জনগণমন: মিড-ডে মিল কর্মীদের বিক্ষোভ-মিছিল, ২৯ জানুয়ারি। ছবি: দেবস্মিতা ভট্টাচার্য।
অনন্তর যক্ষ যুধিষ্ঠিরকে বললেন, বাপু হে, তুমি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ। কিন্তু, আমার একটা কৌতূহল আছে, যা মহাভারত রচয়িতার মনে আসেনি। সর্বাশ্চর্য কী, তা তুমি বললে। আমার জানতে ইচ্ছা করছে, অনাশ্চর্য কী? কী এমন আছে যাতে একেবারেই আশ্চর্য হওয়ার উপায় নেই?
— এক কথায়, দুর্বলের জীবনের প্রতি সবলের ঔদাসীন্যই অনাশ্চর্য।
— একটু বুঝিয়ে বলবে, উদাহরণ-যোগে?
— অনেক উদাহরণ। আপাতত একটা বলি। এই যে, কলকাতায় কয়েক হাজার মহিলার একটা জমায়েত হয়ে গেল। মিড-ডে মিল পাচিকাদের জমায়েত। মিড-ডে মিল সরকারি কর্মসূচি। এতে স্কুলে স্কুলে বাচ্চাদের টাটকা রান্না করা খাবার দেওয়া হয়— ২০০১ সালের নভেম্বরে সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ অনুযায়ী। অধুনা, পুরাতন সমস্ত কিছুকে লোকস্মৃতি থেকে মুছে দেওয়ার উদগ্র অভিযানের ক্রমে মিড-ডে মিল নতুন নাম পেয়েছে: প্রধানমন্ত্রী পোষণ যোজনা। রান্না, পরিবেশন, বাসনপত্র পরিষ্কার, ইত্যাদি নানা কাজের জন্য সরকার তাঁদের যা ‘সাম্মানিক’ দেয়, তা হিসাব করলে দিনে গড়ে ১৫-২০ টাকার বেশি হয় না। মিড-ডে মিল কর্মীদের জমায়েতের পর সরকার খানিক টাকা বাড়ানোর কথা বলেছে বটে, কিন্তু তাতেও যা দাঁড়ায়, তা দিনমজুরদের জন্য সরকার-ঘোষিত ন্যূনতম দৈনিক মজুরির দশ শতাংশও নয়। খেটে খাওয়া এই মহিলাদের প্রতি নেতা-মন্ত্রী-আধিকারিকের মতো ক্ষমতাজীবীদের নির্লজ্জ উপহাস যখন অসহনীয় হয়ে ওঠে তখন তাঁরা পথে নামেন। নামাটা সহজ নয়। দিনে ১০-১৫ টাকা রোজগার যাঁর, তাঁর পক্ষে কলকাতা আসাটা বিলাসিতা। তদুপরি, রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক কর্তৃপক্ষের রক্তচক্ষু: মিছিলে গেলে কাজ থেকে ছাড়িয়ে দেব! কিন্তু, অবস্থা নিদারুণ বলেই, শত বাধাবিপত্তি উপেক্ষা করেও তাঁরা পথে নামেন। নিরুপায়। এক দিকে তাঁরা হাড়ভাঙা খাটুনির বিনিময়ে পাচ্ছেন সামান্য ভিক্ষা। আর অন্য দিকে একটা মোটামুটি সভ্যতা-সঙ্গত রান্নার জন্য যে সামগ্রী দরকার, সরকারি বরাদ্দের টাকায় তার অর্ধেকও পাওয়া না যাওয়ার কারণে “বাচ্চাদের মুখে কী তুলে দেব”, এই বেদনায় তাঁরা দিশাহারা। সুরাহার দাবি নিয়ে তাঁরা শহরে এলে, সংবাদ-সন্ধানীদের চোখে পড়েন। কিন্তু, সংবাদদাতারা যখন মিড-ডে মিল কর্মীদের নিয়ে খবর করছেন, তাঁদের অনেকেই শ্রোতা-দর্শকদের বললেন, “আইসিডিএস কর্মীরা রাস্তা আটকে বসে পড়েছেন।” বুঝুন! আইসিডিএস একটা ভিন্ন প্রকল্প, বিশ্বের সর্ববৃহৎ শিশুবিকাশ কর্মসূচি। চলছে ১৯৭৫ থেকে। এটা চলে, স্কুলে নয়, অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্রে। সেখানে ছয় বছর পর্যন্ত বাচ্চা এবং গর্ভবতী ও প্রসূতিদের খাবার দেওয়া হয়, বাচ্চাদের প্রাক্-প্রাথমিক শিক্ষাও দেওয়ার কথা। সংবাদদাতারা যে মিড-ডে মিল ও আইসিডিএস— দুটো আলাদা প্রকল্পকে গুলিয়ে ফেললেন, এটাই সবচেয়ে বড় অনাশ্চর্য।
— ব্যাখ্যা করো।
— এর কারণ, যাঁদের নিয়ে খবর করা হচ্ছে তাঁরা শুধু যে সমাজের সবচেয়ে দুর্বল অংশ, তা-ই নয়, তাঁরা যাদের জন্য কাজ করছেন, সেই বাচ্চারাও দুর্বল। কী হিসাবে তাঁরা দুর্বল, তার সূক্ষ্ম বিচারে যাচ্ছি না। দুর্বল এই কারণে বলছি যে, এঁরা দেশের ও সমাজের নীতি ও ব্যবস্থার উপর সরাসরি কোনও প্রভাব ফেলতে পারেন না। কারণ, সরকার এঁদের মজুরের স্বীকৃতি দেয় না। ভারত সরকারের শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী মহোদয়া লোককে বিশ্বাস করতে বলেন, “এই পাচক-কর্মীরা হচ্ছেন সাম্মানিক কর্মী, যাঁরা সমাজসেবার কাজে এগিয়ে এসেছেন।”
— তা, এঁরাই বা এই সামান্য টাকার জন্য কাজ করছেন কেন?
— কারণ, এক কথায় বলতে গেলে, এঁদের জীবনটাই জন্মগতভাবে ফাঁদে পড়া। সেই ফাঁদ থেকে বেরোনোর পথ বুঝতে এঁরা আবার ফাঁদে পড়েন।
— বড্ড হেঁয়ালি করছ। সহজ কথায় বল।
— এই ধরুন, এঁরা এমন কুলে জন্মেছেন, যেখানে চৌদ্দ পুরুষ চৌদ্দ নারী অক্ষরের মুখ দেখেনি। জেনে এসেছেন, অক্ষরের উপর অধিকার বংশগত— যে লেখাপড়া জানে, তার বাচ্চারা লেখাপড়া শিখবে, চাকরি মাস্টারি অফিসারি হাবিলদারি করবে, নেতা হবে। আর যারা চিরকাল গতরে খেটে গতর টিকিয়ে রেখেছে, গতর খাটিয়ে টিকে থাকাই তাদের বিধিলিপি। তাই, এঁদের সামনে জীবিকা অর্জনের জন্য প্রায় মাগনায় দেহশ্রম বিক্রি ছাড়া অন্য পথ নেই। শ্রমের বাজার আঁটসাঁট, যেখানে যতটুকু জায়গা করে নেওয়া যায়। তার চেয়ে বড় কথা, ক্রমে ক্রমে এঁরা শিখেছেন, নিজেদের ললাটলিখন মোছার ক্ষমতা তাঁদের নেই, কিন্তু, যদি কোনও ভাবে নিজেদের বাচ্চাকে লেখাপড়া করাতে পারেন, তারা হয়তো বা এই ফাঁদ থেকে বেরোতে পারবে। তাই, যে ভাবেই হোক তাদের পড়াতে চান। পড়াতে গেলে খরচা আছে, ইস্কুলে গেলেই হল না, টিউশনি চাই।
— টিউশনি কেন চাই? এখন তো দেখছি হাজার হাজার ইস্কুল, শুনেছি কী নাকি আইন হয়েছে, সবার বাড়ির পাশে ইস্কুল হতে হবে, আর সেখানে বিনা খরচে বাচ্চারা পড়তে পারবে। তা হলে তাদের আবার টিউশনি মাস্টারকে টাকা দিতে হবে কেন?
— এই যে আপনি আশ্চর্য হচ্ছেন, এটা একটা অনাশ্চর্য। এতে আশ্চর্য হওয়ারই কথা। কিন্তু, আসল অনাশ্চর্য হচ্ছে দুর্বলের এই খাঁচাকলে পড়ে ঘুরতে ঘুরতে জন্ম থেকে জন্মান্তরে প্রস্থান। সেই কলের একটা কল হল টিউশনি, যেটা অনাবশ্যক, অথচ বাস্তব। কেন এমন হবে, এই প্রশ্নটা যারা করতে পারে তারা করে না, আর যাঁদের জীবনে এটা সবচেয়ে বেশি শূল হয়ে বেঁধে তাঁদের গলায় জোর নেই। ফলে, তাঁরা দিনে দশ-কুড়ি-ত্রিশ টাকার বিনিময়েও খাটতে রাজি হন— যদি কোনও ক্রমে টিউশনি মাস্টারের টাকাটা জোগাড় হয়। এটা গেল এক রকমের বাধ্যবাধকতা। আরও আছে। যেমন, অসুখবিসুখ। ভারত সরকারের তো সব কিছুতে প্রধানমন্ত্রীর জয়জয়কার। মানুষের স্বাস্থ্য নিয়েও তাই ঘোষিত হল, পি এম-জয়: প্রধানমন্ত্রী জন-আরোগ্য যোজনা। রাজ্য সরকার করল স্বাস্থ্যসাথী। সরকারি স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা কাঠামো চলে গেল কোনও অদৃশ্য হাতের মুঠোয়। খেটে খাওয়া মানুষের জ্বরজ্বালা হলে তাঁরা কী করবেন? তা মিড-ডে মিলের ‘সাম্মানিক’ এই সামান্য টাকাটাও তাঁদের কাজে লাগে, লোকালয়ের ভরসা হাতুড়ের পরিষেবা নিতে। আবার কখনও দোকান-সওদা করতেও এর অবদান কম না, যখন লক্ষ লক্ষ মানুষের কাছে সব্জি কেনার মতো দশটা টাকাও থাকে না।
— তার মানে মন্ত্রী যে বলছেন মিড-ডে মিল কর্মীরা সমাজসেবার কাজে এগিয়ে এসেছেন, এ-কথা মিথ্যা?
— না, অর্ধেক সত্য। প্রকৃত সত্য হল, তাঁরা বংশপরম্পরায় সমাজসেবা করে আসছেন, তাঁদের মেহনতের ফল এই সভ্যতা, যাকে নিয়ে ক্ষমতাবানদের দেমাকে মাটিতে পা পড়ে না। ক্ষমতাজীবীর জন্যই শ্রমজীবীদের সমাজসেবা হল আসল ‘পোষণ’। তাই এঁদের উপর মহত্ত্ব আরোপ। বঞ্চিত থাকার মহত্ত্ব। সে বঞ্চনা এমনই যে, এমনকি বঞ্চনাবোধ থেকেও তিনি বঞ্চিত হন। তাঁর মনের গভীরে শিকড় গেড়ে থাকা বিধিলিপির ধারণা পাকা হতে থাকে। যা প্রাপ্য, তার কানাকড়ি পেলেও তিনি কৃতজ্ঞতায় নতজানু হন, কিছু না পেলে কৃতাঞ্জলিপুটে দাঁড়িয়ে থাকেন। আর তাই, যাঁরা “অচক্ষু সর্বত্র চান, অকর্ণ্ণ শুনিতে পান” তাঁদের চোখে এই শ্রমজীবীদের দুর্বিষহ জীবন আদৌ চোখে পড়ে না।
— কেন, এই তো সংবাদদাতাদের চক্ষুগোচর হলেন, তা যতই ভুল বলুক, খবর তো হল?
— হ্যাঁ, কখন হলেন? যখন নাকি এঁরা নিঃসহায় অবস্থা থেকে নিস্তার পেতে নিজেদেরই সহায় করে পথে নামলেন, জনজীবন ব্যতিব্যস্ত হল, যানজটে লোকেরা বিরক্ত হল। তার আগে তাঁদের খবর কে রাখে? কেবল মিড-ডে মিলের পাচিকারাই নন, একই রকম সমাজ-বিস্মৃতির শিকার হয়ে থাকেন আইসিডিএস কর্মীরা, আশা কর্মীরা, এবং অন্যান্য প্রকল্পের কর্মীরা, যাঁদের এক পরিচয় শ্রমজীবী, আর অন্য পরিচয় নারী। সামাজিক নিষ্ঠুরতার দুই-ধার তরবারির নীচে দোদুল্যমান যাঁদের ভাগ্য। সমাজ-বিস্মৃতি এতটাই গভীর যে, রাজনৈতিক দলগুলোও এঁদের জীবনকে রাজনৈতিক কর্মসূচির আওতায় আনতে ভুলে যায়। গণতন্ত্রের মন্ত্রপাঠ যাঁদের কাজ, যাঁরা সমাজে ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠায় ‘ব্রতী’, তাঁরাই যখন এঁদের কথা মনে রাখার ইচ্ছা পোষণ করতে পারেন না, তখন সংবাদদাতারা যে এঁদের পেশাগত পরিচয়গুলো গুলিয়ে ফেলবেন তাতে আর আশ্চর্য কী? ক্ষমতাজীবীদের যাঁরা ক্ষমতা জোগান তাঁদের ভুলে যাওয়ার চেয়ে অনাশ্চর্য আর কী হতে পারে?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy