশৈলীতে নারীজগতের দর্পণ। রাজলক্ষ্মী দেবীর কবিতায় স্বতন্ত্র আধুনিকতা বলে— “অর্ধেক মানবী আমি, অর্ধেক যন্ত্রণা।” রবীন্দ্রোত্তর কবিতায় প্রথম নারী কবি হিসাবে আধুনিক ভাষা ও আঙ্গিক আত্মস্থ করেন। নারীর স্বাধীন সত্তার উন্মোচন, প্রেম, হৃদয়বেদনার পাশাপাশিই রেখেছেন মধ্যবিত্তের যাপন। এবং, এক অন্তর্ভেদী মায়া।
স্বাধীনতা পরবর্তী তাৎপর্যপূর্ণ সময়ে কবিতা সিংহ, নবনীতা দেব সেন, সাধনা মুখোপাধ্যায়ের কবিতা ব্যক্তিগত অনুভবের পথে হেঁটেই আটপৌরে মধ্যবিত্তের কবিতা হয়ে উঠেছে। কবিতা সিংহের বলিষ্ঠ লেখনীতে যেন নারীবাদের সম্প্রসারণ। সত্তর দশকের পাশ্চাত্য প্রভাবিত নারীবাদের বহু আগেই মেয়েদের কথা শুনিয়েছেন তাঁদেরই বয়ানে। “আমি সেই মেয়েটি/ সেই মেয়ে যার জন্মের সময় কোন শাঁখ বাজেনি।/ জন্ম থেকেই যে জ্যোতিষীর ছকে বন্দি। যার লগ্ন রাশি রাহু কেতুর দিশা খোঁজা হয়েছে।” দীপ্ত ভাষায় তাঁর কবিতা বলেছে সেই মেয়েটির কথা যার বাইরের চেহারা সমাজে সুস্থ জীবনের অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়, যে পুরুষতন্ত্রের শিকার।
ষাটের দশকে এলেন বিজয়া মুখোপাধ্যায়, দেবারতি মিত্র, গীতা চট্টোপাধ্যায়, কেতকী কুশারী ডাইসন। কেতকীর কবিতায় চিৎকৃত নারীবাদী স্লোগান নেই। বিজয়াও নারীবাদী তকমায় বাঁধা থাকেননি। দেবারতি ছুঁয়েছেন নারীর সূক্ষ্ম অনুভূতি, মধ্যবিত্ত ভাবনা। বলেছেন— ‘‘আমাকে নিয়মিত সংসারের কাজকর্ম করতে হয়, ব্যাঙ্ক পোস্ট অফিসে যেতে হয়, সামাজিক দায়িত্বও পালন করতে হয়, সেগুলো আমার খারাপও লাগে না। ...কী করে জানি না তারই মধ্যে চলে একটা স্পন্দন— কবিতার আবছা বিচ্ছুরণ, আড়মোড়া ভাঙা, ছেঁড়াখোঁড়া হাসি ও বেদনা। ...বাজার করতে গিয়ে, ডাক্তার দেখাতে গিয়েও পেয়ে যাই কবিতার বীজ। কখনও তা থেকে গাছ জন্মায়, আর কখনও তা বৃষ্টিজলে, অশ্রুতে ধুয়ে যায়, চিহ্নই থাকে না।’’
নকশালবাড়ি, মুক্তিযুদ্ধ, জরুরি অবস্থার সাক্ষী ষাটের শেষ থেকে উত্তাল সত্তর। তারই রেশ মাখা মধ্যবিত্ত জীবনের চিত্রকল্প স্থান পেয়েছে বহু বলিষ্ঠ নারীকণ্ঠে। আশির দশকের কবিতায় প্রচলিত ছন্দ বর্জিত ও টানা গদ্য কবিতার আধিপত্য। সুস্পষ্ট আধুনিকতা, রহস্যময়তা ও মননশীলতার বিভিন্ন রূপ, কুশলী চিত্রকল্পের মাধ্যমে আশির কবিরা ভিন্ন ভিন্ন স্টাইলে মধ্যবিত্তের যাপনকে এঁকেছেন। ঋতুকালে দেবালয়ে প্রবেশাধিকার নেই অথচ হেঁশেল সামলাতে হলে নারীকে কেন অস্পৃশ্য মনে হয় না, সেই ভণ্ডামির বিরুদ্ধে সরব কোনও কবি। আবার কারও লেখনী তথাকথিত নারীবাদী হিসাবে চিহ্নিত না হলেও নারীদের অবস্থান চিহ্নিত করেছে। এই ভাবেই এই দশকের বিভিন্ন নারীকণ্ঠ সপ্রতিভ ভাবে নারীমুক্তির কথা লিখে গেছেন। চার পাশের ধর্ষণ, খুন, নিপীড়নের ঘৃণ্য কালো চিত্র তাঁদের আঁচড়ে ফুটে উঠেছে, তাঁদের কাব্যভাষা পৌঁছেছে সাধারণের ঘরে। নব্বইয়ের দশকে টিভি, কম্পিউটার, ইন্টারনেট, বিশ্বায়ন, মুক্ত বাজার— সার্বিক পরিবর্তনের সামনে দাঁড়িয়ে তাঁরা লিখলেন মধ্যবিত্তের নতুন আশা-আকাঙ্ক্ষা। মুখের ভাষাও কবিতা হয়ে উঠল। নির্মাণ হল উত্তর আধুনিক কবিতার। পূর্বসূরিদের প্রচলিত বিষয়গুলিকে অস্বীকার করলেন, চিরাচরিত কবিতার কাঠামোও ভেঙে গেল ছন্দ ও ছন্দহীনতায়। এই কবিতাগুলি আপাত ঝকঝকে স্মার্ট। বাংলার পাশে হিন্দি, ইংরেজি শব্দ মেশানো। চার পাশে মেয়েরা অক্লান্ত খাটেন মধ্যবিত্ত সংসারে, স্বামী অফিস থেকে ফিরলে তাঁকে খুশি করার কাজে ব্যস্ত থাকেন, স্বামী ভাবেন, স্ত্রীর কাজই নেই বাড়িতে। সেই সংসারের নকশিকাঁথা বোনা হয় নারীবাদ ও মানবিকতার পরশে।
এই ক্রমেই বিশ শতকের নারীভাষ্যে বাংলা কবিতা অন্তর্লোকের মায়াবী জগতে ঢুকে পড়ে। বিভিন্ন দশকে বিভিন্ন বহিঃপ্রকাশ তার। এই মায়াজগতের মতো কবিতার বাঁক ও ভাঙচুর বাংলা কবিতার ইতিহাসে আগে আসেনি। দৈনন্দিন উপলব্ধি, আমজনতার জীবনচর্যার স্বতঃস্ফূর্ত প্রকাশই সেই কবিতায় আধুনিকতার বৈশিষ্ট্য।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy