সমর্থন: পঞ্চায়েত ভোটে শাসক দলের জয়ের সংবাদে উচ্ছ্বাসের ছবি, হাওড়া, ১১ জুলাই। পিটিআই।
পঞ্চায়েতে তৃণমূলের বিপুল জয় নিয়ে কোনও সংশয়ই ছিল না। আদালতের আদেশ মান্য, তবে এখনও অবধি যা তথ্য তাতে লোকসভা নির্বাচনের আগে গ্রামবাংলার এই ফলে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বাড়তি স্বস্তিবোধ করবেন, সন্দেহ নেই। সামগ্রিক ভাবে দেখলে তৃণমূল সকল জাতি, ধর্ম, সম্প্রদায়েরই সিংহভাগ ভোট পেয়েছে এবং বিজেপি, সিপিএম, কংগ্রেস সকলকে আরও এক বার একা পর্যুদস্ত করেছে। বর্তমান পরিস্থিতির নিরিখে এটা তাৎপর্যপূর্ণ।
তবে শঙ্কা যেটা ছিল, সেটাও সত্যি হয়েছে। প্রমাণিত হয়েছে, পঞ্চায়েত ভোটে অরাজকতা রোধ করা ‘হল’ না। পরিণামে কতকগুলি প্রাণ গেল। বেশ কিছু জায়গায় অবাধে চলল গুলি, বোমা, সশস্ত্র রাজনৈতিক গুন্ডাদের বুথ দখল, ছাপ্পা, ব্যালট লুট, ভাঙচুর। ভোট সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ রাখতে তৃণমূল নেতা অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের দৃঢ় প্রতিশ্রুতিও এ ভাবেই কার্যত ব্যর্থ হল।
কত হাজার বুথের মধ্যে ‘মাত্র’ ক’টিতে গোলমাল হয়েছে, অথবা মৃতদের মধ্যে শাসক-আশ্রিতদের সংখ্যা কত বেশি, সেই পরিসংখ্যান এ ক্ষেত্রে খুব গুরুত্বপূর্ণ নয়। আর এটাও জানা কথা, শাসক সর্বদা বলবেন সব অশান্তি, হিংসার পিছনে বিরোধীদের প্ররোচনা। বিরোধীরা বলবেন শাসকের।
কিন্তু তাতে সাধারণ লোকের নতুন করে কী আসে যায়! মৃতের প্রাণ ফেরে? আহতের যন্ত্রণা লাঘব হয়? ভোট-গুন্ডারা শায়েস্তা হয়? মানুষের মনে কি নিরাপত্তাবোধ নিশ্চিত করা যায়? রক্ষকের উপর তাদের ভরসা কি কিছুমাত্র বাড়ে? কোনওটাই নয়।
সেই জন্যই সংখ্যাতত্ত্ব এখানে গৌণ। মুখ্য হল বিভিন্ন ঘটনার অভিঘাত। জয়-পরাজয় ছাপিয়ে লোকের মনে তার ছাপ থেকে যায় এবং একটি সাধারণ ধারণা অর্থাৎ ‘পারসেপশন’ দানা বাঁধে। একের পর এক ভোটকেন্দ্রে অস্ত্র উঁচিয়ে দাপাদাপি, ছাপ্পা, ব্যালট লুটের ঘটনা থেকে ভীত-অসহায় ভোট-কর্মীদের কান্না, পাশাপাশি পুলিশের অদ্ভুত নিষ্ক্রিয়তা এবং সর্বোপরি মৃত্যুমিছিল মিলেমিশে সেই ‘পারসেপশন’ আরও দৃঢ় হওয়াটাই স্বাভাবিক। এ বার তো গণনাও অগ্নিগর্ভ!
তাই তাণ্ডবের সাফাই না খুঁজে বরং শুভবুদ্ধিসম্পন্ন সকলের এটা মেনে নেওয়া উচিত যে, শাসক, বিরোধী, নির্বাচন কমিশন, পুলিশ কেউ এই পাপ থেকে মুক্ত নয়। এটাও বোঝা উচিত, তালি কখনও এক হাতে বাজে না।
তৃণমূলের নেতারা কি বুক ঠুকে বলতে পারবেন, ভোট-সন্ত্রাসের কোনও ঘটনায় এই দলের কেউ যুক্ত নয়? পারবেন না। বললেও সেটা মিথ্যাভাষণ হবে। কারণ, সবাই বোঝে, কোথাও ভোট শুরুর এক-দেড় ঘণ্টার মধ্যে সব ভোট ‘পড়ে’ যাওয়ার, কোথাও বা ভোটার আটকে, ভোট-কর্মীদের সন্ত্রস্ত করে, পুলিশ-পাহারাদারদের কাঠপুতুল সাজিয়ে, লাঠি-রিভলভার উঁচিয়ে বুথে ঢুকে কাজ ‘হাসিল’ করার ‘কৃতিত্ব’ একা বিরোধীদের হতে পারে না!
এটা ঠিক, ২০২৩-এর এই পঞ্চায়েত ভোটেই স্মৃতির মতো ফিরে এসেছে কাস্তে-হাতুড়িতে ছাপ্পা মারার দৃশ্য! ক্ষমতায় থাকার সময় তাদের কাছে এটা ছিল জলভাত। কিন্তু দু’দশকের বেশি সময় জুড়ে তৃণমূল রাজত্বে সিপিএম প্রায় প্রান্তিক হয়ে যাওয়ার পরে এ বার এই বিষয়টিও নজর এড়ায়নি।
শুভেন্দু অধিকারীর শাসানি মোতাবেক বিজেপির বাহিনী একাধিক বুথে ঢুকে ব্যালট বাক্স ছিনিয়ে নিয়ে জলে ফেলে দিয়েছে, ছিঁড়ে দিয়েছে, আগুন ধরিয়ে দিয়েছে। আবার ছাপ্পাও দিয়েছে। যেখানে যেমন পেরেছে একই অপকর্ম করেছে কংগ্রেসও। তৃণমূলের সঙ্গে বেশ কয়েকটি সংঘাত হয়েছে সকল বিরোধীর। যার ফলে মৃত্যু তালিকার শীর্ষে খোদ শাসক দল।
তথাপি শাসকের হাতে যে-হেতু রাজদণ্ড এবং আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করার ভার, তাই তার অন্যায় এবং দায় আতশকাচের তলায় সবার আগে আসবেই। এটাও কঠোর বাস্তব। এ নিয়ে তর্ক বৃথা।
প্রথম থেকে অবাধ ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের আশ্বাস শোনার পরেও যে সব ঘটনা ঘটেছে, তাতে সহজ বুদ্ধিতে কী ধারণা তৈরি হয়? এটাই তো মনে হওয়া স্বাভাবিক যে, সামনে যা এল তা হয়তো পুরো ছবি নয়। অ-দেখা, অ-জানা আরও কিছু থাকতে পারে এবং কোথাও কোনও স্তরে দলের প্রশ্রয়ও হয়তো ওই দুষ্কৃতীরা পায়।
পাশাপাশি শাসকের মধ্যে যেন তেন প্রকারেণ জিতে নেওয়ার হিংস্র মনোভাব তৈরি হয় কেন, সেটাও অতি গুরুতর প্রশ্ন। বিশেষ করে এই সরকার তো দৃশ্যত মানুষের আর্থিক ও সামাজিক সুরক্ষার জন্য সদা তৎপর। দরিদ্রতম ব্যক্তিটির জন্যও তার কোনও না কোনও প্রকল্পের দুয়ার খোলা। এগুলি তার প্রচারের অন্যতম হাতিয়ারও বটে।
তার পরেও ভোটে জিততে সেই শাসক দলকে জুলুম-জালিয়াতির আশ্রয় নিতে দেখা গেলে সংশয় জাগে। এটা কি তা হলে তাদের নিজেদের উপর কোনও প্রকার আস্থাহীনতার প্রকাশ? জনগণ কী করবে, বুঝতে না পারার দোলাচল?
কিন্তু ভুললে চলবে না, যে কোনও ভোট-সন্ত্রাসের সঙ্গে সার্বিক আইনশৃঙ্খলাও জড়িত। যে কেউ তা করুক না কেন। সেখানেই শাসকের চাপ। মানুষেরও শঙ্কা।
এ বারের পঞ্চায়েত ভোটে আইনশৃঙ্খলা রক্ষার দিকটি অবশ্য বেশ ঢিলে ও রহস্যাবৃত! এত দিন জেনে এসেছি, ভোটে বুথ ও সংলগ্ন এলাকায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষার মূল দায়িত্ব নির্বাচন কমিশনের। কিন্তু এ বার ঘটনাবহুল, রক্তাক্ত ভোটের পরে রাজ্য নির্বাচন কমিশনার রাজীব সিন্হা জানিয়েছিলেন, তাঁর কাজ নাকি শুধুই ব্যবস্থা করে দেওয়া। কে কাকে গুলি করবে, তা কেউ বলতে পারে না!
যার মর্মার্থ, তিনি কোনও ঘটনার দায় নিতে রাজি নন। যদিও শুধু ‘ব্যবস্থা করেছি’ বলে দায় এড়াতে তিনি পারেন না। কারণ ব্যবস্থা কোথায় কী ভাবে কার্যকর হবে, তার সম্পূর্ণ তদারকিও তাঁর অন্যতম কর্তব্য। ভোটের দিন সকালবেলায় তাঁকে জেলাশাসকদের কাছ থেকে বাহিনী মোতায়েনের তালিকা চাইতে হবে কেন?
অগত্যা এত অঘটনের পরে কমিশনার কবুল করেছেন, কেন্দ্রীয় বাহিনী থাকলে সন্ত্রাসের উপর নিয়ন্ত্রণ থাকে। ঠিক-ভুলের তর্কে যাব না। শুধু প্রশ্ন, তা হলে কেন্দ্রীয় বাহিনী মোতায়েন করা নিয়ে নানা ভাবে এত সময় তিনি নষ্ট করেছিলেন কেন?সব কিছু ঘটে যাওয়ার পরে এখনই বা কেন এই চৈতন্যোদয়?
সার্কাসে সিংহের খেলা দেখেছেন? ঘেরাটোপে লম্বা চাবুক হাতে নিয়ে রিং মাস্টার মাটিতে মেরে শুধু সপাং সপাং আওয়াজ তোলেন। বিরাট আকার সিংহেরা তাতেই লেজ গুটিয়ে বসে পড়ে। নখ-দাঁত দেখানোর হিম্মত আর হয় না। তাদের জন্য চাবুকের ওই ইশারাই যথেষ্ট! সাংবিধানিক পদাধিকারী হিসাবে নির্বাচন কমিশনারের হাতে প্রভূত ক্ষমতা। প্রয়োজনে নখ-দাঁত দেখানোর অধিকারও তাঁর আছে। কিন্তু দেখা গেল, রাজ্যের পছন্দের নির্বাচন কমিশনার রাজীব কেমন যেন ‘নির্জীব’ হয়ে গুটিয়ে রাখার পন্থা নিয়েছেন! এর পিছনেও কি কোনও রিং মাস্টারের ‘অদৃশ্য’ চাবুকের সপাং সপাং সঙ্কেত? সবটা মিলিয়ে সত্যিই এ এক অদ্ভুত বৃত্ত!
আরও একটি বিষয়। এতগুলি প্রাণহানি এবং যথেচ্ছাচারের পরেও নির্বাচন কমিশনারের ভূমিকা নিয়ে তৃণমূলের মুখে গত কয়েক দিনে একটি কথাও শোনা গেল না। নির্বাচন কমিশন তো দল নয়। তৃণমূল শাসক দল না হলে এই পরিস্থিতিতে এ ভাবে নীরব থাকতে পারত কি? বুধবার বিকেলে মুখ্যমন্ত্রী অবশ্য বিরোধীদের নিশানায় রেখে বললেন, ভোট যারা নষ্ট করেছে, কমিশনের তাদের গ্রেফতার করা উচিত ছিল।
সিরাজদ্দৌলা নাটকে শচীন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত লিখেছিলেন, “বাংলার ভাগ্যাকাশে আজ দুর্যোগের ঘনঘটা।” না, এক বারও সে কথা বলব না। কিন্তু বাকিটা বলব, “তার শ্যামল প্রান্তরে আজ রক্তের আলপনা। কে রোধ করবে মরণের অভিযান?”
২০২৩-এর পঞ্চায়েত ভোট কিন্তু সেই প্রশ্ন রেখে গেল।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy