Advertisement
২২ নভেম্বর ২০২৪
Environmental Awareness

পরিবেশ উপেক্ষার এই উন্নয়ন

উন্নয়ন ও পরিবেশের দ্বন্দ্বের বিষয়টি মান্যতা পেয়েছে আদালতের পর্যবেক্ষণে। আগামী প্রজন্মের জন্য বাস্তুতন্ত্র এবং পরিবেশ রক্ষা অত্যন্ত জরুরি।

A Photograph representing environmental problems due to development

পরিবেশের গুরুত্বকে উপেক্ষা করে গাছ কেটে উন্নয়নের ধারা বহাল সর্বত্র। ফাইল ছবি।

স্বর্ণাভ দেব
শেষ আপডেট: ২৩ মার্চ ২০২৩ ০৪:১৭
Share: Save:

পরিবেশ ও উন্নয়নের দ্বন্দ্ব চিরকালীন। পরিবেশের ক্ষতির ভয়ঙ্কর ফলাফল নিয়ে বিবিধ সতর্কবার্তা প্রকাশিত হচ্ছে। আবহাওয়া জানান দিচ্ছে যে, বিপদ সমাসন্ন। তবু পরিবেশের গুরুত্বকে কার্যত উপেক্ষা করে গাছ কেটে উন্নয়নের ধারা বহাল সর্বত্র। সম্প্রতি পশ্চিমবঙ্গের যশোর রোডে রেলের ওভারব্রিজ তৈরি এবং ১১২ নম্বর জাতীয় সড়কে বারাসত থেকে পেট্রাপোল সীমান্ত পর্যন্ত রাস্তা চওড়া করার জন্য শ’তিনেক গাছ কেটে ফেলার আবেদনে সায় দিয়েছে দেশের শীর্ষ আদালত।

২০১৮ সালে কলকাতা হাই কোর্ট যশোর রোড সংলগ্ন ওই গাছ কাটায় সম্মতি দিয়েছিল। সেই রায়ের বিরুদ্ধে আবেদন জানিয়ে সুপ্রিম কোর্টের দ্বারস্থ হয় পরিবেশ সংক্রান্ত সংগঠন ‘অ্যাসোসিয়েশন ফর প্রোটেকশন অব ডেমোক্র্যাটিক রাইটস’। প্রায় পাঁচ বছর হাই কোর্টের নির্দেশে স্থগিতাদেশ থাকার পরে সম্প্রতি সুপ্রিম কোর্ট গাছ কাটার পক্ষে রায় দিয়েছে। বিচারপতি বি আর গাভাই এবং বিচারপতি বিক্রম নাথের বেঞ্চ জানিয়েছে, পাঁচ বছর ধরে আটকে ওই প্রকল্প। যত দেরি হবে, প্রকল্পের খরচও তত বাড়বে। আদালতের বক্তব্য, গাছের সুরক্ষা অত্যন্ত জরুরি— কিন্তু ‘সেতু ভারতম্‌’ প্রকল্পের অধীনে ওই অংশে রেল ওভারব্রিজের প্রয়োজনীয়তাও উপেক্ষা করা সম্ভব নয়। অবশ্য উন্নয়ন ও পরিবেশের দ্বন্দ্বের বিষয়টি মান্যতা পেয়েছে আদালতের পর্যবেক্ষণে। সুপ্রিম কোর্টের বক্তব্য, আগামী প্রজন্মের জন্য বাস্তুতন্ত্র এবং পরিবেশ রক্ষা অত্যন্ত জরুরি। কিন্তু একই সঙ্গে উন্নয়নমূলক প্রকল্পও সচল রাখা খুব প্রয়োজন। শুধু আর্থিক উন্নতির জন্য নয়, নাগরিকদের সুরক্ষার বিষয়টিও উড়িয়ে দেওয়া যায় না। আদালতের রায়ের প্রতি সম্পূর্ণ শ্রদ্ধা বজায় রেখেও প্রশ্ন করা প্রয়োজন যে, পরিবেশকে যতখানি গুরুত্ব দেওয়া জরুরি, রাষ্ট্রীয় নীতি সেই গুরুত্ব দিতে প্রস্তুত কি?

একই ভাবে গত বছরের শেষে মুম্বই-আমদাবাদ বুলেট ট্রেনের জন্য মুম্বই, ঠাণে এবং পালঘরে প্রায় ২২ হাজার ম্যানগ্রোভ কেটে ফেলার সায় দিয়েছিল বম্বে হাই কোর্ট। এ ক্ষেত্রেও ম্যানগ্রোভ কেটে ফেলার তীব্র বিরোধিতা করেছিলেন পরিবেশবিদরা। সাড়ে ছ’ঘণ্টার যাত্রাপথ দু’ঘণ্টায় নামিয়ে আনার উদ্দেশ্যে বুলেট ট্রেনের ওই প্রকল্পের পক্ষে সওয়াল করা হলেও পরিবেশগত ক্ষয়ক্ষতি কি আদৌ সামাল দেওয়া যাবে? উঠছে প্রশ্ন। এ ক্ষেত্রে বুলেট ট্রেনের প্রকল্পে স্থগিতাদেশ চেয়েছিল ‘বম্বে এনভায়রনমেন্টাল অ্যাকশন গ্রুপ’ নামে একটি সংস্থা। তা খারিজ করেই ম্যানগ্রোভ কাটায় সম্মতি দিয়েছে আদালত।

জোশীমঠে কিছু দিন আগেই বাস্তুহারাদের চোখের জলের সাক্ষী গোটা দেশ। দেবভূমির একাংশ ধসে যাচ্ছে। তার কারণ অনুসন্ধানেও উঠে আসছে উন্নয়নের জন্য অপরিণামদর্শিতা। অপরিকল্পিত নগরায়ণের পাশাপাশি, সংবেদনশীল এই অঞ্চলে পাথর ফাটিয়ে রাস্তাঘাট, সুড়ঙ্গ তৈরির খেসারত দিতে হচ্ছে মানুষকে। এখানেও গাছ কেটে বাস্তুতন্ত্রের উপরে আঘাত করা হয়েছিল। জোশীমঠে ৬৬টিরও বেশি সুড়ঙ্গ তৈরি করা হয়েছে। তপোবন বিষ্ণুগড় জলবিদ্যুৎ প্রকল্প, চার ধাম রাস্তা প্রকল্প নিয়ে উঠছে অনেক প্রশ্ন।

গত পাঁচ দশকে পরিবেশবিদরা বার বার সতর্ক করে জানিয়েছেন, দিল্লি বা সমতলে যে গতিতে উন্নয়নের কাজ এগিয়ে নিয়ে চলা হয়েছে, হিমালয়ের মতো সংবেদনশীল অঞ্চলে সেই মডেল কার্যকর করা ঠিক হবে না। কিন্তু প্রশাসন সতর্কবাণী উপেক্ষা করেছে। নবীন ভঙ্গিল পর্বত হিমালয় সংলগ্ন অঞ্চল ভূমিকম্পপ্রবণ। ভারত-ইউরেশিয়া পাতের সংঘর্ষও এই অঞ্চলের স্থিতিশীলতার পক্ষে বড় বিপদ। ফলে এখানে উদ্বাহু উন্নয়নের চেষ্টা করলে তার মাসুল গুনতেই হবে। ইতিমধ্যেই ভূবিজ্ঞানীদের পূর্বাভাস, জোরালো ভূমিকম্পের আশঙ্কা রয়েছে উত্তরাখণ্ডে। শুধু জোশীমঠ নয়, ধর্মশালা থেকে অরুণাচল পর্যন্ত হিমালয়ের ওই অংশে বাণিজ্যিক স্বার্থ চরিতার্থ করতে আঘাত করা হচ্ছে প্রকৃতির উপরে। জোশীমঠের পরিস্থিতির পরে কি বোধোদয় হবে প্রশাসনের?

গত মাসেই সংসদে পরিবেশ প্রতিমন্ত্রী অশ্বিনী চৌবে জানিয়েছেন, গত তিন বছরে যে সমস্ত প্রকল্পকে পরিবেশগত ছাড়পত্র দেওয়া হয়েছে, তার মধ্যে রয়েছে হাইওয়ের ৩১টি, বন্দরের ১১টি, বিমানবন্দরের ১৫টি, নদী সংক্রান্ত ২০টি এবং তাপবিদ্যুৎ সংক্রান্ত ১০টি প্রকল্প। এর মধ্যে তিনটি হাইওয়ে প্রকল্পের জন্য প্রস্তাবিত বৃক্ষচ্ছেদনের পরিমাণ ২৩ লক্ষ। এ ক্ষেত্রে অবশ্য ক্ষতিপূরণ হিসাবে পাল্টা বৃক্ষরোপণের আশ্বাস দিয়েছেন পরিবেশমন্ত্রী। কিন্তু সংরক্ষিত অরণ্যে ওই বিপুল পরিমাণ গাছ কাটার ফলে বাস্তুতন্ত্রে যে প্রভাব পড়বে, তার কি ক্ষতিপূরণ সম্ভব? ইতিমধ্যেই দিল্লি-দেহরাদূন হাইওয়ের জন্য ১১ হাজার গাছ কাটার সম্মতি মিলেছে। করবেট টাইগার রিজ়ার্ভ-এ ১০ হাজার গাছ কাটা হয়েছে বলেও অভিযোগ। নিকোবর দ্বীপপুঞ্জেও উন্নয়নের বলি হতে চলেছে আট লক্ষ গাছ, যার মধ্যে রয়েছে ম্যানগ্রোভও। এই বিপুল পরিমাণ অরণ্যবিনাশের প্রভাব পড়তে চলেছে সেখানকার জনজাতিদের উপরেও।

পরিবেশ-উন্নয়ন দ্বন্দ্ব মেটাতে দাওয়াই হতে পারে সুস্থায়ী উন্নয়ন। এ ক্ষেত্রে প্রাকৃতিক পরিবেশের ভারসাম্য বজায় রেখেই আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের পরিকল্পনা গ্রহণ বাঞ্ছনীয়। আগাম ‘এনভায়রনমেন্টাল ইমপ্যাক্ট অ্যাসেসমেন্ট’, বা পরিবেশের উপরে কতখানি প্রভাব পড়ছে তার হিসাব করে তবেই ঠিক করতে হবে প্রকল্পে সবুজ সঙ্কেত দেওয়া হবে কি না। এই মডেলে দ্রুত বিপুল আর্থিক লাভ হয়তো সম্ভব নয়, কিন্তু দীর্ঘমেয়াদে লাভবান হবে দু’পক্ষই। বাঁচবে পরিবেশ, বজায় থাকবে মানবসমাজের অস্তিত্বও।

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy