তরুণ পিতা রবীন্দ্রনাথ এক দিন শুনলেন তাঁর শিশুকন্যা ভাইকে বলছে, ‘আমি তোর চেয়ে তিন বছরের বড়ো, তুই আমার চেয়ে দু বছরের ছোটো, তা জানিস!’ বঙ্গীয় জনজীবনে বুড়ো খোকাখুকুদের রেষারেষি আস্ফালন দেখে কথাটা মনে পড়ল। কে কত ভাল কিসে ভাল, অন্যেরাই বা কেন কতটা খারাপ, সবই অস্পষ্ট। গৎবাঁধা আক্রমণ আর প্রতিশ্রুতির আড়ালে শুধু কথার ফুলঝুরি, খিস্তি খেউড়, এ ভেংচায় তো ও কলা দেখায়— হানাহানি খুনোখুনি ছেড়েই দিলাম। পূর্বেকার কাজের হিসেবে সব দলেরই অনীহা, ভবিষ্যৎ নিয়েও পরিকল্পনার বিস্তার নেই।
নেতারা নাহয় বিচক্ষণ মানুষ, বিশদ আলোচনার ঝুঁকি নেন না; কিন্তু আমরা? সকলেই বলছি এই নির্বাচনের অসীম গুরুত্ব, রাজ্যের ভোল পাল্টে যেতে পারে। অথচ, তা নিয়ে গুরুতর বিতর্ক-বিবেচনার লক্ষণ কই? বৌদ্ধিক ভাবে এত অসার, স্লোগান-টিপ্পনী-মশকরাসর্বস্ব যাত্রার ঢঙে নির্বাচনী পালা পশ্চিমবঙ্গে আগে দেখেছি কি? সংবাদমাধ্যম জানে, সিরিয়াস পসরার বাজার নেই। সংবাদপত্রে খানিক সমীক্ষা-বিশ্লেষণ থাকে, নেতাদের ডায়ালগ আর দলবদলের ধারাবিবরণীর ফাঁকে। বৈদ্যুতিনমাধ্যমের চটুলতা প্রায় সর্বাত্মক। অন্য দেশে রাজনৈতিক পর্যবেক্ষণ করেন রাজনীতিক নন, নিরপেক্ষ ভাষ্যকারেরা। আমাদের চ্যানেল জেঁকে থাকেন দলীয় মুখপাত্রের ঝাঁক; বিভিন্ন মাত্রায় যুক্তি তথ্য ভব্যতা জলাঞ্জলি দিয়ে তাঁদের একটাই চিৎকৃত প্রতিপাদ্য: তাঁদের দলে সবাই দেবদূত, অন্যেরা ঘোর পাপী। আমরা নির্লিপ্ত চিত্তে কাজিয়া শুনি, পড়শিরা যেমন কলতলার কোন্দল দেখে। এ-দিকে সমাজমাধ্যমের স্বাভাবিক লঘুতা ভারতবাসীর রাষ্ট্রবিলাসে নতুন মাত্রা পেয়েছে। এক দিকে দলপুষ্ট ট্রোলবাহিনী ভুয়ো তথ্যে বিভেদ-বিদ্বেষের প্রলেপ লাগিয়ে কিস্তিমাত করছে; আরও নিরেস ও প্রায়ই কুৎসিত ভাষায় সমর্থন জানাচ্ছেন সাধারণ নাগরিক। এই পরিবেশে সুস্থ বিতর্কের আশা নেহাত পাগলামি।
যাঁদের জীবনের লড়াইটা প্রবল (অতিমারির পর তাঁদের সংখ্যা যথেষ্ট বেড়েছে), এমন বিতণ্ডায় তাঁদের রুচি নেই, সময়ও নেই। বাঁচার তাগিদে তাঁদের বাস্তব সিদ্ধান্ত নিতে হয়। তা ভ্রান্ত হতে পারে, নিষ্ফল হতে পারে দুর্বৃত্তের রক্তচক্ষুতে। কিন্তু নির্বাচনের গুরুত্ব তাঁরা ভোলেন না, মজেন না অসার প্রচারের ফাজলামিতে। উন্নয়নে তাঁদের কী উপকার হয়েছে, চুরি আর তোলাবাজিতে কতটা বঞ্চনা হয়েছে, সে হিসাব নিজেরাই চুপচাপ কষেন— অবশ্যই প্রত্যেক পঞ্চায়েতে, হয়তো প্রত্যেক পরিবারে আলাদা ভাবে।
বরং সম্পন্ন শিক্ষিত শ্রেণিরই ভ্রান্তিবিলাসের প্রবণতা। এঁদের তলিয়ে ভাবার ক্ষমতা আছে, অবকাশ আছে, বলা যায় দায়িত্বও আছে। এঁরা বিলক্ষণ জানেন, অতিমারির আগে থেকেই ভারতের অর্থনীতি নিম্নমুখী, দরিদ্রের জীবনে শম্বুকগতিতে উন্নতি স্তব্ধ, এমনকি বিপরীতগামী। দেশ জুড়ে যেটুকু কর্মসংস্থান, তা খুচরো অনিশ্চিত ‘গিগ ইকনমি’র রূপ নিচ্ছে। অতএব যা-ই স্বপ্ন ফেরি হোক, বাস্তবে কর্মসংস্থান কোন পথে যাবে? যে পরিযায়ী শ্রমিকেরা চরম দুর্দশায় ঘরে ফিরলেন, তাঁদের ভবিষ্যৎ কী? এ চিন্তা কেবল তাঁদের নয়, আমাদের সকলের। গোটা রাজ্যের আর্থিক ভবিষ্যৎ এর সঙ্গে জড়িত।
ভাবতে হয় আরও কিছু কথা। বাংলায় মানুষ কেমন বেঁচেবর্তে আছেন? আটপৌরে খাওয়া-পরা, শিক্ষা-স্বাস্থ্য, সামাজিক নিরাপত্তা— যে ক্ষেত্রগুলি একত্র মানবিক বিকাশের সূচক, তাদের অবস্থা কী? উত্তরটা মিশ্র— উদ্বাহু হওয়ার মতো নয়, নস্যাৎ করারও নয়। পশ্চিমবঙ্গ আজও ভারতের দরিদ্রতর রাজ্যের একটি। তার কিছু কারণ ঐতিহাসিক, কিছু পূর্ববর্তী তথা বর্তমান শাসকের অবদান। অন্যান্য রাজ্যের সঙ্গে তুলনা কিন্তু প্রত্যাশিত ছকে নয়। বাংলার অগ্রগতি কখনও দেশের পুরোভাগে (ছোট ও মাঝারি শিল্প, কন্যাশ্রী প্রকল্প); কখনও নাটকীয় না হলেও সন্তোষজনক (মাথাপিছু আয়বৃদ্ধি, শিশুদের সার্বিক কল্যাণ); কখনও শোচনীয়। সফল রাজ্য হিসেবে যেগুলিকে তুলে ধরা হয়, তাদের খতিয়ানও কিন্তু মোটেই ভরপুর উজ্জ্বল নয়। পুরো ছবিটা বিক্ষিপ্ত, বহুমুখী; বিশেষত আর্থিক বিকাশের সঙ্গে মানবিক বিকাশের যোগ মোটেই সরল নয়। বৃহৎ শিল্প প্রতিষ্ঠায় বাংলার ব্যর্থতা মানতেই হয়, কিন্তু বিচার করতে হয় এই বৃহত্তর প্রেক্ষিতে।
শিক্ষাক্ষেত্রে দীর্ঘকাল কেন্দ্র রাজ্য সব সরকারের কীর্তি হতাশাব্যঞ্জক। কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়গুলির আজ যে বিপর্যয়, রাজ্যের শাসকেরা সাত বছর আগে স্বক্ষেত্রে তেমন নজির রেখেছেন। বাংলার সরকারি স্কুলব্যবস্থায় ভবনের উন্নতি হয়েছে, শিক্ষকের চূড়ান্ত অভাব। অধিকাংশ রাজ্যে তথা কেন্দ্রীয় শিক্ষায়তনেও কিন্তু এই অবস্থার উনিশ-বিশ রকমফের। নয়া জাতীয় শিক্ষানীতির গালভরা দাবির আড়ালে ব্রাত্য সমাজের শিশুর জন্য জলমেশানো শিক্ষা ধার্য আছে, আছে অধিকাংশ উচ্চশিক্ষাকেন্দ্রের পরিকল্পিত অবনমন। যে-যে মৌলিক উন্নতির প্রতিশ্রুতি আছে (যেমন অঙ্গনওয়াড়ির আমূল রূপান্তর) বাজেটে তার কোনও সংস্থান নেই। স্কুলশিক্ষায় কেন্দ্রীয় বরাদ্দ কমেছে, বরাদ্দ কমেছে অঙ্গনওয়াড়ি-সহ নারী ও শিশুকল্যাণে। শিশুদের প্রাতরাশ দেওয়ার অর্থ নেই; তার আড়াই গুণ টাকা কিন্তু খরচ হবে নতুন সংসদ ভবন, প্রধানমন্ত্রীর প্রাসাদ ইত্যাদি নির্মাণে।
আরও নানা ধন্দ থেকে যায়। যাঁদের মূলমন্ত্র ‘এক দেশ এক ভাষা’, বাংলা (বা তামিল বা মালয়ালম) সাহিত্য-সংস্কৃতির প্রতি তাঁদের অনুরাগ ভোট মিটলে টিকবে তো? বাংলা-সহ যে-যে রাজ্যে সড়ক উন্নয়নের দরাজ বরাদ্দ, প্রত্যেকটিতেই নির্বাচন আসন্ন; তবে কি আগামী চার বছর কিছু জুটবে না? মানতেই হয়, বাংলায় রাজনৈতিক হিংসার ঐতিহ্য প্রবল ও লজ্জাকর। এর দায় সব দলের; শাসক দলের সবচেয়ে বেশি, শাসক বলেই। কিন্তু এ নিয়ে ভিন্রাজ্যের যে আগন্তুকেরা বিলাপ করছেন, হিংসা বিভেদ নারী নির্যাতনে তাঁরা তো স্বভূমিতে বিশ্বখ্যাত।
স্বাভাবিক অবস্থায় এত যুক্তি-প্রতিযুক্তি নিয়ে জোর বিতর্ক হওয়ার কথা, বিশেষত বাংলার মুখর সচেতন সুশীল সমাজে। তার লেশমাত্র নেই কেন? কারণটা হয়তো বাঙালি সমাজের এক নতুন বিবর্তনে। দেশভাগের পর কয়েক দশক মধ্যবিত্ত বাঙালির জীবন ছিল অস্থির অনিশ্চিত। আজ তাঁদের অন্তত একটা অংশে স্থিতিশীলতা এসেছে, সেই সঙ্গে এসেছে আত্মতুষ্টি। এঁদের অবচেতন ভরসা, কোনও নির্বাচনেই তাঁদের তেমন কিছু এসে যাবে না। প্রচুর সুবিধা ও কিছু উপদ্রব নিয়ে তাঁরা মোটের উপর একই ভাবে থাকবেন, উদার অর্থনীতি ও বিশ্বায়নের কল্যাণে কিঞ্চিৎ শ্রীবৃদ্ধিও ঘটবে। আর কী চাই?
ইংরেজিতে এই মানসিকতাকে বলে ‘আই অ্যাম ওকে, ইউ আর ওকে।’ তুমি আমি দিব্যি আছি, অপরের হাল নিয়ে মাথাব্যথা কেন? ‘ওরা’ আমাদের মতো নয়, গোষ্ঠীবিশেষ তো রীতিমতো দু’চক্ষের বিষ, জব্দ হলেই ভাল। আমাদের শ্রেণি-আধিপত্য আরও কায়েম হবে, সস্তায় পরিষেবা মিলবে, মিউচুয়াল ফান্ডে লাভও হয়তো বাড়বে দু’পয়সা।
শহুরে সম্পন্ন শ্রেণির এই সুপ্ত (বা ক্রমশ ভীতিপ্রদ ভাবে সরব) অভিলাষের সঙ্গে ব্যাপক রাজ্যবাসীর সামনে মেলে-ধরা নির্বাচনী স্বপ্নবিলাসের বড় সম্বন্ধ নেই, দুটো বরং পরস্পরের বিপরীত। পরীক্ষার পালা এলে এক পক্ষকে ঠকতেই হবে— সম্ভবত যারা চিরকাল ঠকে এসেছে তাদেরই। তার পরবর্তী ক্রোধ আর সংঘাত কী করে এড়াব, আদৌ ভাবছি কি? এক বৃহৎ প্রতিবাদী ধারা আজ রাজধানীর পরিপার্শ্ব থেকে দেশভর ছড়িয়ে পড়ছে, ঢুকেছে বাংলার নির্বাচনী চত্বরেও। গত বছর দেখা গিয়েছিল আর একটা ভারতব্যাপী আন্দোলন। শ্রেণিতে-শ্রেণিতে, সম্প্রদায়ে-সম্প্রদায়ে বিভেদ ও বৈষম্য দেশ জুড়ে পরিকল্পিত ভাবেই তুঙ্গে উঠছে। বাংলার অতি বিশেষ সামাজিক পটভূমিতে তার কী পরিণতি হবে? কথাটা না ভাবলেই নয়, উচ্চবর্গীয়দের নিজস্ব শ্রেণিস্বার্থেই নয়।
একটা শেষ চিন্তা। যেমন পরাধীন তেমন স্বাধীন ভারতে কণ্ঠরোধের অপচেষ্টা জনজীবনের চিরাচরিত অঙ্গ, কিন্তু আজ তা আতঙ্কের মাত্রায় পৌঁছেছে। ফলে, যারা জেলে পচছে তারা অবশ্যই উড়নচণ্ডী রাষ্ট্রদ্রোহীর দল, ধর্মভীরু দেশভক্তের চিন্তা নেই। তবু, আমাদের আত্মলিপ্ত মৌনের আড়ালে কি একটা ভয় লুকিয়ে আছে? আছে আমাদের স্বাধীন সত্তার সতর্ক সঙ্কোচন, ফলে একটা অস্বস্তি, আত্মগ্লানি?
আত্মতুষ্টির আড়ালে এই যে সুপ্ত ভীতি, তা কেবল ভবিষ্যতের ভূত নয়, বর্তমানের জুজু। আমাদের মগজের মধ্যে জুজুটা গোকুলে বাড়ছে। এটাও ভাবার বিষয়। অনেক কিছু নিয়েই না ভাবলে আমাদের চলবে না। নইলে মার্ক্সের আপ্তবাক্য উল্টিয়ে, সাম্প্রতিক ইতিহাসের যে প্রবণতা আমরা লঘু বিচারে প্রহসন বলে উড়িয়ে দিচ্ছি, সেটাই হয়ে উঠবে বিষম ট্র্যাজেডি।
ইমেরিটাস অধ্যাপক, ইংরেজি বিভাগ, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy