Advertisement
২২ নভেম্বর ২০২৪
Refrigerator

হিমঘরে জমে নারীর জীবন

বরফ আসত জাহাজে চড়ে সেই আমেরিকা থেকে। ফ্রেডরিক টিউডোর নামে এক আমেরিকান ১৮৩৩-এ প্রথম কলকাতায় বরফ আমদানি করেন।

—প্রতীকী ছবি।

তৃষ্ণা বসাক
শেষ আপডেট: ২৫ জানুয়ারি ২০২৪ ০৮:২৪
Share: Save:

কুটকুটের মুখে ফ্রীজ কথাটা শুনে অবাক লাগল, বেশ লাগল, মজা লাগল... আমার মুখ দিয়ে বড় জোর রেফ্রিজারেটর কথাটাই বের হতে পারে,... ফ্রীজ শুনেছি বইকি, কিন্তু উচ্চারণ করতে কেমন অস্বস্তি। (ফ্রীজ, রমাপদ চৌধুরী)।

মধ্যবিত্ত পরিবারে সে সময় ফ্রিজ আসত হঠাৎ পাওয়া বোনাসের টাকায়, অনেক সুবিধার হাতছানি নিয়ে— মাছ মাংস ফল কিনে রাখলে নষ্ট হয় না, রোজ বাজারের দরকার নেই, বরফ মেলে দ্রুত, অসুখে বরফ তো লাগে, অতিথিকে সন্দেশের বদলে দেওয়া যায় বানিয়ে রাখা পুডিং। সাদা ধপধপে জিনিসটায় ঘর সুন্দর দেখায় ঠিকই, কিন্তু পড়শি, আত্মীয়দের ঈর্ষাও জাগায়। অভাবী মেজদি টাকা চেয়ে পায় না বলে আক্রোশ ঝাড়ে ফ্রিজের উপর— ঠান্ডা কল কিনেছিস, তোদের আবার টানাটানি!

তবে এই সুবিধা কত দিনের আর? আগে একটু বরফের জন্য হাপিত্যেশ করে বসে থাকত এই শহর।

“চৈৎ বৈশাখ মাসে রাস্তায় ফেরিওয়ালা হেঁকে যেত “বরীফ”। হাঁড়িতে বরফ-দেওয়া নোনতা জলে ছোটো ছোটো টিনের চোঙে থাকত যাকে বলা হত কুলফির বরফ, এখন যাকে বলে আইস কিংবা আইসক্রিম।... সেই ডাকে মন কী রকম করত তা মনই জানে।”(ছেলেবেলা, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর)। তাঁর ঠাকুরদা প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর বরফের ব্যবসা করতে চেয়েও করতে পারেননি।

বরফ আসত জাহাজে চড়ে সেই আমেরিকা থেকে। ফ্রেডরিক টিউডোর নামে এক আমেরিকান ১৮৩৩-এ প্রথম কলকাতায় বরফ আমদানি করেন। গরমে হাঁসফাঁস সাহেবরা বরফ এলেই জুড়িগাড়ি হাঁকিয়ে হাজির হতেন।

বরফের কুচি দেওয়া শরবতের জন্য মোগল বাদশারা নাকি দিল্লিতে বরফ আনতেন হিন্দুকুশ পর্বত থেকে। আবুল ফজ়ল আইন-ই-আকবরিতে জানিয়েছেন, আকবরই প্রথম সল্টপিটার বা শোরার সাহায্যে জল ঠান্ডা করার পদ্ধতি ভারতে চালু করেন। হুমায়ুন, আকবর, ঔরঙ্গজেব-সহ প্রায় সব মোগল সম্রাট গঙ্গাজলই পান করতেন, শোরার মাধ্যমে তা ঠান্ডা রাখতেন ‘আবদার’রা। বরফ-সাহেব ফ্রেডরিক টিউডোর কম দামে বরফ বেচে বাজার ধরে নিলেন, তৈরি হল কলকাতার আইস হাউস। স্বামী বিবেকানন্দ শিকাগো বক্তৃতা দিয়ে ফিরে প্রথম ভাষণ দেন চেন্নাইয়ের পুরনো আইস হাউসে, যার নাম হয়ে যায় ‘বিবেকানন্দ হাউস’।

সের প্রতি দু’আনার বরফ সাহেবরা ছাড়া দেশি ধনীই কিনতে পারতেন। বরফ খেতেন গোঁড়া ব্রাহ্মণ, এমনকি বিধবারাও। ছিল বরফের রেশনিং। বেশি বরফ পেতে লাগত ডাক্তারের সার্টিফিকেট। শিল্পী ও লেখক কোলসওয়ার্দি গ্রান্ট জানাচ্ছেন, বাড়িতে বহু ক্ষণ বরফ রাখতে এল আইস চেস্ট। তাতে মাখন থেকে দামি মদ রাখা হত।

মহেন্দ্রনাথ দত্তের কলিকাতার পুরাতন কাহিনী ও প্রথা বইতে আছে এক সময় হুগলিতে গুঁড়ি গুঁড়ি বরফ পড়ত। থকথকে এই বরফের নাম ছিল ‘হুগলি স্লাশ’। তা সাহেবি পার্টির বরফের জোগান দিত। এই বরফ সংগ্রহে সাধারণত মহিলা আবদার নিয়োগ করা হত। এক-একটা ‘ফিল্ড’-এ ছয়-সাত জন মহিলা অর্ধবৃত্তাকার ভোঁতা ছুরি দিয়ে সরা থেকে বরফ কেটে মাটির কলসিতে জমাতেন। বরফ, আইস বক্স, আইস চেস্ট, তার পর ফ্রিজ। হুগলি স্লাশের মতো এখানেও মেয়েদের অবদান। যদিও সূচনা পুরুষের হাতে। ১৭৪০ নাগাদ প্রথম কৃত্রিম রেফ্রিজারেশনের ধারণা প্রকাশ্যে আনেন উইলিয়াম কুলিন। দুগ্ধজাত পণ্য ঠান্ডা রাখতে ১৮০২ নাগাদ টমাস মুর এক রকম আইস বক্স তৈরি করেন। কুলিং সিস্টেমটির নাম দেন ‘রেফ্রিজারেশন’। পরের বছরই তিনি প্রথম ‘রেফ্রিজারেটর’ নামের পেটেন্ট নেন। ১৯১৩ সাল নাগাদ ফ্রেড ডব্লিউ উলফ সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন ব্যবহারের উপযোগী প্রথম বৈদ্যুতিক রেফ্রিজারেটর তৈরি করেন।

কিন্তু আধুনিক বৈদ্যুতিক ফ্রিজের প্রকৃত জননী ফ্লোরেন্স পারপার্টের নাম ক’জন জানেন? আমেরিকার জনগণনায় তাঁর পরিচয় গৃহবধূ, অথচ ১৯০০ সালেই রাস্তা সাফাইয়ের কল তৈরি করে পেয়েছিলেন পেটেন্ট।

তাকে ডিম গুছিয়ে রাখতে রাখতে কি মনে পড়ে লিলিয়ান মোলার গিলব্রেথ-কে, যিনি ফ্রিজের মাখন আর ডিম রাখার ট্রে উদ্ভাবন করেছিলেন? তাঁকে সবাই ডাকত আমেরিকার এঞ্জিনিয়ারিংয়ের ফার্স্ট লেডি। পায়ের চাপে খোলা ময়লাদানিও তাঁরই অবদান। আর আইসক্রিমের কল তৈরি করেন ন্যান্সি জনসন। অর্থাৎ শুধু রান্না নয়, রান্নাঘরের মেশিন অনেকগুলিই মেয়েদের তৈরি। টোস্টার, জিনিসপত্র কেনার কাগজের ব্যাগ সবই।

ফ্রীজ গল্পেই আছে, রাতে আচমকা সাদা ফ্রিজটা দেখে মনে হয় সাদা থান পরা মেজদিই দাঁড়িয়ে আছেন। এই ভাবে মধ্যবিত্তের বাসনার গ্যাজেট কখন যেন অপরাধবোধ হয়ে ঘাড়ে চাপে। ফ্রিজ কেনার জন্য দুঃস্থ আত্মীয়ের কাছে অপরাধী হয়ে থাকতে হত এক সময়, আর আজ ফ্রিজের সাহায্যে অপরাধ ঢেকে রাখা যায়। যাঁরা ফ্রিজের উদ্ভাবনের সঙ্গে জড়িয়ে আছেন, সারা দিনে অজস্র বার ফ্রিজে খাবার ঢোকাতে, বার করতেই সময় যায় যাঁদের, সেই মেয়েদের মৃতদেহ টুকরো করে ঢোকানো হচ্ছে ফ্রিজেই!

অন্য বিষয়গুলি:

Refrigerator Crime
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy