Advertisement
০৫ নভেম্বর ২০২৪
Ramadan Month

মহাকাব্য লেখে ইবাদতের মাস

রমজান শুরু হতেই ফলের দাম আগুন। ছোলা-খেজুর-শরবতের বাইরে যাওয়ার সাধ্য সকলের নেই। এর মধ্যেই কেউ ও-বাড়ির শিশুর হাতে ফলমূল পাঠিয়ে দিয়েছেন।

A Photograph of an Iftar Party

জনাপাঁচেক মানুষ এক সঙ্গে খেজুর দিয়ে ইফতার শুরু করলেন। ফাইল ছবি।

সেখ সাহেবুল হক
শেষ আপডেট: ১৮ এপ্রিল ২০২৩ ০৫:০৬
Share: Save:

খাঞ্চা অর্থাৎ বড় থালায় সাজানো ফলমূল। কাচের গেলাসে শরবত। রোজাদারদের সমবেত দোয়ায় সুখ-সমৃদ্ধি-সুস্থতার কামনা উচ্চারিত হচ্ছে। সাঁঝের বাতাসে ভেসে এল মাগরিবের আজান, “আল্লা হু আকবর আল্লা…।” অপেক্ষার অবসান। জনাপাঁচেক মানুষ এক সঙ্গে খেজুর দিয়ে ইফতার শুরু করলেন। প্রায় প্রতি দিনই আমন্ত্রিত থাকেন কেউ না কেউ। মহিলামহলেও এমন দাওয়াতের রীতি রয়েছে— রোজকার সাংসারিক জীবনের ব্যস্ততার বিরতিতে মহিলাদের নিজস্ব আড্ডা এবং আলাপচারিতার পরিসর।

রমজান শুরু হতেই ফলের দাম আগুন। ছোলা-খেজুর-শরবতের বাইরে যাওয়ার সাধ্য সকলের নেই। এর মধ্যেই কেউ ও-বাড়ির শিশুর হাতে ফলমূল পাঠিয়ে দিয়েছেন। শিশুটির চোখে ভাসছে আপেল-আঙুর-নাশপাতি খাওয়ার ইচ্ছা। রহমত এসেছে প্রিয় ফল নিয়ে। তবু অপেক্ষা, সংযম— কখন ইফতারের সময় হবে, আর আব্বা-মায়ের সঙ্গে খাবে। আগে খেলেও তাকে কেউ আটকাবে না, তবু এক সঙ্গে খাওয়ার সুখ সে জেনে গেছে!

চারিদিকে দাওয়াতের আবহে কর্মক্ষেত্রে, হস্টেলে, মেসে মুসলমান বন্ধুটির সঙ্গে ইফতারে জুটে যান অন্যরাও। সেক্টর ফাইভের কোনও অফিস থেকে শুরু করে বাংলার প্রতিটি প্রান্তে এই সংস্কৃতি নীরবে রক্ষিত হয়। গ্রামের চিরন্তনী ইফতারের পাশাপাশি কাবাব-হালিমের শহুরে আদব। সমাজমাধ্যমে পারস্পরিক খুনসুটি— “কী রে, ইফতারে ডাকবি না?” উত্তর আসে: “পুজোয় তো ভুলে গিয়েছিলি।” এই পর্ব পেরিয়ে অফিস-ফেরত জ়াকারিয়া স্ট্রিটের খাদ্য অভিযান। অনেকেই হয়তো খেয়াল করছেন, অপরিচয়ের গণ্ডি ভেঙে ইফতার ক্রমশ ঢুকে পড়ছে সাংস্কৃতিক সর্বজনীনতায়।

গ্রীষ্মপ্রধান দেশে কৃষক-শ্রমিকের রমজান আল্লার পরীক্ষার বাইরেও আলাদা পরীক্ষা। আর্থিক ভাবে সচ্ছল মানুষের তুলনায় সারা দিন রোদে কাজ করা ব্যক্তি, বাড়ি থেকে দূরে থাকা পরিযায়ী শ্রমিকের উপবাস অধিক কষ্টকর। তবু জীবন তার পথ ঠিক খুঁজে নেয়। সামর্থ্য অনুযায়ী চাঁদা তুলে ইফতার আয়োজনে নানা শ্রেণির মানুষের কাছে খাদ্যসামগ্রী পৌঁছয়। ভিন্ন ভিন্ন প্রদেশের মানুষ এক সঙ্গে জড়ো হন রমজানি তাগিদে। ইফতারের মেহফিলে অবশ্য ধনী-দরিদ্র, উচ্চবিত্ত-নিম্নবিত্তের ফারাক নেই। এক সঙ্গে বসে ইফতার কিংবা এক কাতারে তারাবির নমাজ— যিনি যত বিত্তশালী বা মর্যাদার অধিকারী হোন, এক কাতারে আসতে হবে।

রমজানের দানধ্যানে ফিতরার ভরসায় থাকেন নিম্নবিত্ত, অভাবী মানুষরা। ফিতরার দান এবং উচ্চবিত্তের প্রদত্ত জাকাতের মাধ্যমে অভাবী মানুষের হাতে সম্পদ যায়। ‘বাবু একটা ফিতরা দিবে?’— বলে পৌঁছে যান যে বৃদ্ধা, ফিতরা তাঁর হক। ধর্মের বিধান মানলে নিয়মমাফিক জাকাত-ফিতরা দিতেই হবে। রমজান ব্যবসারও ক্ষেত্র— যেখানে নানা ধর্মের মানুষ একে অন্যের উপর পেশাগত ভাবে নির্ভরশীল। নতুন পোশাক, লাচ্ছা-সিমুই-ফল-আতরের রুটি-রুজিতে সম্মিলিত বেঁচে থাকা। অস্থায়ী তেলেভাজার দোকানে মানুষের ভিড়।

রমজান ফুরিয়ে ইদের দিন ক্রমশ এগিয়ে আসে। ভিনরাজ্যে কর্মরত মানুষের অপেক্ষা তীব্র হয়। বাড়ে অভাবী মানুষের আনাগোনা: “বাবা একটা শাড়ি দিস। তোর ছেলেপুলেরা বড় মানুষ হবে”— এই দাবিতে বাগদি পাড়ার ভক্তির মায়ের নাম জুড়ে যায় উপহারপ্রাপকের তালিকায়। অশোক কাকা, শশাঙ্ক কাকারা সারা বছর চাষবাস দেখাশোনা করেন। ইদের দিনে তাঁরা ব্রাত্য থাকেন কী ভাবে? নতুন লুঙ্গি উপহার পান তাঁরা। গৃহিণী বলে দেন, “নমাজের দিন চলে আসিস ভাই। লাচ্ছা-সিমুই খেয়ে যাস।”

এই নিজের ভাবার টান কত আপন মুহূর্তের জন্ম দেয়। সেহেরিতে প্রতিবেশীদের সজাগ করা। কাজ থেকে ফেরার পথে লোকাল ট্রেনে জল-খেজুর সহযোগে সংক্ষিপ্ত ইফতার…। গৃহকর্তার একটু একটু করে টাকা জমানো, যাতে নিজের না হোক, অন্তত স্ত্রী-সন্তানদের নতুন পোশাক হয়। অভাবের সংসারে নিজে পুরনো পাঞ্জাবি পরে হাসিমুখে ইদের নমাজে শামিল হওয়ায় থাকে দায়িত্ববোধ। ছুটিতে গ্রামের বাড়ি, পুরনো বন্ধুর সঙ্গে দেখা— কোলাকুলি। রমজানে নির্মাণ হয় এমন কত দৃশ্যময়তার। শামসুর রাহমান লিখেছিলেন, “নানি বিষাদ সিন্ধুর স্পন্দে দুলে দুলে/ রমজানি সাঁঝে ভাজেন ডালের বড়া।” বিনীত আর্জি সৃষ্টিকর্তার দরবারে প্রেরিত হচ্ছে। সেই ইবাদতের খুশবু ‌ছড়ায় প্রতিটি মহল্লায়।

স্মার্টফোনের জমানায় সাবেক রমজান বিবর্তনের পথে কিছুটা বদলেছে। সমাজমাধ্যমে রাত জেগে সেহেরির অপেক্ষা, খাবারদাবারের ছবি শেয়ার রমজানের ভার্চুয়াল সংযোজন। এর মধ্যেই পরবের দিনের কত নিজস্ব স্মৃতি বয়ে চলা। স্মৃতির ক্যানভাসে সব জীবন্ত হয়ে ওঠে। ফেলে আসা গ্রামের মসজিদ, চেনা মানুষজন, পাশের বাড়ি থেকে ‘আজান হয়ে গেছে’-র হাঁক। যেন অনন্তকাল ধরে মহাকাব্য লিখছে ইবাদতের মাস।

অন্য বিষয়গুলি:

Iftar Party ramadan month Eid 2020
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE