নজর: দ্য কেরালা স্টোরি দেখছে জম্মুর মেয়েরা। ছবি: পিটিআই।
বিরাট টানাপড়েন চলছে দ্য কেরালা স্টোরি-কে ঘিরে। এক দল মানুষ এবং রাজনৈতিক নেতার দাবি, ছবিটি সাম্প্রতিক ঘটনাবলির যথাযথ রূপায়ণ। তাঁদের কাছে ছবিটি তথ্যচিত্রের সমান। কয়েকটি রাজ্যে ছবির প্রদর্শনী করমুক্ত হয়েছে। অভিভূত দর্শক ফেসবুক বা হোয়াটসঅ্যাপে লিখছেন, চোখের সামনে বছরের পর বছর ধরে যা ঘটে চলেছে, ছবিতে তারই প্রতিফলন। ইঙ্গিতটা আইএস-পরিকল্পিত ‘লাভ জেহাদ’-এর দিকে। ঘটনা হল, আইএস একদা কেরল ছাড়াও নানা জায়গায় সক্রিয় ছিল। এখন তাদের প্রভাব যথেষ্ট কম।
কেরলে ছবির প্রদর্শনী বন্ধ করার আর্জি জানিয়ে হাই কোর্টে বাদীপক্ষ বলেছিলেন, ছবিতে মাত্র তিন জন মহিলার অভিজ্ঞতার নিরিখে বিশেষ এক সম্প্রদায়ের মানুষকে কালিমালিপ্ত করা হয়েছে। ট্রেলার দেখে বিচারকদের মনে হয়নি ছবিতে এমন কোনও ধারণা দেওয়া হয়েছে। কয়েক মিনিটের খাপছাড়া কিছু দৃশ্যের গুচ্ছ দেখে পুরো ছবির সামগ্রিক বিন্যাস বোঝা যায় কি না, সে প্রশ্ন অবশ্য থেকেই গেল। বিবাদী পক্ষের যুক্তি, ছবিটি নিছক কাল্পনিক কাহিনি। অথচ, এই কাল্পনিক কাহিনির সমর্থনেই তাঁরা টুইটারে ‘পরিসংখ্যান’ পেশ করেছিলেন, সম্প্রতি কেরলে ৩২০০০ অ-মুসলিম মেয়ে আইএস-এর কারসাজিতে নিখোঁজ হয়েছে। এই ‘পরিসংখ্যান’-এর কোলও সূত্র নির্মাতারা দিতে পারেননি। হাই কোর্টের নির্দেশে তা মুছে ফেলতে হয়েছে। কিন্তু তত দিনে কয়েক লাখ লোকের কাছে এই বার্তা পৌঁছে গেছে। এটাই কি ছবির নির্মাতাদের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য ধরিয়ে দিত না?
কেরল হাই কোর্টের মতে, ছবিটি যখন উপযুক্ত কর্তৃপক্ষের ছাড়পত্র পেয়ে বাজারে এসেছে, তখন এ ব্যাপারে হস্তক্ষেপের প্রয়োজন নেই। আবার কয়েকটি রাজ্যে ছবিটি প্রশাসনিক বা বাণিজ্যিক নিষেধের আওতায় এসেছে, নাগরিক বা সামাজিক শৃঙ্খলা বিঘ্নিত হওয়ার আশঙ্কায়। এই মতের বিরোধীরা বলছেন, এ ভাবে প্রযোজক-পরিচালকের মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ক্ষুণ্ণ হচ্ছে।
এই পরিপ্রেক্ষিতে সংবিধান-প্রতিশ্রুত মতপ্রকাশের স্বাধীনতা বা ভারতীয় চলচ্চিত্র আইনের আওতায় চালু থাকা ফিল্ম সেন্সর ব্যবস্থার খুঁটিনাটি নিয়ে একটু নাড়াচাড়া করা যেতে পারে। খুঁটিনাটি বলতে শুধু আইনের নীতিগত দিকই নয়, তার প্রয়োগের জন্য যে বিধি ও নির্দেশিকা তৈরি করা হয়েছে, সেগুলোর গুরুত্ব বোঝাও সমান জরুরি।
যাঁরা মতপ্রকাশের স্বাধীনতার কথা তুলছেন, তাঁরা ভাবছেন কেবল সংবিধানের ১৯(১)(ক) ধারার কথা। তাঁরা ভুলে যাচ্ছেন, সংবিধানের ১৯(২) ধারায় কিছু নির্দিষ্ট কারণে এই স্বাধীনতার উপর ‘যুক্তিসঙ্গত প্রতিবন্ধক’ আরোপ করা যায়। কারণগুলির মধ্যে আছে নাগরিক শৃঙ্খলা ও শালীনতার রক্ষার প্রয়োজন। সংবিধানের লক্ষ্মণরেখারই প্রায় হুবহু প্রতিফলন ১৯৫২ সালে প্রণীত এবং এখনও চালু-থাকা চলচ্চিত্র আইনের ৫(খ) ধারা— উপযুক্ত কর্তৃপক্ষের যদি মনে হয় যে একটি ছবি, বা তার অংশবিশেষ সামাজিক শৃঙ্খলা বা শালীনতা বিঘ্নিত করবে, তা হলে ছবিটিকে সাধারণ্যে প্রদর্শনের অনুমতি দেওয়া হবে না। এখানে উপযুক্ত কর্তৃপক্ষ মানে সেন্ট্রাল বোর্ড অব ফিল্ম সার্টিফিকেশন। অবশ্য দু’টি ক্ষেত্রেই নাগরিক/সামাজিক শৃঙ্খলা এবং শালীনতা বলতে কী বোঝায় তা বলা হয়নি। পরোক্ষে সেই ব্যাখ্যার দায়িত্ব বর্তেছে প্রশাসন এবং আদালতের উপর।
তবে সেন্ট্রাল বোর্ড অব ফিল্ম সার্টিফিকেশন উনিশটি ধারার একটি তালিকা অনুসারে ছবির বিচার করে থাকে। তালিকার ২ নম্বর ধারা বলে, কোনও ছবিতে যেন দুষ্কৃতীদের কাজকর্ম, অথবা মানুষকে প্ররোচিত করতে পারে এমন কোনও দৃশ্য বা কথা না থাকে। ১১ নম্বর ধারা— কোনও ছবিতে যেন দৃশ্য অথবা শব্দের মাধ্যমে বিভিন্ন জাতি, ধর্মীয় বা অন্যান্য সম্প্রদায়ের প্রতি বিদ্বেষ ছড়ানো না হয়। ১২ নম্বর ধারা বলে, ছবিতে যেন দৃশ্য অথবা শব্দের মাধ্যমে সাম্প্রদায়িক বিভেদমূলক, প্রাচীনপন্থী, অবৈজ্ঞানিক বা দেশবিরোধী প্রচার চালানো না হয়। এবং ১৭ নম্বর ধারাটি বলে, কোনও ছবি যেন জনশৃঙ্খলা ব্যাহত না করে।
দ্য কেরালা স্টোরি-র ক্ষেত্রে এই ধারাগুলি একক বা সামগ্রিক ভাবে লঙ্ঘিত হওয়ার আশঙ্কা ছিল বলে পরীক্ষকদের মনে হয়নি! অন্য অনেক ছবির ক্ষেত্রেও হয়তো একই অভিযোগ আনা যায়। কিন্তু সে সব ছবি দ্য কেরালা স্টোরি-র মতো ‘তথ্যভিত্তি’-র দাবি করে না। কেরলের হাই কোর্ট, এবং নাগরিক সমাজের আরও অনেকেই, সেন্ট্রাল বোর্ড অব ফিল্ম সার্টিফিকেশন-এর ছাড়পত্রে আস্থা রেখেছেন। কিন্তু শুধু আইন নয়, সংশ্লিষ্ট বিধি এবং নির্দেশিকা মেনে বোর্ড নিজেদের দায়িত্ব যথাযথ পালন করেছেন কি না; একটি স্পর্শকাতর বিষয়ের কিছু বিচ্ছিন্ন ঘটনাকে সাধারণীকরণ করার যে চেষ্টা এ ছবির নির্মাতারা করেছেন, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি আর সামাজিক শৃঙ্খলার স্বার্থে বোর্ডের তাতে বাধা দেওয়া উচিত ছিল কি না— বিস্তারিত যুক্তির সাহায্যে সেই বিচারটাই আদালতের কাছে চাওয়া যেত। তা হলে বিষয়গুলো নথিভুক্ত থাকত— পরবর্তী প্রজন্মের জন্য, পরিবর্তিত পরিস্থিতির জন্য।
চলচ্চিত্র আইনে প্রতিবাদ নথিভুক্ত করার আর একটি পদ্ধতিও বলা আছে। আইন প্রয়োগের সুবিধার্থে ১৯৮৩ সালে তৈরি হয়েছিল একটি বিধিমালা, ‘দ্য সিনেম্যাটোগ্রাফ সার্টিফিকেশন রুলস’। এর ৩২ নম্বর ধারা অনুযায়ী যে কোনও নাগরিক বা নাগরিক-গোষ্ঠী মুক্তি-পাওয়া ছবি নিয়ে তাঁর বা তাঁদের আপত্তির কথা সরাসরি কেন্দ্রীয় সরকারের তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রকে জানাতে পারেন। মন্ত্রকের সাংবিধানিক দায়িত্ব প্রতিটি অভিযোগ বিষয়ে বোর্ডের মতামত চাওয়া। এমনকি ক্ষেত্রবিশেষে মন্ত্রক ছবি পুনর্বিবেচনার নির্দেশও দিতে পারে বোর্ডকে। ফল যা-ই হোক, অভিযোগ নথিভুক্ত করাও একটা কৌশল। পদ্মাবত ছবির ঘটনা খুব বেশি দিন আগের নয়।
কেরলের মুখ্যমন্ত্রী ছবির উপর প্রশাসনিক নিষেধাজ্ঞা জারি না করে মানুষকে সতর্ক থাকতে বলেছেন। অনেকে সেই উদাহরণ টেনে এনে পশ্চিমবঙ্গে ছবিটির উপর প্রশাসনিক নিষেধাজ্ঞার বিরোধিতা করছেন। নীতিগত ভাবে ব্যাপারটা মোটেই সমর্থনযোগ্য নয়। কিন্তু দুই রাজ্যের রাজনৈতিক অবস্থা আর মানুষের সাম্প্রদায়িক চেতনার মান যে আলাদা, ভোটের ফলেই পরিষ্কার। চলচ্চিত্র আইনে বলা আছে, কেন্দ্রীয় সরকার বা স্থানীয় প্রশাসন সীমিত সময়ের জন্য বোর্ডের ছাড়পত্র পাওয়া ছবি দেখানো বন্ধ করে দিতে পারে। পশ্চিমবঙ্গে প্রশাসনিক নিষেধাজ্ঞা সুপ্রিম কোর্টে খারিজ হয়েছে। রাজ্য সরকার তাদের সওয়ালে কেন্দ্রীয় চলচ্চিত্র আইনের কথা বলেছিল কি? রাজ্য আইনের যে ধারায়, যে ভাবে নিষেধাজ্ঞা জারি হয়েছিল, তা সুপ্রিম কোর্টের কাছে গ্রহণযোগ্য হয়নি।
মানবাধিকারের এক ধ্রুপদী নীতির ভিত্তিতে সংবিধানের ১৯(১)(ক) ধারায় স্বাধীন ভারতের সব নাগরিককে মতপ্রকাশের স্বাধীনতার মৌলিক অধিকার দেওয়া হয়েছিল। সংবিধান প্রণয়নের দেড় বছরের মধ্যেই তার পায়ে বেড়ি পরানো হয়। ১৯৫২ সালে ঔপনিবেশিক আমলের ফিল্ম সেন্সর ব্যবস্থার নব-রূপায়ণের প্রাথমিক রূপরেখা তৈরি হয়েছিল এই খণ্ডিত স্বাধীনতার ভিত্তিতেই। সবই এ দেশে প্রথম নির্বাচিত সংসদ গঠিত হওয়ার আগের ঘটনা। এ ব্যবস্থার অন্তর্নিহিত সীমাবদ্ধতার কথা সবিস্তারে বলেছিলেন বিচারপতি গোবর্ধনদাস খোসলা, ১৯৬৮ সালে। সে বছরেই খ্বাজা আহমদ আব্বাস এই ব্যবস্থা খারিজের দাবি জানিয়েছিলেন সুপ্রিম কোর্টে, সফল হননি। পরে সেন্সর ব্যবস্থার রাজনৈতিক উদ্দেশ্য আরও মজবুত হয়েছে। সামাজিক পরিস্থিতিও ক্রমাগত জটিল হচ্ছে। ২০১৬ সালে শ্যাম বেনেগালের নেতৃত্বে এক সরকারি কমিটি সেন্সর ব্যবস্থা খারিজের সুপারিশ করে। ২০১৭-তে অমোল পালেকর একই দাবি নিয়ে সুপ্রিম কোর্টের দ্বারস্থ হয়েছিলেন। মামলা ঝুলে আছে।
অচলায়তন ভাঙতে আইনের গণ্ডিতেই সেন্সর ব্যবস্থার বিরোধিতা জারি থাকা দরকার। পাশাপাশি নিরবচ্ছিন্ন ভাবে এর অযৌক্তিকতা ও সীমাবদ্ধতাকে তুলে ধরতে নাগরিক সমাজের সঙ্ঘবদ্ধ ও সক্রিয় উদ্যোগও সমান জরুরি। মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ছিনিয়ে নেওয়া বা রক্ষা করার লড়াইয়ে সংবিধানের ১৯(২)-এর মতো লক্ষ্মণরেখাগুলো কিন্তু শাঁখের করাত বা লুকোনো ফাঁদ। সতর্কতা বাঞ্ছনীয়।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy