— ফাইল চিত্র।
একই অঙ্গে দু’টি রূপ! দুটোই কাগজে-কলমে ‘সর্বোচ্চ’, কিন্তু প্রায় আদ্যন্ত ‘আনুষ্ঠানিক’/‘আইনানুগ’— ‘প্রকৃত’ নয়। ভারতে রাষ্ট্রপতি নিযুক্ত ও (পড়ুন কেন্দ্রীয় সরকার) মনোনীত— রাজ্যের সাংবিধানিক প্রধান বা ‘রাজ্যপাল’ যিনি, তিনিই আবার রাজ্যের সংবিধি (স্ট্যাটুট) অনুযায়ী, সেখানকার সমস্ত সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘আচার্য’। অর্থাৎ, একই অঙ্গে দু’টি রূপ! সংসদীয় শাসনের রীতি অনুযায়ী, সম্মাননীয় আচার্য/রাজ্যপাল হলেন— বিশ্ববিদ্যালয় ও রাজ্য— উভয় ক্ষেত্রেই ‘আইনানুগ’ (ডি জুরে) ক্ষমতার অধিকারী। ‘প্রকৃত’ (ডি ফ্যাক্টো) শাসকবর্গ হলেন মুখ্যমন্ত্রী ও তাঁর মন্ত্রিপরিষদ, যার অন্যতম সদস্য হিসাবে মাননীয় উচ্চশিক্ষামন্ত্রীর সঙ্গে রাজ্যের বিশ্ববিদ্যালয়গুলিকে নিয়ে ‘আইনানুগ’ কর্তৃত্ব মানে ‘আচার্য’-এর অহেতুক দড়ি টানাটানি, নানা অপ্রয়োজনীয় বিজ্ঞপ্তি ও তার পাল্টা হেঁয়ালিতে দেওয়া নানা বক্রোক্তি, প্রভৃতি নিতান্ত গৌড়জনেরও মনোযোগ কেড়েছে। ভোটের বাজারের গরম তা আরও বাড়িয়েছে। এরই মধ্যে ‘রাজ্যপাল’ রাজ্যের শিক্ষামন্ত্রীকে মন্ত্রিসভা থেকে ‘সরিয়ে দিতে’ অভূতপূর্ব ‘নির্দেশ’ জারি করেছেন, যা নিয়ে আইনি থেকে রাজনৈতিক মহলে উত্তপ্ত বিতর্ক চলেছে।
রাজ্যের উচ্চশিক্ষার সঙ্গে দীর্ঘ প্রায় চার দশক যুক্ত থাকার সুবাদে এবং রাজ্যের শুভানুধ্যায়ী নাগরিক হিসাবে, বর্তমান লেখকও সকলের সঙ্গে চায়, এই অর্থহীন চাপান-উতোর ও স্থায়ী উপাচার্য না থাকার সমস্যা মুক্ত হয়ে বিশ্ববিদ্যালয়গুলির অচলাবস্থা এখনই দূর হোক। রাজ্যের বিশ্ববিদ্যালয়গুলি— যার অনেকগুলিই মানের দিক থেকে ভারতের মধ্যে শীর্ষস্থানীয়— আবার স্বমহিমায় ফিরে আসুক। কিন্তু গত বছরখানেকের টানাহেঁচড়ায় কর্দম ও ধূলিকণায় যে বিভ্রান্তির বাতাবরণ তৈরি হয়েছে, কেবল সম্মিলিত শুভবুদ্ধির জোরেই তা মিটবে, এমনটা দুরাশা। এই সমস্যার মূল ও বিস্তার বুঝতে গেলে শেষ পর্যন্ত আইনি বিধানের ব্যাখ্যা ও যুক্তির সাহায্যই নিতে হবে।
প্রথমেই রাজ্যপালের সাম্প্রতিক ‘নির্দেশ’ সম্পর্কে জানাতে হয়, ভারতের সংবিধান এমন কোনও ক্ষমতা মহামহিম রাজ্যপালকে দেয়নি। বিধানসভার সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যের সমর্থনে যিনি নির্বাচিত হন তাঁকেই রাজ্যপাল ‘মুখ্যমন্ত্রী’ নিযুক্ত করেন ঠিকই, কিন্তু অন্য কারও ‘উপদেশ’ বা ‘সুপারিশ’-এর ভিত্তিতে নয়— সংসদীয় গণতান্ত্রিক প্রথা মেনে এটা করতে বাধ্য থাকেন (ধারা ১৬৪)। অনেক সময়, বিশেষত জোট সরকারের ক্ষেত্রে বা সংখ্যাগরিষ্ঠ দলে বিক্ষোভের কারণে মুখ্যমন্ত্রিত্বের একাধিক দাবিদার থাকলে, তিনি (সমালোচকদের মতে, কেন্দ্রের অলিখিত নির্দেশে) নিজের ‘বিবেচনা’র ক্ষমতা প্রয়োগ করে ঘোলা-জলে পছন্দসই মৎস্য শিকারির সুবিধা করে দিতে পারেন, কিন্তু সাধারণ ক্ষেত্রে, যেখানে মুখ্যমন্ত্রীর সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে কোনও প্রশ্ন নেই, সেখানে সংবিধানের রজ্জুতে তাঁর হাত-পা বাঁধা। অন্যান্য পূর্ণ বা অর্ধ ক্ষমতার অধিকারী মন্ত্রীদেরও রাজ্যপাল নিযুক্ত করেন, নিজের খেয়ালখুশি মতো নয়, মুখ্যমন্ত্রীর সুপারিশক্রমেই। তাই, যে-হেতু কেবল মুখ্যমন্ত্রীর সুপারিশেই রাজ্যের মাননীয় উচ্চশিক্ষামন্ত্রী নিযুক্ত হয়েছিলেন, তাই একমাত্র মুখ্যমন্ত্রীর সুপারিশক্রমেই তাঁর অপসারণ করা যায়, অন্য কারও মর্জিমাফিক নয়। সুপ্রিম কোর্টের বিভিন্ন সাংবিধানিক মামলায় নানা নির্দেশে তা স্পষ্ট।
তবে, কী করে রাজ্যপাল মহোদয় এমন নির্দেশ জারি করলেন? এর জন্য কিছুটা পিছোতে হবে— ১৯৩৫ সালের ঔপনিবেশিক ভারত-শাসন আইনে ফিরতে হবে। তখন সীমিত ভোটাধিকারে নির্বাচিত কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক মন্ত্রিসভা থাকলেও— প্রকৃত ক্ষমতা ছিল দেশের ক্ষেত্রে গভর্নর জেনারেল বা বড়লাট আর প্রদেশের ক্ষেত্রে ‘গভর্নর’ বা ‘ছোটলাট’-এর হাতে। সেই আইনের ধারা ৫১ অনুযায়ী প্রাদেশিক গভর্নরের বিশেষ ক্ষমতা ছিল কাউকে মন্ত্রিসভায় অন্তর্ভুক্ত বা বরখাস্ত করার। সংবিধান রচনার সময় বিতর্কে যোগ দিয়ে আম্বেডকর জানিয়েছিলেন, ভারতীয় সংবিধানে রাজ্যপালের এমন কোনও ক্ষমতা থাকবে না। তাই, সংবিধানের ধারা ১৬৪-র খসড়া রচিত হওয়ার সময় তা থেকে মন্ত্রীদের ‘চয়ন’, ‘বরখাস্ত’ বা ‘বিশেষ ক্ষমতা’ কথাগুলিকে ছেঁটে ফেলা হয়েছিল। তবে কি এই ‘নির্দেশে’, বাতিল-হয়ে-যাওয়া ঔপনিবেশিক ক্ষমতা পরকালের তমিস্রা থেকে ফের উঠে আসছে?
এ বার ‘আচার্য’-এর কথা। রাজ্যপালের ‘আইনানুগ’ সাংবিধানিক ক্ষমতার মতোই, এ-রাজ্যের বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন ও সংবিধি অনুযায়ী আচার্যই ‘উপাচার্য’ নিয়োগ করেন, কিন্তু একাকী ও একক ক্ষমতায় নন— শিক্ষা দফতরের সঙ্গে, বস্তুত শিক্ষামন্ত্রীর সঙ্গে সদর্থক আলোচনার পর, উপাচার্য বাছাইয়ের সার্চ কমিটি প্রদত্ত তিন জন প্রতিষ্ঠিত শিক্ষাবিদের ক্রমানুসারী প্যানেল থেকে এক জনকে নিয়োগ করেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রে তত্ত্বগত ভাবে ‘আচার্য’ই সর্বেসর্বা হলেও তাঁর হয়ে উপাচার্যই চার বছরের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় চালান। বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ সভা— কোর্ট/সেনেট পরিচালনা এবং বিশেষ কোর্ট/সেনেট মিটিং করে সমাবর্তনের সভাপতিত্ব করা ছাড়া সারা বছর আচার্যের বিশেষ কাজ থাকে না। আগে তবুও ছুটির প্রয়োজনে উপাচার্যরা আচার্যের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ করলেও, পরবর্তী আইনে উপাচার্যরা শিক্ষা দফতর মারফতই এই যোগাযোগ রাখতে পারেন। সেই সময়েই উপাচার্য বাছাইয়ের সরকার অনুমোদিত প্যানেলে ধনখড় সই না করায়, সরকার বিঘ্ন-নাশক ধারা ব্যবহার করে উপাচার্য নিয়োগ করে বিশ্ববিদ্যালয় ব্যবস্থা চালু রাখে। এই নিয়ে হাই কোর্টে মামলা হয়। এর পর ধনখড় উপরাষ্ট্রপতি হলে প্রথমে স্বল্পকালীন ভাবে লা গণেশন রাজ্যপাল/আচার্য হন। ২০২২-এর শেষাশেষি সি ভি আনন্দ বোস তাঁর স্থলাভিষিক্ত হন।
গোড়ায় ‘বোস’ ও রাজ্য সরকারের মধ্যে সম্পর্ক এমন মাখো-মাখো হয়ে ছিল, যা ছিল রাজ্য বিজেপির নেতাদের চক্ষুশূল। গত বছরের শুরুতে, ইউজিসি-র নতুন নির্দেশনামা, সুপ্রিম কোর্ট ও কলকাতা হাই কোর্টের রায় অনুযায়ী রাজভবনে আচার্য-শিক্ষামন্ত্রী তথা তখনও মেয়াদ-না-ফুরানো উপাচার্যদের দিনভর বৈঠকের কিছু দিন পর অভূতপূর্ব ভাবে সব উপাচার্য গণ-ইস্তফা দিয়ে ফের তিন মাসের জন্য নিয়োগপত্র নিয়ে ফিরলেন। সংঘাতের শুরু হল, যখন বোস নবনিযুক্ত অন্তর্বর্তী উপাচার্যদের তাঁর কাছে বিশ্ববিদ্যালয় বিষয়ে সরাসরি সপ্তাহান্তিক রিপোর্ট পাঠানোর শর্ত আরোপ করলেন। মুশকিল হল, বেশির ভাগ উপাচার্যই চালু আইন অনুযায়ী শিক্ষা দফতর মারফত ওই রিপোর্ট পাঠালেন। এতে কুপিত আচার্য ‘অবাধ্য’ উপাচার্যদের ‘শিরশ্ছেদ’ করলেন এবং একক ভাবে, নিজের পছন্দমাফিক ‘উপাচার্য’ নিয়োগ করতে লাগলেন। তাদের মধ্যেও কিছু দিনের মধ্যে কম ‘অনুগত’দের সরিয়ে দিয়ে অন্যদের বসানো হল। ক্রমে পরম সম্মানের উপাচার্যের আসনটি হয়ে উঠল ‘মিউজ়িক্যাল চেয়ার’!
এই ভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের সিদ্ধান্ত গ্রহণের সর্বোচ্চ আসনটি চূড়ান্ত অনিশ্চিত হয়ে পড়ায় বিশ্ববিদ্যালয়-ব্যবস্থাটাই এলোমেলো হয়ে পড়ল, বড় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে যেখানে প্রচুর কলেজ, তাদের কয়েক সহস্র শিক্ষক ও লক্ষাধিক ছাত্রছাত্রী আছেন— তাঁদেরও— ভর্তি থেকে পরীক্ষা বা শিক্ষকদের প্রোমোশন, বা বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাবর্তন থেকে পরিচালন সমিতির মিটিং ঝুলে থাকল। যে ইউজিসি-র কথা বলে আচার্যের এমন ‘বিপ্লব’, তাকেই বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ দেখিয়ে ন্যূনতম যোগ্যতা না থাকলেও, এমনকি আদৌ এক দিনের শিক্ষকতার অভিজ্ঞতা না থাকলেও— অবসরপ্রাপ্ত আইপিএস বা প্রাক্তন বিচারপতিদের এই ‘মিউজ়িক্যাল চেয়ার’-এ বসানো হতে লাগল। মজার কথা,
আইন বাঁচিয়ে আচার্য আদৌ কাউকেই ‘উপাচার্য’ নিয়োগ করেননি— কেবল কোনও প্রফেসর বা অন্য কোনও ব্যক্তিকে উপাচার্যের ‘দায়িত্বভার’ দিয়েছেন মাত্র। ফলে হাই কোর্ট জানাল, এঁরা ‘ভারপ্রাপ্ত’ উপাচার্যমাত্র— পুরনো মাইনেই পাবেন, উপাচার্যের নয়। এই ভাবে আইন ও সংবিধান বহির্ভূত ভাবে একটি অশ্রুতপূর্ব পদের সৃষ্টি হল। ‘খিড়কি দরজা’ দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের মসনদ দখল হল।
সম্পূর্ণ ভাবে রাজ্য সরকারের অর্থে পোষিত বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি আচার্যচালিত ‘সমান্তরাল’ ব্যবস্থা চলতে থাকল।
কিন্তু তবু এত আনুগত্য সত্ত্বেও যাদবপুরে রাজ্য সরকারের অনুমতি সাপেক্ষে (যা আইন অনুযায়ী বাধ্যতামূলক) সমাবর্তন অনুষ্ঠান করে স্বল্পকালীন ‘ভারপ্রাপ্ত উপাচার্য’ মস্তকবিহীন হলেন। সম্প্রতি রাজ্যে শাসক-ঘনিষ্ঠ শিক্ষক সংগঠনের সম্মেলনের অনুমতি দিয়ে গৌড়বঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য-নিযুক্ত ‘ভারপ্রাপ্ত জন’ কোপে পড়ে চেয়ার হারালেও, রাজ্য সরকারের হস্তক্ষেপে তা পর দিনই ফিরে পান! সারা দেশে যে-বাংলা উচ্চশিক্ষায় পথপ্রদর্শক ছিল, তার সবচেয়ে সম্মানের পদটি ভূলুণ্ঠিত হয়ে আজ ‘প্রহসন’ হয়ে দাঁড়িয়েছে। যাদবপুর ও গৌড়বঙ্গের উদাহরণ দেখে রামনিধি গুপ্ত বা নিধুবাবুর একটি জনপ্রিয় টপ্পা গান মনে পড়ে, “অনুগত জনে কেন করো এত প্রবঞ্চনা, তুমি মারিলে মারিতে পারো, তবে রাখিতে কে করে মানা!”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy