জলশূন্য ভূগর্ভ, উর্বরতাশূন্য জমি, নির্বাচনী প্রচারসভার বাইরে দাঁড়িয়ে রয়েছে। —ফাইল চিত্র।
নদীর জন্য চাইছি ভোট— এই স্লোগান নিয়ে ভোটের ময়দানে নেমেছেন তারক ঘোষ। তিনি নদিয়া জেলা পরিষদের ২৪ নম্বর আসনের নির্দল প্রার্থী। জলঙ্গি নদী বাঁচানোর জন্য আন্দোলনরত সংগঠন ‘জলঙ্গি নদী সমাজ’ তাঁকে মনোনীত করেছে। কেন দাঁড়ালেন ভোটে? তারকবাবুর বক্তব্য, তিনি ছিলেন চাষি। জলঙ্গি নদী প্রায় মরে গিয়েছে, মাটির তলার জল এত নীচে নেমে গিয়েছে যে, সেচের খরচ পোষাচ্ছে না। চাষ ছেড়ে এখন রং-মিস্ত্রি হয়েছেন তারকবাবু। “আমার মতো গ্রামে অনেকে আছে। নদীকে বাঁচাতে ভোটে দাঁড়িয়েছি।”
নদী, জলাশয়, জলাভূমি বাঁচাতে হবে, এই দাবিতে বার হয়েছে একটি ইস্তাহারও। রাজ্যের একশো দশটি পরিবেশ সুরক্ষা সংগঠনের তৈরি ‘সবুজ মঞ্চ’ এই ইস্তাহারে বলেছে, পুর আবর্জনা, কলকারখানার বিষাক্ত বর্জ্য, চাষে ব্যবহৃত কীটনাশক দূষণ তৈরি করছে নদীতে। জাতীয় পরিবেশ আদালত রাজ্যের সতেরোটি চরম দূষিত নদীর সংস্কার করার নির্দেশ দিয়েছে। কিন্তু সে কাজ এমনই ধীর গতিতে চলছে যে, কয়েকটি নদীতে দূষণ আরও বেড়েছে। “বিভিন্ন এলাকায় নদীর খাত থেকে অপরিমিত বালি খননের ফলে নদীগুলি ধ্বংস হচ্ছে। নদীর খাত দখল করে চাষাবাদ, ইটভাটা তৈরি, বাড়িঘর নির্মাণ, নিবিড় চিংড়ি চাষ নদীগুলির মৃত্যুঘণ্টা বাজাচ্ছে,” লেখা হয়েছে ওই ইস্তাহারে। যেখানে স্থানীয় উদ্যোগে করা হয়েছে, সেখানে ফল মিলেছে। যেমন, নদিয়ার চাকদহে মৎস্যজীবীরা পরিবেশকর্মীদের সঙ্গে জোট বেঁধে প্রশাসনকে বাধ্য করেছে, মৃতপ্রায় বুড়িগঙ্গাকে পুনরুজ্জীবিত করার প্রকল্প কার্যকর করতে।
ওই ইস্তাহারের দাবি, পঞ্চায়েত প্রার্থীদের নদী, জলাভূমি, জলাশয়গুলিকে বাঁচানোর পাশাপাশি, প্রতিটি পঞ্চায়েত এলাকায় জলসম্পদের তালিকা তৈরির প্রতিশ্রুতি দিতে হবে। নদী, খালগুলির সীমানা চিহ্নিত করে, দখলমুক্ত করে সংস্কারের উদ্যোগ করতে হবে। জলাশয় বুজিয়ে ফেলার প্রবণতা বন্ধ করে, সেগুলির সংরক্ষণে গুরুত্ব দেওয়ার দাবি প্রার্থীদের কাছে যেন করেন গ্রামবাসী, বলছে ইস্তাহার।
পরিবেশকর্মীদের চাপে বিধানসভা ভোটের আগেও বিভিন্ন দল পরিবেশ সুরক্ষার কিছু কথা ঢুকিয়েছিল ইস্তাহারে। কাজ কিছু হয়নি। এই নিষ্ক্রিয়তার ফল ভুগছেন গ্রামবাসী, মনে করেন পরিবেশকর্মী নব দত্ত। “গত দশ বছরে পঞ্চায়েত এলাকায় আবর্জনা থেকে দূষণ বেড়েছে। জলাশয়, নদীর দূষণের ফলে মৎস্যচাষিরা কাজ হারিয়েছেন। স্টোন ক্রাশার বসানো, নাড়া পোড়ানো, ভূগর্ভস্থ জলের অপরিমিত ব্যবহার, বোতলের জলের ব্যবসা বেড়ে যাওয়া, বন কেটে ফেলা, মাটির উপরিভাগ কেটে নিয়ে যত্রতত্র বেআইনি ইটভাটা, এ সব অনেক গুণ বেড়েছে।” বহু ক্ষেত্রে দূষণকারী বর্জ্য বা শিল্প শহর থেকে গ্রামে চালান হয়ে যাচ্ছে, গ্রাম পঞ্চায়েত এলাকায় আইনের কাঠামো দুর্বল বলে।
পরিবেশের অনেক প্রশ্নে রাজ্যের নীতি অস্বচ্ছ। যেমন, নদী রয়েছে তিনটে দফতরের অধীনে— সেচ, মৎস্য ও ভূমি। নদী দখল করে অবৈধ নির্মাণ তৈরি হলে যদি অভিযোগ করা হয় সেচ দফতরে, তা হলে উত্তর আসে, দখলের বিষয়টি দেখবে ভূমি দফতর। এই দফতরগুলোর মধ্যে সমন্বয় নেই। ফলে, কাজ আটকে থাকে লাল ফিতের ফাঁসে, অবৈধ কারবার চলতে থাকে। স্বাধীনতা সংগ্রামী পান্নালাল দাশগুপ্ত বলেছিলেন, আলাদা একটি ‘নদী দফতর’ তৈরি হওয়া দরকার। তা হল কোথায়? নদীর সুরক্ষা নিয়ে একটা কমিটি বা কমিশনও নেই। তেমনই, একশো দিনের কাজের প্রকল্পের অধীনে ব্যক্তিগত পুকুর সংস্কার খারিজ করে দিয়েছে কেন্দ্র। ফলে, পশ্চিমবঙ্গের অধিকাংশ পুকুর সংস্কারের অভাবে জলধারণ ক্ষমতা হারাচ্ছে।
নির্বাচনকে কেন্দ্র করে যখন জেলায় জেলায় হিংসার আগুন জ্বলছে, তখন পরিবেশের সুরক্ষাকে ভোটের রাজনীতিতে টেনে আনার চেষ্টা অলীক মনে হতে পারে। অথচ পশ্চিমে বামপন্থী রাজনীতি থেকেই জন্ম নিয়েছিল পরিবেশবাদী রাজনৈতিক দলগুলো। জার্মানিতে গ্রিন পার্টি (সূচনা ১৯৭৯) সবচেয়ে শক্তিশালী, তবে কানাডা, আর্জেন্টিনা, চিলি, নিউ জ়িল্যান্ডের মতো দেশেও তাদের প্রভাব যথেষ্ট। ভারতে নাগরিক সংগঠনগুলিই প্রধানত নদী ও জলের সুরক্ষা নিয়ে সরব, যদিও তাদের স্বর কতটুকু পৌঁছয় সরকারের কানে সে প্রশ্ন থেকে যায়— গঙ্গাকে দূষণমুক্ত করার দাবিতে বৃদ্ধ অধ্যাপক জি ডি আগরওয়ালের অনশন শেষ হয় তাঁর মৃত্যুতে (২০১৮), গঙ্গার দূষণ আজও অপ্রতিহত।
রাজনীতির উঠোনে যত ক্ষণ না কোনও বিষয় উঠে এসেছে, তত ক্ষণ তা নিয়ে রাষ্ট্র মাথা ঘামায়নি। নারী-নির্যাতন, শিশুমৃত্যু, দলিত-জনজাতির উপর নিপীড়ন, এমন অনেক বিষয় ভোটের রাজনীতিতে আসার পরেই রাষ্ট্র প্রতিকারে বাধ্য হয়েছে। বামফ্রন্টের শাসন কালে বিজ্ঞান প্রসারের জন্য একটি মঞ্চ থাকলেও, তার সদস্যরা কুসংস্কার দূরীকরণ, ও সাপের কামড়ের প্রতিকারের প্রচারের মধ্যেই নিজেদের সীমাবদ্ধ রেখেছিলেন। পরিবেশ সুরক্ষা তেমন গুরুত্ব পায়নি। তবে পরিবেশ মানে যে কেবল গাছ লাগানো নয়, তার সঙ্গে জীবন-জীবিকার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে, এই বোধ এখন অনেকটাই তৈরি হয়েছে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে, যেমন কঠিন বর্জ্য প্রক্রিয়াকরণ, বা পুনর্ব্যবহার-অযোগ্য প্লাস্টিক নিয়ন্ত্রণে শহরে কিছুটা কাজ এগোলেও, গ্রামে প্রায় কোনও কাজই হয়নি। জলশূন্য ভূগর্ভ, উর্বরতাশূন্য জমি, নির্বাচনী প্রচারসভার বাইরে দাঁড়িয়ে রয়েছে। প্রচারের মঞ্চে উঠতে পারেনি আজও।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy