Advertisement
E-Paper

নাম নেই, শুধুই সংখ্যা

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ব্রিটেনের পাশে ভারতের অবস্থানকে সমর্থন করেছিল মুসলিম লীগ ও হিন্দু মহাসভা দু’পক্ষই।

সাতাশি হাজারেরও বেশি ভারতীয় সেনা বিদেশের মাটিতে প্রাণ দিয়েছেন।

সাতাশি হাজারেরও বেশি ভারতীয় সেনা বিদেশের মাটিতে প্রাণ দিয়েছেন। —ফাইল চিত্র।

সোনালী দত্ত

শেষ আপডেট: ০৪ অগস্ট ২০২৩ ০৫:০২
Share
Save

লস আলামোস-এ আণবিক বোমা বানানোর কাজে ব্যস্ত বিজ্ঞানী ওপেনহাইমারের টিম। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সেই সময়ে বলি হচ্ছিল অগণিত প্রাণ। ভারতীয় সৈন্যরা আরও দুর্ভাগা। নিজেরাই পরাধীন, তবু লড়াই করতে হচ্ছিল অন্য দেশের মানুষের স্বাধীনতার অধিকার রক্ষায়, ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে। পঁচিশ লক্ষ ভারতীয় সৈন্য দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে যোগ দিয়েছিলেন। ইটালি, জার্মানি, বর্মা, সিঙ্গাপুর, হংকংয়ে বীরত্বের স্বাক্ষর রেখেছেন তাঁরা। সাতাশি হাজারেরও বেশি ভারতীয় সেনা বিদেশের মাটিতে প্রাণ দিয়েছেন।

এঁদেরই এক জন নায়েক যশবন্ত ঘাড়গে। ১০ জুলাই, ১৯৪৪। ইটালির রণভূমিতে লড়াই করছিলেন পঞ্চম মরাঠা ইনফ্যান্ট্রির ৯১৯২ নং সৈন্যটি। বম্বে প্রেসিডেন্সির কোলাবা জেলায় জন্ম, বছর তিনেক আগে ‘সিপাই’ হিসাবে যোগদান, ইতিমধ্যে ‘নায়েক’ হয়েছেন। যুদ্ধ এনে দাঁড় করিয়েছে সুদূর প্রবাসে। ছোট্ট বাহিনী নিয়ে আক্রমণ করেছিলেন শত্রুকে, খবর ছিল না যে তাদের রয়েছে শক্তিশালী মেশিনগান। তীব্র আক্রমণে ধরাশায়ী বাহিনীর সকলে, শুধু যশবন্ত ছাড়া। পায়ের তলায় দেশের মাটি নেই, কাছে নেই আত্মীয় পরিজন, মাতৃভূমির জন্য শহিদ হওয়ার স্বীকৃতি, সহযোদ্ধারা পর্যন্ত সঙ্গী নন। তবু দ্বিধা না করে একাই ছুটে এসে গ্রেনেড ছুড়লেন। মেশিনগান ছিটকে পড়ল। কিন্তু নিজের রাইফেলের ম্যাগাজ়িন বদলানোর সময় প্রথম গুলিটা এসে বিঁধল শরীরে। মাটিতে পড়ে গেলেন, গুলিতে ঝাঁঝরা হয়ে গেল দেহ।

ইটালির উপদ্বীপ থেকে যুদ্ধ করে যাঁরা মূল ভূখণ্ডে ঢোকেন, জার্মানদের পরাজয় ও মুসোলিনির পতনের পিছনে যাঁদের প্রত্যক্ষ ভূমিকা, মিত্রপক্ষের সেই সেনাদের কেন্দ্রস্থলে ছিল ভারতীয় বাহিনী। ১৯৪৩ থেকে ১৯৪৫-এর মধ্যে এক বছর ন’মাস তিন সপ্তাহ ধরে এ সব অঞ্চলে তাঁরা শত্রু নিকেশ করে সাধারণ ইটালীয় মানুষকে স্বাধীন জীবন উপহার দেন। চতুর্থ, অষ্টম ও দশম ডিভিশনের পঞ্চাশ হাজার ভারতীয় সৈন্য সে দিন শরিক হয়েছিলেন যুদ্ধে, আহত হন ২৩,৭২২ জন, প্রাণ হারান ৫,৭৮২ জন। মৃত শরীরগুলির উপর সে দিন ইউনিয়ন জ্যাক উড়েছিল। ইংল্যান্ডের রাজা ষষ্ঠ জর্জ ইটালির যুদ্ধে প্রাণ হারানো ব্রিটেনের সেনাদের ‘ভিক্টোরিয়া ক্রস’ দিয়েছিলেন। সেই কুড়িটি ক্রস-এর ছ’টি ছিল ভারতীয় সেনাদের জন্য, নায়েক যশবন্ত ঘাড়গে তাঁদেরই এক জন।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ব্রিটেনের পাশে ভারতের অবস্থানকে সমর্থন করেছিল মুসলিম লীগ ও হিন্দু মহাসভা দু’পক্ষই। জাতীয় কংগ্রেস চেয়েছিল স্বাধীনতা, যার ফসল বিয়াল্লিশের ‘ভারত ছাড়ো’ আন্দোলন। চার্চিল রেগে গিয়ে খাদ্য পাঠাননি বলেই তেতাল্লিশের ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ তথা মন্বন্তর, এমন মতামতও বহুলপ্রচলিত। কিন্তু জীবন-মৃত্যুর ইতিহাস তো লিখতে হয়েছিল সেই সেনাদেরও যাঁরা ব্রিটেনের যুদ্ধের দায় নিজেদের কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন, যুদ্ধ করেছিলেন, প্রাণ দিয়েছিলেন। ইটালির চল্লিশটি সমাধিস্থলে আজও শুয়ে এমন অনেক ভারতীয় সৈন্য। ইটালি এই বীরদের ভুলে যায়নি, ‘মোন্তন’ সম্প্রদায় ও ইটালির সামরিক ইতিহাসবিদদের একটি সংগঠন একত্রে মিলে তৈরি করেছে এক স্মৃতিসৌধ, নায়েক যশবন্ত ও তাঁর মতো বহু ভারতীয় বীরের স্মরণে। বিশিষ্টজনের উপস্থিতিতে এই সৌধের আনুষ্ঠানিক উন্মোচন হল গত ২৩ জুলাই।

এই স্মৃতিসৌধে ভারতীয় সেনাদের স্মরণে একটি ফলক বসানো হয়েছে। স্থাপিত হয়েছে একটি সূর্যঘড়ি, সেখানে এই কথাগুলি লেখা— ‘আমরা সকলে এক সূর্যের নীচে বাস করি’। এক সূর্যের তলায় থেকেও একই রকম বীরত্বের জন্য সমস্বীকৃতি মেলে না সবার। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ নিয়ে অসাধারণ সব চলচ্চিত্র আছে, কিন্তু ভারতীয় সৈন্যদের ভূমিকা নিয়ে ক’টি ছবি তৈরি হয়েছে? এই বীরদের স্মরণে ক’টি স্মৃতিফলক দেখাতে পারে ভারত? দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ভারতীয় শহিদদের নাম আজকের কত জন ভারতীয় জানেন? আজ়াদ হিন্দ ফৌজে নাম লেখানো সেনাদের তবু স্বীকৃতিটুকু ছিল, বাকিরা শুধুই সংখ্যা। বিস্মৃতির আড়ালে নামগুলো পর্যন্ত হারিয়ে গিয়েছে।

প্রাক্তন ব্রিটিশ কমান্ডার ও ফিল্ড মার্শাল স্যর ক্লদ অচিনলেক বলেছিলেন, ব্রিটেন দু’-দুটো বিশ্বযুদ্ধ সামলাতেই পারত না যদি না ভারতীয় সেনা সঙ্গে থাকত। সেই সেনার স্থান এখন ভারতে ইতিহাস বইয়ে ইতিউতি। সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রীর মিশর সফরের বৃত্তান্ত পড়তে গিয়ে জানা গেল, মিশর ও প্যালেস্টাইনেও প্রাণ দিয়েছিলেন বহু ভারতীয় সৈন্য, সুয়েজ় খালে ঢোকার মুখে তিফিক বন্দরে তাঁদের স্মরণে একটি স্মৃতিসৌধ আছে। এমন স্মারক হয়তো ছড়িয়ে রয়েছে বিশ্বের অন্যত্রও, আমরা খবর রাখি না। মা-ভূমি যেন ‘দাসেরে মনে’ রাখেন, সেই আকুল আবেদন জানিয়ে মাইকেল মধুসূদন দত্ত বাংলায় ফিরেছিলেন, কিন্তু এই অভাগা বীরদের জীবনে শমন ‘অমৃত হ্রদ’ হতে পারেনি স্বদেশের মাটির স্পর্শের অভাবে। আমরা কি পারি না তাঁদের বীরত্ব ও দুর্ভাগ্যের ইতিহাসকে আজকের কলমে ফিরে লিখতে?

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

World War II India History

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy

{-- Slick slider script --}}