হাওড়ার ২৪২টি শিশু শিক্ষা কেন্দ্রে শিক্ষক ৪০৫, শূন্য পদ ৫১২। ফাইল ছবি।
রেফার রোগ কি কেবল এ রাজ্যের হাসপাতালেই আছে? আছে এ রাজ্যের শিক্ষাতেও। সবচেয়ে প্রান্তিক শিশুদের স্কুলগুলো খাবি খাচ্ছে সেই রোগেই। ২০২০ সালে পঞ্চায়েত দফতর সেগুলোকে পাঠিয়েছিল শিক্ষা দফতরে, যাতে গরিবের ‘হাফ-স্কুল’ পুরোদস্তুর স্কুল হয়ে উঠতে পারে। বছর দুই কিচ্ছুটি করেনি শিক্ষা দফতর, সম্প্রতি ফাইল ফেরত পাঠিয়েছে পঞ্চায়েতে। পঞ্চায়েত দফতর অবশ্য এখনও ‘অ্যাডমিট’ করেনি— মানে, স্কুলগুলির দায়ভার স্বীকার করে চিঠি দেয়নি। ফলে, রাজ্যের সাড়ে পনেরো হাজার শিশু শিক্ষা কেন্দ্র (প্রি-প্রাইমারি থেকে চতুর্থ শ্রেণি) আর উনিশশো মাধ্যমিক শিক্ষা কেন্দ্র (পঞ্চম-অষ্টম শ্রেণি) প্রশাসন ব্যবস্থার করিডরে শুয়ে খাবি খাচ্ছে। “শেষ অবস্থায় ডাক্তারবাবুরা যেমন বলেন, ‘হাসপাতালে রেখে আর কী করবেন, বাড়ি নিয়ে যান’ সরকারও যেন তা-ই বলছে,” অভিমানের সুরে বললেন শিক্ষক সিরাজুল ইসলাম। তাঁর আন্দাজ, এমন চললে ২০৩০ সালের মধ্যে সব শিক্ষক-শিক্ষিকা অবসর নিয়ে নেবেন, দাঁড়িয়ে থাকবে কেবল কিছু বিল্ডিং। একটা গোটা রাজ্য কি তবে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সতেরো হাজার স্কুল মরে যেতে দেখবে?
তৃণমূল সরকার হয়তো মনে করে, এই স্কুলগুলোর প্রয়োজন ফুরিয়েছে। দলেই মেলে ভিন্ন মত। ওয়েস্ট বেঙ্গল তৃণমূল এসএসকে-এমএসকে ঐক্য মঞ্চের রাজ্য সভাপতি মুকুলেশ রহমান বিশ্বাস মুর্শিদাবাদের জানকীনাথ মাধ্যমিক শিক্ষা কেন্দ্রের শিক্ষক। বললেন, নওদা ব্লকে তাঁর স্কুলের পাঁচ কিলোমিটারের মধ্যে কোনও হাই স্কুল নেই। ছাত্রসংখ্যা ২১০। মুর্শিদাবাদে অন্তত ত্রিশটি মাধ্যমিক শিক্ষা কেন্দ্রের অবস্থান এমনই। “চারশোর বেশি ছাত্রছাত্রী, রাজ্যে এমন এমএসকে-ও রয়েছে। বন্ধ হলে পড়ুয়ারা যাবে কোথায়?” ঝাড়গ্রামের শিক্ষক কাঞ্চন মণ্ডল মনে করালেন, জঙ্গলমহলে লালগড়, বেলপাহাড়ির প্রত্যন্ত গ্রামগুলিতে শিশু শিক্ষা কেন্দ্র এখনও প্রাথমিক পাঠের প্রধান ভরসা। সারা রাজ্যে এই মুহূর্তে দশ লক্ষ পড়ুয়া রয়েছে পঞ্চায়েতের স্কুলগুলিতে। চার জনে তিন জনই মুসলিম বা দলিত-জনজাতি পরিবারের শিশু।
চাহিদা-জোগানের অঙ্কের বাইরে পা রাখলে বাবা-মায়ের পছন্দের ছাপটাও মেলে। যে জেলাতে এখন রাজ্য সরকারের প্রধান দফতর, সেই হাওড়ার শ্যামপুর ২ ব্লকের নোনাডাঙি ১ শিশু শিক্ষা কেন্দ্রে গিয়ে দেখা গেল, সেখানে পড়ুয়া ১৮৭। নিকটতম প্রাথমিক স্কুলটিতে পড়ুয়ার সংখ্যা ষাটের কিছু বেশি। দূরত্ব, রাস্তার হাল, শিক্ষকের সহৃদয় ব্যবহার— যে কারণেই হোক না কেন, সংখ্যালঘু-প্রধান দু’টি গ্রাম (কামিনা, নোনাডাঙি) থেকে অভিভাবকরা সন্তান পাঠাচ্ছেন শিশু শিক্ষা কেন্দ্রেই। দোতলায় ক্লাস থ্রি-ফোর সামলাচ্ছেন এক জন সহায়িকা, নীচে প্রি-প্রাইমারির কচি-কাঁচাদের এক জন, আর এক জন ক্লাস ওয়ান-টু। “গত বছরও চার জন শিক্ষক ছিলাম। ব্লকে এক জনকে যেতে হলে দোতলায় এক জন, একতলায় এক জন হয়ে যাই। পড়াতে খুব অসুবিধে,” বললেন আমিনা খাতুন। খানিক দূরে নোনাডাঙি ২ কেন্দ্রে পড়ুয়া ১২৯, সহায়িকা দু’জন। “পড়াশোনার চাইতে গন্ডগোলই বেশি হয়,” বললেন সহায়িকা রূপালী সামন্ত হাজরা। শ্যামপুর ১ ব্লকের কামদেবপুরে শিশু শিক্ষা কেন্দ্রটি থেকে প্রাথমিক স্কুলের দূরত্ব দু’কিলোমিটার। আশেপাশের নব্বই জন শিশু আসে শিক্ষা কেন্দ্রে। সহায়িকা বিভা খাটুয়া জানালেন, দুই সহায়িকার এক জনের অবসর আগামী বছর, অন্য জন ২০২৫। “মনে হয়, কেন্দ্রটা বন্ধ হয়ে যাবে।” হাওড়ার ২৪২টি শিশু শিক্ষা কেন্দ্রে শিক্ষক ৪০৫, শূন্য পদ ৫১২। পঞ্চায়েত দফতরের এক আধিকারিকের স্বীকারোক্তি, ২০১০ সালের পর রাজ্যে কোথাও শিক্ষক নিয়োগ হয়নি পঞ্চায়েত-পরিচালিত স্কুলগুলিতে। প্রায় পাঁচশো শিশু শিক্ষা কেন্দ্র বন্ধ হয়েছে, ছ’-সাত লক্ষ পড়ুয়া কমেছে। শিক্ষকের শূন্য পদ অন্তত ন’হাজার।
প্রাথমিক শিক্ষাকে সকলের নাগালে আনতে ১৯৯৭-এ শুরু হয়েছিল যে কর্মসূচি, এই তার পরিণতি। দু’তিন কিলোমিটারের মধ্যে স্কুল নেই, এমন এলাকায় শিক্ষা কেন্দ্র খোলার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল বাম আমলের পঞ্চায়েত দফতর। দেখা গেল, সেগুলো অধিকাংশই মুসলিম-প্রধান, বা দলিত-জনজাতি প্রধান এলাকা। সামান্য বেতনে (এক হাজার টাকা) স্থানীয় মহিলারা নিযুক্ত হলেন ‘সহায়িকা’ পদে। সেকেন্ড ক্লাস কামরার টিকিট, তাতেই উঠতে কী উৎসাহ! ১৯৯৭ সালে মাত্র হাজারটা শিশু শিক্ষা কেন্দ্র দিয়ে সূচনা, দশ বছরের মধ্যে কেন্দ্রের সংখ্যা দাঁড়াল ষোলো হাজারে। চাহিদার চাপে ২০০৩ সালে খুলতে হল ‘মাধ্যমিক শিক্ষা কেন্দ্র’। ২০০৭ সালে পঞ্চায়েতের স্কুলে পড়ুয়া ছিল প্রায় পনেরো লক্ষ, মোট স্কুলপড়ুয়ার পনেরো শতাংশ। প্রতীচী ট্রাস্ট তার প্রথম শিক্ষা রিপোর্টে (২০০২) বলেছিল, সহায়িকাদের যত্ন ও আগ্রহের জন্য অনেক শিশু শিক্ষা কেন্দ্রে পড়ার মান প্রাথমিক স্কুলের চেয়ে ভাল।
২০০৯ সালে শিক্ষার অধিকার আইন যখন নির্দেশ দিল, জনপদের এক কিলোমিটারের মধ্যে প্রাথমিক, তিন কিলোমিটারের মধ্যে উচ্চ-প্রাথমিক বিদ্যালয় থাকা চাই, তখন বামফ্রন্ট সরকার শিক্ষা কেন্দ্রগুলিকেও ‘স্কুল’ বলে দাবি করল। কিন্তু ‘স্কুল’ বলে গণ্য হওয়ার অন্যতম শর্ত— প্রশিক্ষিত শিক্ষক নিয়োগ— মানল না। সহায়িকা, সম্প্রসারক দিয়েই চলতে লাগল পঞ্চায়েতের স্কুল, শিক্ষার অধিকার আইন অমান্য করে। তৃণমূল সরকার ২০১৩ সালে মন্ত্রিসভায় সিদ্ধান্ত নেয়, পঞ্চায়েতের স্কুল যাবে শিক্ষা দফতরে। গড়িমসি করে শেষে ২০২০ সালের জানুয়ারিতে শিক্ষা দফতর হাতে নিল, ফিরিয়ে দিল ডিসেম্বর, ২০২২-এ। “আমি হতাশ,” বললেন হাওড়া জেলা পরিষদের শিক্ষা কর্মাধ্যক্ষ শ্রীধর মণ্ডল। “আমি চাই, ফাঁকা পদে এখনই নিয়োগ করুক সরকার।” তাঁর আক্ষেপ, দলের মন্ত্রী-বিধায়কদের কাছে দরবার করেও ‘ফিডব্যাক’ মেলেনি।
দরিদ্র শিশুর পঠনপাঠনের সুযোগের নিরিখে সম্ভবত নিয়োগে দুর্নীতির চাইতেও ক্ষতিকর তৃণমূলের শিক্ষানীতির দিশাহীনতা। বাম আমলে পঞ্চায়েতের স্কুলগুলির জন্য পৃথক বোর্ড তৈরির আইন পাশ করার উদ্যোগ বানচাল করেছিল তৃণমূল। সব বিদ্যালয়কে একটিই ব্যবস্থার অধীনে আনার অঙ্গীকার করেছিল। দশ বছরেও তা পারল না। বার বার ফাইল চালাচালি হয়েছে পঞ্চায়েত দফতর আর শিক্ষা দফতরের মধ্যে। পঞ্চায়েতের স্কুলের দশা আজ কৃষ্ণনগরের মাটির সন্দেশের মতো। বাইরে থেকে মনে হয় বিদ্যালয়— বিল্ডিং আছে, বই-ব্যাগ বিলি হচ্ছে, মিড-ডে মিল চলছে। ভিতরে ফক্কা— দশ-বারো বছর এক জনও শিক্ষক না-নিয়োগের শূন্যতা। তাচ্ছিল্যের ধুলোবালি চিবিয়ে শিশুরা ফিরে যাচ্ছে, আর আসছে না।
মধ্যবিত্তের সঙ্গে সরকারি স্কুলের সম্পর্ক যে-হেতু চাকরি আর ঠিকাদারির, আর পশ্চিমবঙ্গে শাসক-বিরোধিতার বয়ান যে-হেতু তৈরি করে মধ্যবিত্ত, তাই পঞ্চায়েত-পরিচালিত স্কুলগুলোর কী হবে, সে কথা ভোটের আগেও উঠছে না। শিক্ষা-সঙ্কট বলতে মিডিয়া বোঝে নিয়োগ-দুর্নীতি। ক্যামেরার সামনে টেট পাশ প্রার্থীরা, যাঁরা ছ’শো দিন অবস্থানে বসে। সন্তানের স্কুলে শিক্ষক নিয়োগের দাবিতে শ্রমজীবী বাপ-মায়ের পক্ষে ছ’দিনও অবস্থান করা অসম্ভব। তাঁরা নীরবে সন্তানকে ভর্তি করছেন বেসরকারি স্কুলে, টিউশনিতে, নইলে হাল ছেড়ে দিচ্ছেন। তাঁদের মুখের সামনে মাইক ধরে নেই কেউ। নইলে, পঞ্চায়েতে রাস্তা তৈরির জন্য হাজার কোটি টাকা দেওয়ার ঘোষণা শুনে তাঁরা হয়তো রাজ্য সরকারকে প্রশ্ন করতেন, আর পঞ্চায়েতের স্কুলের জন্য?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy