Advertisement
২১ ডিসেম্বর ২০২৪
‘কী হবে কবিতা লিখে? এই পদ্য, এই হাতছানি?’
poet

ঘুমিয়ে থাকা ভলক্যানো

এখন তো যশখ্যাতি হয় না, হয় ‘ট্রোল’। কে কত ট্রোল্‌ড হলেন, কাকে নিয়ে কত অসভ্য ‘মিম’ বেরোল, তাঁর গরল ও গৌরব বুকে নিয়ে কবিরা ঘুরে বেড়াবেন।

নির্জন জানলাই কবির নিয়তি।

নির্জন জানলাই কবির নিয়তি। প্রতীকী ছবি।

সুবোধ সরকার
শেষ আপডেট: ০১ এপ্রিল ২০২৩ ০৪:৪০
Share: Save:

দু’হাজার ষাট বছর আগে সিসেরোকে হত্যা করা হয়েছিল তাঁর হাতের জন্য। তাঁর মৃতদেহ থেকে হাত কেটে আনা হয়েছিল রোমে। যে হাত দিয়ে লিখে তিনি এক রাজাকে ফেলে দিতেন, এক রাজাকে তুলে আনতেন। তাও তিনি তত কবি ছিলেন না যত বড় চিন্তক ছিলেন, যত বড় বাগ্মী ছিলেন। আর এখানে জিভ কেটে নেওয়া হয়েছিল একটি তরুণীর, কবিতা বলার জন্য।

জোধপুরের কবি খাবার টেবিলে আমাকে ফিসফিস করে বললেন, “আমি হিন্দু হয়ে উর্দুতে লিখি বলে ওরা আমাকে ঘৃণা করে। আমার ছেলে সেও উর্দুতে লেখে, সেও আমার মতো ঘৃণার শিকার। আমি যে ভাষায় সহজ আমি সেই ভাষায় লিখব।” বিশ্ব কবিতা দিবস মানে সমস্ত ভাষার কবিতাকে উদ্‌যাপন করব। কারও হাতে লাঠি থাকতে পারে, লেঠেল দিয়ে কবিতা লেখা যায় না।

সন্ত কবি তুকারামকে (যাঁর কবিতা রবীন্দ্রনাথও অনুবাদ করেছিলেন) শূদ্র বলে কবিতা লিখতে দেয়নি। তুকারামের কবিতা জলে ফেলে দিয়েছিল। কিন্তু কথা হল, কবিতার পাণ্ডুলিপি জলে ফেলে দিলেই, কবিতা ডুবে যায় না।

কোনও ভাষা ছোট নয়। হয়তো এই মুহূর্তে ককবরক কিংবা হো ভাষায় লেখা হচ্ছে ফরাসি কবিতার চেয়েও উন্নততর কবিতা। এক-একটা ছোট ভাষা লাফ দিয়ে বড় ভাষা হয়ে ওঠে যেমন ইংরেজি এক দিন শেক্সপিয়রের কাঁধে উঠে আকাশ ছুঁয়েছিল, বোদলেয়ারের হাত ধরে ফরাসি, কিংবা রবীন্দ্রনাথকে ধরে বাংলা। আপনি আলেকজ়ান্দ্রিয়ার লাইব্রেরি পুড়িয়ে দিতে পারেন, কিন্তু মানুষের মন থেকে কবিতা ডিলিট করে দিতে পারেন না। কম্পিউটার মুছে যায়, মানুষের মন মুছে ফেলা যায় না। আজ থেকে সত্তর বছর আগে নিউ ইয়র্কের রাস্তায় বিরাট একটা বিলবোর্ডে একটা কবিতা ভেসে উঠত, ‘ইউএসএ/ হ্যয়ার/ লিবারটি ইজ় আ স্ট্যাচু’— এই ছ’টি শব্দের কবিতাটি হয়ে উঠেছিল আমেরিকার ইতিহাস। নিকানোর পাররা-র এই কবিতা যে এক বার পড়েছে, সে ভুলতে পারবে না। আমরা দুঃখ পাই যখন দেখি বাংলা ভাষার দু’পাশে দু’টি ভাষাকে ধ্রুপদী সম্মান দেওয়া হয়, বাংলাকে দেওয়া হয় না। অন্য ভাষা সম্মানিত হলে, আমরাও সম্মানিত হই, কিন্তু বাংলাকে দেওয়া হবে না কেন? প্রাক্-চর্যাপদ কাল থেকে গত কাল পর্যন্ত পথে-পথে যে মোহর ছড়ানো বাংলা কবিতায়, সেই বাংলাকে ধ্রুপদী ভাষা করতেই হবে। শুধু কবিতার জন্যই বাংলাকে ধ্রুপদী বলে ঘোষণা করা যায়।

এখন তো যশখ্যাতি হয় না, হয় ‘ট্রোল’। কে কত ট্রোল্‌ড হলেন, কাকে নিয়ে কত অসভ্য ‘মিম’ বেরোল, তাঁর গরল ও গৌরব বুকে নিয়ে কবিরা ঘুরে বেড়াবেন। এ রকম একটা সমাজ আমরা নির্মাণ করে গেলাম। কিচ্ছু পাওয়া যাবে না তবু কবিরা কবিতা লেখেন জীবন দিয়ে, এই বলিদান ও বৈভবকে সম্মান জানাতে বিশ্ব কবিতা দিবস। বলিদান শুধু বাংলাতে নয়। সব দেশেই। তবে ইউনেস্কো পঁচিশে বৈশাখকে কবিতা দিবস করতে পারত, কোনও আধুনিক কবির জন্মদিন এ ভাবে পালন হয় না কোথাও। এশিয়ার দিকে তাকাতে পারত ইউনেস্কো।

রেখে গিয়েছেন কয়েকটি কবিতা। তারাই সন্তান, তারাই আগুন দেবে মুখে (রমেন্দ্রকুমার আচার্য চৌধুরী)। কবিতা কোন কাজে লাগে? ভাগ্যিস কবিতা ছিল তাই তো প্রাচীন ভারতের ইতিহাস খুঁজে পেলাম আমরা। কবিতা ছিল তাই ইনকা সভ্যতার কথা জানতে পেরেছি। কবিতা ছিল তাই ‘গিলগামেশ’ উঠে এল হাতে। কবিতা কোন কাজে লাগে? এই প্রশ্নের একটা আন্তর্জাতিক উত্তর আছে— কবিতা কান্নার সময় লাগে। কবিতা আনন্দে লাগে। গ্রিসে গিয়েছিলাম কবিতা পড়তে। একটি আলোচনার বিষয় ছিল, ‘ডাজ় পোয়েট্রি ম্যাটার’? চিলির কবি চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, “ইয়েস, ইট ডাজ়, যে দিন কবিতা থাকবে না, সে দিন পৃথিবীতে আমরা কেউ থাকব না।” মায়ানমারের তরুণী কবি, সদ্য জেল থেকে বেরিয়ে এসেছেন, ফুটছেন, তিনি বললেন, “কবিকে জেলে ঢোকাতে পারেন আপনারা, আপনাদের হাতে জুন্টা, কিন্তু কবিতাকে জেলে ঢোকাতে পারবেন না।” রাশিয়ার কবি বললেন, “আমার কাছে জল যতটা জরুরি, জ্যোৎস্না যতটা জরুরি, কবিতা ঠিক ততটাই জরুরি।” আমি বললাম, এক বিন্দু চোখের জলের মতো নিখুঁত আর সুন্দর একটা কবিতা যে দিন লিখতে পারব সে দিন আমার কবিতার হাতেখড়ি হবে। গত চল্লিশ বছর ধরে প্রতিটা সকালে তিন ঘণ্টা ধরে বসে থেকেছি কবিতার জন্য। চল্লিশটা বছর ব্যর্থ হল জেনেও একটা কবিতার জন্য কাল সকালেও আমি তিন ঘণ্টা বসে থাকব।

গ্রিসে যেমন, তেমনই এখানেও। রাশিয়াতে যেমন তেমনই লাটিন আমেরিকাতেও। পাকিস্তানে যেমন তেমনই কেরলেও— কবিতা হল ‘রেজিস্ট্যান্স’। আর কবিরা হলেন গুপ্ত সমিতি। কবিতা হল সেই গোলাপ, যার ভিতরে লুকানো থাকে বুলেট। ‘গোলাপের গোয়ের্নিকা’ শেষ হয়ে যায়নি। সোভিয়েটে যখন কবি লেখকদের বলে দেওয়া হচ্ছে ‘ইউ ডু নট এগ্‌জিস্ট ফ্রম টুমরো’, তখন এক জন নারী লিখে চলেছেন মহৎ এক কবিতা, কবিতার নাম ‘রিকোয়ায়েম’, কবির নাম আনা আখমাতোভা। কবিতার বিষয় স্তালিনের অত্যাচার। তিন দশক ধরে লিখে চলেছেন একটি কবিতা। একটি এলিজি। লিখছেন আর পুড়িয়ে ফেলছেন। কিন্তু কবিতাটাকে বাঁচিয়ে রাখার একটা প্রাচীন পদ্ধতি নিলেন। নিজের ঘনিষ্ঠ বৃত্তে এক-এক জনকে দিয়ে এক-একটা স্তবক মুখস্থ করিয়ে রাখলেন। স্তালিনের লোকেরা খুঁজে পেল না সেই কবিতা। সেই কবিতা এক দিন পৌঁছে গেল আমেরিকায়। লুফে নিল সারা পৃথিবী। দেশে-দেশে পাঠ্য হল, হল না পশ্চিমবঙ্গে।

সোভিয়েট থেকে এক বার বাড়ির পাশে যদি তাকাই মণিপুরে। সেখানেও এক জন নারী লিখছেন— “মা ফিরে আসছে আজ/ পাহাড় ডিঙিয়ে/ মা ফিরে আসছে আজ/ উপত্যকা পার হয়ে/ উঠোনে এসে পিঠ থেকে ঝুড়ি নামাল মা/ আমরা ছুটে গেলাম দেখতে/ ঝুড়িতে কী খাবার আছে আমাদের জন্য/ ঢাকনা খুলে দেখলাম/ ঝুড়ির ভিতর বসে রয়েছেন আমাদের বাবা।” এই যে পুরুষতন্ত্রকে পিঠে করে মেয়েরা পাহাড়ের নীচ থেকে উপরে উঠে আসছে, এখানেই এক জন মণিপুরের মা সারা পৃথিবীর মা হয়ে উঠলেন। এখানেই মণিপুর আর আমেরিকার এড্রিয়ান রিচ এক হয়ে গেলেন।

আমাদের স্বর্গ নেই, স্যারিডন আছে (ভাস্কর চক্রবর্তী)। বাংলা কবিতায় সব রকমের অহঙ্কার আছে— প্রতিবাদ আছে। রেজিস্ট্যান্স আছে। বিষণ্ণতা আছে। শোক আছে। ভায়োল্যান্স আছে। বিপ্লব আছে। প্রতি-বিপ্লব আছে। এক ঘড়া মোহর নিয়ে আমরা বসে আছি। বাংলা কবিতাকে ধানবাদ ছাড়িয়ে ভারতবর্ষে ঢুকতে হবে। তার পর ভারত মহাসাগর পেরিয়ে ভূমধ্যসাগর পেরিয়ে ইউরোপে ঢুকতে হবে। এখন তো ইন্টারনেটের যুগ। এক ঠোকায় এক জন কোচবিহার থেকে পৌঁছে যেতে পারেন ক্যালিফোর্নিয়ায়। দরকার অনুবাদ। বাংলা কবিতার অনুবাদ নেই। যা আছে তা মোহরের যোগ্য নয়। যদি যোগ্য অনুবাদ থাকত সুভাষ-নীরেন-বীরেন-শঙ্খ-সুনীল-শক্তি-বিনয়-উৎপল-অলোকরঞ্জনের, তা হলে গত পঞ্চাশ বছরে বাংলা কবিতার ঘরে অন্তত আর একটি নোবেল আসত। নোবেলের থেকেও বড় ব্যাপার যেটা হত রবীন্দ্রনাথের পর ইউরোপে বাংলা কবিতার প্রবেশদ্বার খুলে যেত। কে করবে অনুবাদ? মাতৃঋণ শোধ করতে? পেরেছেন তো গায়ত্রী চক্রবর্তী স্পিভাক। মহাশ্বেতা দেবীকে স্টকহোম পর্যন্ত পৌঁছে দিয়েছিলেন। পেরেছেন ক্লিনটন বি সিলি, শিকাগো থেকে এসে বরিশালে বসে জীবনানন্দকে অনুবাদ ও আবিষ্কার করেছেন, লিখেছেন অসামান্য বই আ পোয়েট অ্যাপার্ট। এ রকম আর একটা বই হল না গত চল্লিশ বছরে।

বাবা আমার হাতটা ধরো (বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায়)। রাস্তার ওপারে গিয়ে ছেলে বাবার নামে কুৎসা করছে। বাংলা কবিতায় এখন ছোট-ছোট শিবির, এক জন এক শিবিরে দয়া নিয়ে আর এক শিবিরে গিয়ে দেখাচ্ছে কত বড় বিপ্লবী। কবিতার কোনও মহত্তম আন্দোলন নেই। লড়াই নেই। ভাষা নিয়ে লন্ডভন্ড নেই। সারাক্ষণ শুধু এ কোথায় গেল আর ও কোথায় গেল। একশোটা কবি সম্মেলনে ডাক পাওয়ার চেয়ে একটা স্মৃতিধার্য লাইন লিখতে পারলে আত্মা অনেক বেশি পরিষ্কার হয়, সেটা ঘরে বসে লিখতে হয়। আপনার পুরস্কার আপনার জন্য তোলা আছে, কেউ নেবে না।

কবিতা লিখতে হয় একা। নির্জন জানলাই কবির নিয়তি। একটা নির্জন জানলা কাঁপিয়ে দিতে পারে একটা রাষ্ট্রকে। পাবলো নেরুদা পেরেছেন। রবীন্দ্রনাথ পেরেছেন, এখনও তিনি হিরণ্ময় উনুন। পেরেছেন অ্যালেন গিনসবার্গ। ওক্তাভিয়ো পাজ়। আমার বিশ্বাস বাংলা কবিতা ঘুমিয়ে থাকা ভলক্যানো। আমরা নতুন উদ্গীরণের অপেক্ষায়।

অন্য বিষয়গুলি:

poet Poem
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy