Advertisement
২২ নভেম্বর ২০২৪
নিজ ক্ষেত্রে কৃতীদের রাজনীতি সন্দেহের চোখে দেখে
Wrestling Federation of India

খ্যাতির বিড়ম্বনা

তরুণ ক্রীড়াকুশলীরা যাঁদের ব্যায়াম বিশ্রাম অনুশীলন একাগ্রতার যে ক্ষতি হল, তা পূরণ হবে তো? সরকারবিরোধী তকমার গ্লানি কাটিয়ে উঠতে পারবেন তো?

An image of the Indian Wrestlers

প্রতিবাদ: ধর্নায় বসেছেন কুস্তিগির বজরং পুনিয়া, বিনেশ ফোগট ও সাক্ষী মালিক। ১০ মে, নয়াদিল্লি। ছবি: পিটিআই।

সুকান্ত চৌধুরী
শেষ আপডেট: ১৫ মে ২০২৩ ০৬:১৭
Share: Save:

এক অশীতিপর অধ্যাপক আর একদল তরতাজা মল্লবীর, দুইয়ের মধ্যে কী মিল থাকতে পারে? নানা ভাবে বিভেদপন্থী হলেও ভারতের বর্তমান শাসকগোষ্ঠী এই দুই পৃথককে এক করেছে, উভয়ের উপর খড়্গহস্ত হয়ে। দু’টি পরিস্থিতি সম্পূর্ণ আলাদা। অধ্যাপক অমর্ত্য সেনের বিপত্তি আপাত নৈর্ব্যক্তিক আইনি কারণে। বিশ্বভারতীর কিছু জমি নাকি তাঁর বসতভিটের সঙ্গে জুড়ে গিয়েছে। যদি হয়েও থাকে, নীরবে শোভন ভাবে ব্যাপারটার নিষ্পত্তি অসম্ভব ছিল না। বড় জোর মামলা হত, এই উৎকট তোলপাড় হত না। বিশ্বভারতীর প্রচুর জমি বেদখল। সেগুলি উদ্ধারের জন্য এমন তেড়েফুঁড়ে উদ্যোগ চলছে না, আবার চুপচাপ শান্তিতে উদ্ধার হচ্ছে এমনও নয়।

এ দিকে কেবল বিশ্বভারতী নয়, দেশের শাসক দল এক শ্রদ্ধেয় ব্যক্তির উপর অশ্রদ্ধা বর্ষণ করে চলেছে। ক্ষেত্রবিশেষে তা অনৃতভাষণের শামিল। শাসক দলের এক বিশিষ্ট মুখপাত্র ‘বিশ্বভারতীতে কর্মকালীন’ অমর্ত্যের কুকীর্তির কল্পকথা টুইট করেছেন, যদিও অমর্ত্য কোনও দিন বিশ্বভারতীতে কর্মরত ছিলেন না। একটা অপরাধ অবশ্য তিনি করেই চলেছেন: বর্তমান সরকারের নীতির তিনি কড়া সমালোচক। সেই সমালোচনার ভিত্তি তাঁর আর্থনীতিক ও সামাজিক চিন্তা— যে কারণে তিনি বিশ্বখ্যাত ও নোবেলপ্রাপ্ত।

এই বিতর্কের সূত্রপাত ঘটেছে কর্তৃপক্ষের তরফ থেকে। মল্লবীরদের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা উল্টো, সূত্রপাত তাঁরাই করেছেন। সাধারণ ভাবে তাঁরা মোটেও সরকারবিরোধী নন। এ ক্ষেত্রেও যা করেছেন তা বিরোধিতা নয়, এক জন মাত্র প্রভাবশালী ব্যক্তি সম্বন্ধে নির্দিষ্ট গুরুতর অভিযোগ। প্রত্যাঘাতে এই কীর্তিমান খেলোয়াড়দের বিরুদ্ধে চক্রান্তের অভিযোগ উঠেছে; বলা হচ্ছে যে, তাঁরা দেশের গৌরব নন, লজ্জা। যিনি বলেছেন, তাঁকেও আমরা একই কারণে গৌরবান্বিত করি।

আসল কথা, কি পণ্ডিত কি মল্লবীর উভয়ই শাসকের অস্বস্তির উদ্রেক করেছেন, অতএব ক্ষোভেরও বটে। মন্দ কথা শুনতে কারও ভাল লাগে না, ক্ষমতাবানদের তো বিশেষ করেই নয়। এতেও সবটা বলা হল না। কোনও অনামী ব্যক্তি সরকারের গালমন্দ করলে যে ভাবে লাঞ্ছিত হন, ব্যাপারটা তেমন নয়। উভয়েই ভোগ করছেন খ্যাতির বিড়ম্বনা।

আমাদের সমাজে রাজনীতির যত রমরমা, যত দাবি দাপট অগ্রাধিকার, আর কিছু তার ধারে কাছে নয়। কেবল ক্ষমতার তুঙ্গে অল্প কিছু নেতা বা দল নয়, গায়ে রাজনীতির গন্ধ থাকলেই যে কেউ সেই সুবাদে বহু সুবিধা ভোগ করেন, অনেকের উপর কর্তৃত্ব করেন, অশেষ অন্যায় করেন নিরঙ্কুশ ভাবে। বলা চলে, সমাজ দুই ভাগে বিভক্ত: যাঁরা রাজনৈতিক আশীর্বাদপুষ্ট, এবং যাঁরা নন। রাজনৈতিক শ্রেণি বা পলিটিক্যাল ক্লাস ধ্রুপদী শ্রেণিবিভাগে এক নতুন সংযোজন। যে পরম সৌভাগ্যবানদের আমরা মনে করি এই বাস্তুতন্ত্রের ঊর্ধ্বে, আসলে তাঁরাও নন। বৃহত্তম ধনকুবেরেরও নির্বাধ প্রাপ্তির জন্য চাই প্রশাসনিক, অতএব রাজনৈতিক আনুকূল্য। খেলা বা সিনেমা জগতের উজ্জ্বলতম নক্ষত্রেরা হয় শাসকশিবিরে আনাগোনা করেন, নয় সন্তর্পণে গা বাঁচিয়ে চলেন। তাই সঙ্কটে-বিতর্কে এই মেগাস্টাররা কখনও সক্রিয় ভূমিকা নেন না, চরম অন্যায়ের বিরুদ্ধেও মুখ খোলেন না।

সমস্যা বাধে ধরাছোঁয়ার নাগালে যে বিশিষ্টরা, তাঁদের নিয়ে। এঁরা সফল, খ্যাতিমান, প্রায়ই জনপ্রিয়। এঁদের সাফল্যের পিছনে আছে প্রতিভা ও সাধনা। মানতে হবে, এ জন্য আমরা বাকিরা অবিমিশ্র ভক্তি নয়, একটু ঈর্ষা ও গাত্রদাহও বোধ করি। রাজনীতিকদের গাত্রদাহটা খানিক বেশি হতে পারে, কারণ এক জন ‘নিছক’ বিজ্ঞানী বা সঙ্গীতশিল্পী বা ক্রীড়াকুশলী যে সরল নিষ্ঠা পালন করতে পারেন, রাজনীতিতে তা সম্ভব নয়। রাজনীতিকরা ভাবতেই পারেন, এঁরা ফাঁকি দিয়ে আমাদের টেক্কা দিতে চাইছেন।

বিশেষত খেলা, গান বা অভিনয়ে, ক্বচিৎ অন্যান্য ক্ষেত্রেও, এই সফল ব্যক্তিদের একাংশ যথেষ্ট খ্যাতি ও জনপ্রিয়তা লাভ করেন, যার ভিত্তি রাজনীতির তুলনায় আরও সহজ, স্থায়ী, মানবিক। (সব কর্মক্ষেত্রেই যথেষ্ট রেষারেষি বৈর অপকীর্তি আছে, যাকে সেই জগতের ‘রাজনীতি’ বলা হয়, সেটা আলাদা ও তুলনায় গৌণ।) এক কথায়, এই বিশিষ্টদের দৃষ্টান্তে একটা বিকল্প মূল্যবোধ সমাজে স্থান পায়। সেই মূল্যবোধের প্রকাশ অধ্যাপক বা আইনজ্ঞের এক রকম হতে পারে, খেলোয়াড় বা অভিনেতার অন্য রকম। কিন্তু একটা আর একটার পরিপূরক। আদতে সবটাই এক, সবটাই সুস্থ প্রয়াসী সমাজের সাধনার অঙ্গ।

সেই মূল্যবোধকে মান্য করেন এবং সামান্যতম মাত্রায়ও রাজনীতিতে প্রয়োগের চেষ্টা করেন, এমন রাজনীতিক বিরল ও মহান। শোনা যায়, স্বাধীন ভারতের প্রথম যুগে স্বাধীনতা সংগ্রামে অভিষিক্ত কিছু দেশনেতার এই গুণটি ছিল। অত না হলেও কোনও বিচক্ষণ শাসকগোষ্ঠী খুবই ভাবতে পারে, এই কৃতী মানুষগুলিকে কাজে লাগালে আমাদেরই লাভ। দেশবাসীর উপকার হবে, আমাদের বাক্সে ভোট পড়বে।

বিপর্যয় বাধে যখন শাসকের সেই প্রত্যয়, সেই সদিচ্ছা থাকে না। এমন শাসকের চোখে কারও উচ্চ মেধা বা সাফল্য অবান্তর উৎপাত বই নয়, আর বাড়তে দিলে প্রতিযোগিতা বা বিরোধিতার নামান্তর। সেই কৃতী ব্যক্তির হয়তো ঘুণাক্ষরে এমন অভিপ্রায় নেই। না থাক, তাঁর নিরীহ অস্তিত্বেও শাসক দেখেন অশনিসঙ্কেত। এই অবিশ্বাসের সবচেয়ে বিধ্বংসী ফল, নিরপেক্ষ বিশেষজ্ঞ ও অভিজ্ঞ ব্যক্তিরা প্রশাসন বা উন্নয়নের কাজে অপাঙ্‌ক্তেয় থেকে যান।হাতে-গোনা বশংবদ ‘উপদেষ্টা’ বেষ্টিত হয়ে কর্তারা তাঁদের ‘কমফর্ট জ়োন’-এ বিরাজ করেন।

স্বাধীন উৎকর্ষের অধিকারীদের সঙ্গে শেষঅবধি তাই বিরোধ বেধেই যায়। তথাকথিত বুদ্ধিজীবীদের মজ্জাগত কু-অভ্যাস, তাঁরা শাসকদের খুঁত ধরেন, জ্ঞান দিতে যান। যাঁরা সচরাচর দেন না— যেমন তরুণ খেলোয়াড়— তাঁরাও সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত হলে বা সতীর্থের ক্ষতি হতে দেখলে প্রতিবাদ করেন, খানিকটা তারুণ্যবশত, খানিকটা সাফল্যবশত। স্বভাবতই তাঁরা মনে করেন, আমরা দেশকে যা দিলাম, তার বদলে কিছু কি আমাদের প্রাপ্য নয়?

শাসক তাই মরিয়া হন সব বিকল্প সাফল্য বিকল্প মূল্যবোধকে দখলে আনতে, অধীনস্থ করতে। সেগুলি আর সত্যিকারের বিকল্প থাকে না, চালু ব্যবস্থার সঙ্গে মিলে যায়। তার সঙ্গে সমঝোতা করে, তাকে উত্তমর্ণ মানে, তার সাফল্যের যজ্ঞে নিজের সাফল্যের নৈবেদ্য জোগায়, তার চিৎকৃত প্রচারে গলা মেলায়। ছোট-বড় সব ক্ষমতাসীন দলকেই ঘিরে থাকেন কিছু সফল গুণী মানুষ। শাসকের সঙ্গে তাঁদের সান্নিধ্যের শর্ত, নির্বিরোধ আনুগত্যের বেড়াজালে তাঁরা স্বেচ্ছাবন্দি থাকবেন।

শর্ত না মানলে কোনও অ-সাধারণ ব্যক্তি কত ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত ও নিগৃহীত হন, ফি-দিন সংবাদে তার নজির মিলবে। যেটা অত চোখে পড়ে না, সেই সূক্ষ্মতর পরিণাম বরং দেখা যাক। শুরুতে উল্লিখিত দু’টি ঘটনা তার দৃষ্টান্ত।

গোড়াতেই বলেছি, জমির বিবাদ নয়, অমর্ত্য সেনের আসল লাঞ্ছনা সেই বিবাদ ঘিরে ন্যক্কারজনক রাজনৈতিক বিতণ্ডা। এই বিতণ্ডায় অমর্ত্যবাবুর কোনও হাত নেই, তিনি উপলক্ষ মাত্র। চান আর না চান, বিতর্ক তাঁকে টেনে নিয়েছে। তাঁর ভাবমূর্তি হয়তো এ সত্ত্বেও অটুট থাকবে, বিদ্যাচর্চা চিন্তাপ্রক্রিয়া মানসিক শান্তি বিঘ্নিত হতে বাধ্য। সবচেয়ে মর্মান্তিক কথা, আমাদের রাজনৈতিক শ্রেণি চরিতার্থ বোধ করবে, এক পরম সম্মাননীয় ব্যক্তিকে স্রেফ উত্ত্যক্ত করে তাঁর কাছ থেকে তাদের দাপটের স্বীকৃতি আদায় করেছে, তাঁর জীবনের একটা অংশ নিজেদের নাগালে এনে ফেলেছে। রূপকার্থে এই জমিটুকু তাঁকে ছাড়তে হচ্ছে, আসল জমির মামলার যা-ই ফয়সালা হোক।

আর সেই তরুণ ক্রীড়াকুশলীরা? তাঁদের ব্যায়াম বিশ্রাম অনুশীলন একাগ্রতার যে ক্ষতি হল, তা পূরণ হবে তো? সরকারবিরোধী তকমার গ্লানি কাটিয়ে উঠতে পারবেন তো? রাজনীতিকদের দূরে রেখে আপন মর্যাদার জোরে আন্দোলন চালাবার সঙ্কল্প তাঁদের ত্যাগ করতে হয়েছে। নানা দল তাঁদের ধর্নামঞ্চে আসছে। শাসক-বিরোধী সকলেই আন্দোলনটাকে ঘোলা জলের রাজনীতির অভ্যস্ত আওতায় এনে ফেলতে উদ্‌গ্রীব। খেলোয়াড়দের আদি অভিযোগের নিষ্পত্তি যদিও বা হয়, নীতির লড়াইয়ে তাঁরা হেটো রাজনীতির কাছে পর্যুদস্ত হতে চলেছেন।

বিষাক্ত বাতাসে কোনও গাছ সুস্থ ভাবে বাঁচে না, মহীরুহও শুকিয়ে যায়। জমি নয়, বায়ুদূষণই আমাদের অবস্থার উপযুক্ত উপমা। তাতে প্রবীণের দম আটকে আসে, নবীনের উদ্যমে ভাটা পড়ে। রুক্ষ আবহে বাড়তে থাকে কেবল ফণিমনসা।

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy