মূল্যবোধ: সংবাদমাধ্যমের সামনে শাহরুখ খান, দীপিকা পাড়ুকোন ও জন আব্রাহাম, মুম্বই, ৩০ জানুয়ারি। পিটিআই
ভারতমাতার তিন সন্তান যদি কোনও কারণে হারিয়ে যায়, তা হলে বড় হয়ে তারা অবধারিত ভাবে কেউ অমর, কেউ আকবর আর কেউ অ্যান্টনি হবে! বলিউড এই শিক্ষাটা চিরকাল দিয়ে এসেছে। নিজের কাজকর্মের পরিধিতেও এই নীতি সে গোড়া থেকে মেনে এসেছে। জাত-ধর্ম-যৌন রুচি কোনও দিন সেখানে কাজের অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়নি। ‘সবারে করি আহ্বান’ই তার সনাতন ধর্ম হয়ে থেকেছে বরাবর। এই সনাতনি বলিউডের ডিএনএ বদলে দেওয়ার চেষ্টা সফল হবে কি না, সেটা অনেকটা নির্ভর করছিল শাহরুখ খানের নতুন ছবিকে ঘিরে। পঠানের চোখধাঁধানো সাফল্যের পরে প্রথম সাংবাদিক বৈঠকে শাহরুখ নিজে সেই অমর-আকবর-অ্যান্টনির প্রসঙ্গই তুললেন। দীপিকা পাড়ুকোনকে দেখিয়ে বললেন, “এই হল অমর। আমি আকবর আর জন আব্রাহাম অ্যান্টনি। এর মধ্যে কোনও ভেদাভেদ নেই।”
২৬ জানুয়ারির দিন টুইটারের বার্তায় দেশের সংবিধানের মূল্যবোধের কথা মনে করিয়েছিলেন শাহরুখ। ৩০ জানুয়ারি, গান্ধীজির মৃত্যুদিবসে, ভারত জোড়ো যাত্রার সমাপ্তি দিবসে তাঁর মুখে সরাসরি বিভাজনের বিরুদ্ধে বার্তা ধ্বনিত হল। বলিউডকে তার কক্ষপথে ফিরিয়ে আনাটাই যে তাঁর সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ ছিল, শাহরুখের কথা থেকে পরোক্ষে সেটাই ঠিকরে বেরোল। দীপিকা তখন চোখের জল মুছছিলেন। জেএনইউ-তে যাওয়ার খেসারত তো এত দিন তাঁকেও চোকাতে হয়েছে! পঠান তাঁকেও নতুন করে অনেকখানি অক্সিজেন দিল।
এ বারের বয়কট-খেলাটা যে হিতে বিপরীত হতে পারে, সেটা বুঝে সবার আগে সাবধানবাণী শুনিয়েছিলেন কিন্তু প্রধানমন্ত্রী স্বয়ং। বিজেপির জাতীয় কর্মসমিতির বৈঠকে নরেন্দ্র মোদী সম্প্রতি দলীয় কর্মীদের বলেছিলেন, কোনও সিনেমা সম্পর্কে অপ্রয়োজনীয় মন্তব্য না করতে। পঠান তখনও মুক্তি পায়নি। বয়কট বাহিনী এবং ট্রোল সেনানী ময়দান ছাড়েনি। কিন্তু ছবিটা হিট করে যেতে পারে, এমন একটা সম্ভাবনা তখন থেকেই বাতাসে ভাসছিল। ‘বেশরম বিকিনি’ ঘিরে গণছিছিক্কার তৈরির চেষ্টা যে হালে তেমন পানি পাচ্ছে না, সেটা ক্রমশ স্পষ্ট হয়ে আসছিল। পঠান বক্স অফিসে সুনামি তৈরি করার পরে অনুপম খেররা এখন যেমন কিছুটা ভিন্ন সুরে কথা বলার চেষ্টা করছেন, তাতে মনে হয়, দেওয়াল লিখনটা সবার আগে পড়তে পেরেছিলেন প্রধানমন্ত্রীই। তাই আগেভাগেই সতর্কবার্তা শুনিয়ে রেখে পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার সুযোগ তৈরি করে রেখেছিলেন। বলিউডের ভক্ত-ব্রিগেড এ জন্য তাঁকে ধন্যবাদ দিতে পারেন। দিচ্ছেনও। অক্ষয়কুমার যেমন জোর গলায় বলছেন, প্রধানমন্ত্রীই বলিউডের পাশে দাঁড়িয়েছেন। তিনিই বয়কটের বিরুদ্ধে বার্তা দিয়েছেন! এখন তথ্যসম্প্রচার মন্ত্রী অনুরাগ ঠাকুরও খোলাখুলি বলছেন, বয়কট সংস্কৃতি নাকি খুব খারাপ জিনিস! পরিবেশকে নাকি বিষিয়ে দেয়!
তাই? এত দিন ধরে পর পর ছবি ঘিরে যখন বয়কটের ডাক উঠছিল, তখন কোথায় ছিলেন তিনি, তাঁরা? এ বার মধ্যপ্রদেশের মন্ত্রী নরোত্তম মিশ্র যখন হুমকি দিচ্ছিলেন, পঠান-এর মতো কদর্য ছবিকে রিলিজ় করতে দেওয়াই উচিত নয়, কোথায় ছিলেন? পঠান রিলিজ়ের দিন যখন ভোপালে, ইন্দোরে, ফরিদাবাদে, বেলাগাভিতে শো বানচাল করার চেষ্টা হল, কোথায় ছিলেন সে দিন? সুশান্ত সিংহ রাজপুতের মৃত্যু থেকে লতা মঙ্গেশকরের অন্ত্যেষ্টি, অসহিষ্ণুতা নিয়ে বিবৃতি থেকে মাদক মামলা— বিভিন্ন ইসুতে যখন ব্যক্তি আক্রমণে বিদ্ধ করা হচ্ছিল শাহরুখ এবং আরও অনেককেই— কোথায় ছিলেন? মাদক মামলায় দীপিকার জিজ্ঞাসাবাদকে ঘিরে যে পরিমাণ বিষ ছড়ানো হয়েছিল, কোথায় ছিলেন তখন? ‘দেশকে গদ্দারোঁকো’ বলে স্লোগান তুলতে ব্যস্ত ছিলেন নিশ্চয়!
পঠান দেখানোর জন্য দেশ জুড়ে যে ২৫টি সিঙ্গল স্ক্রিন সিনেমা হল নতুন করে খুলল, তার মধ্যে ১১টি কিন্তু উত্তরপ্রদেশে। যোগী আদিত্যনাথ নিশ্চয় বুঝে নিয়েছিলেন, বাধা দিলে বিপদ বেশি। তাই চুপচাপ ছিলেন। সেই যোগী, যিনি ২০১৫ সালে শাহরুখ ‘দেশে অসহিষ্ণুতা বাড়ছে’ বলে মন্তব্য করায় বলেছিলেন, শাহরুখ খানের ভাষা আর লস্কর জঙ্গি হাফিজ সইদের ভাষার মধ্যে কোনও তফাত নেই। এ বার শেষ বেলায় অসমে হিমন্তবিশ্ব শর্মা তবু কিছুটা হাঁকডাক করে, ‘কে শাহরুখ, দরকার হলে ফোন করুক’ ইত্যাদি বলে বাজার গরম করার চেষ্টা করেছিলেন, খুব একটা লাভ হয়নি। শাহরুখ যেন ঠিক করেই রেখেছিলেন, কোনও রকম প্ররোচনায় পা দেবেন না। লক্ষ্মী ছেলের মতো তিনি হিমন্তকে ফোন করে নেন, অসমে ছবি চলতে যাতে সমস্যা না হয়, সেটা দেখার জন্য হিমন্তকে অনুরোধ করেন।
বস্তুত এই গোটা পর্বটা জুড়ে আশ্চর্য ঠান্ডা মাথার পরিচয় দিলেন শাহরুখ। কোনও রকম উত্তর-প্রত্যুত্তর-বিতর্কে গেলেন না। ধামাধরা মিডিয়ার ধার না ধেরে কোনও রকম প্রচারই করলেন না ছবিটার। শুধু টুইটারে ট্রোল বাহিনীকে প্রায় সম্মুখসমরে আহ্বান করার ভঙ্গিতে সরাসরি প্রশ্নোত্তরের আসর বসিয়ে দিলেন। যাবতীয় অস্বস্তিকর প্রশ্ন উইটের ঝড়ে উড়িয়ে দিলেন ফুৎকারে। ‘অপনি কুর্সিকে পেটি বাঁধ লো, মৌসম বিগড়নেওয়ালা হ্যায়’— এই সংলাপ যেন পরোক্ষ চ্যালেঞ্জ হয়ে ঝলসে উঠল ঘৃণার কারবারিদের প্রতি। চিত্রপরিচালক অনুরাগ কাশ্যপ তাই বলছিলেন, “বলিউডের সবচেয়ে মজবুত মেরুদণ্ডওয়ালা লোকটি, সবচেয়ে লড়াকু আর আপসহীন লোকটি এত দিন শান্ত ছিলেন। এ বার তিনি কথা বললেন। নিজের কাজের মধ্য দিয়েই কথা বললেন।”
তাই পঠান আর নিছক একটা ছবি রইল না, হয়ে উঠল একটা বিবৃতি। একেবারে সাতসকাল থেকে শো শুরু হচ্ছে, আর মানুষ দলে দলে হল ভরিয়ে দিচ্ছেন— এমন ঘটনা আর কবে ঘটেছে? সিনেমা দেখাটা প্রায় জাতীয় উৎসবের চেহারা নিচ্ছে, কত দিন পরে দেখা গেল এই দৃশ্য? বক্স অফিসে সফল হওয়াটা শুধু নয়, যে বাঁধভাঙা উচ্ছ্বাসকে সঙ্গী করে সেই সাফল্য এল, পঠান-এর সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি এটাই। পাকিস্তান, কাশ্মীর, অনুচ্ছেদ ৩৭০-এর মতো চড়া জাতীয়তাবাদী উপাদান ব্যবহার করার পরেও পঠান-এর মূল সুরটা ঘৃণার নয়, শত্রুতার নয়। বরং বন্ধুত্বের, মন বদলের, আস্থার। দেশভক্তির চালু ছকের অ্যাকশন-ধামাকা হয়েও পঠান-এর সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য এটাই। শাহরুখ সারা জীবন ধরে পর্দায় যে ভালবাসার রূপকথা তৈরি করে এসেছেন, পঠান তার চেয়ে আলাদা হয়েও পুরোপুরি আলাদা হতে পারেনি, পঠান-এ সবচেয়ে বড় ভরসা এটাই।
এত কাল শাহরুখকে দেশদ্রোহী প্রমাণ করার প্রাণপণ চেষ্টায় যাঁরা উঠেপড়ে লেগেছিলেন, আজ পর্দায় তাঁদেরই অনেকে শাহরুখকে ‘জয় হিন্দ’ বলতে শুনে শিহরিত হচ্ছেন। তাঁরা হয়তো মনে রাখেননি, শাহরুখের বাবা মির তাজ মহম্মদ খান স্বাধীনতা সংগ্রামী ছিলেন। সীমান্ত গান্ধী খান আব্দুল গফ্ফর খানের সহযোগী তিনি। বাবার নিকটাত্মীয় ছিলেন আজ়াদ হিন্দ ফৌজের মেজর জেনারেল শাহনওয়াজ খান। দেশপ্রেমের পরীক্ষাই যদি দিতে হয়, আজকের স্বঘোষিত দেশভক্তেরা বেশির ভাগই শাহরুখের লিগাসির কাছে ফেল মেরে যাবেন!
ডিসেম্বরে কলকাতা চলচ্চিত্র উৎসবের উদ্বোধনে এসে শাহরুখ একটা খুব তাৎপর্যপূর্ণ কথা বলেছিলেন। বলে গিয়েছিলেন, সোশাল মিডিয়ার একটা বড় অংশ জুড়ে যখন লাগাতার নেতিবাচকতার চাষ হচ্ছে, তখন সিনেমাকে এগিয়ে আসতে হবে সমানুভূতি, একতা আর সৌভ্রাত্রের গল্প বলার জন্য। বিদ্বেষ আর বিভাজনের পটভূমিতে সিনেমার একটা মিলনাত্মক ভূমিকার প্রয়োজনীয়তার কথা বলেছিলেন তিনি। পঠান সেই কাজটাই অনেকাংশে করে দেখিয়েছে। ভালবাসার তারকা আর তাঁর জনপ্রিয় ছবিকে কেন্দ্র করে রচিত হয়েছে আর এক ভারত জোড়ো যাত্রা। অতিমারির পরে যৌথতার উদ্যাপনে মানুষের ঝোঁক এমনিতেই বেড়েছে। সেটা গত বছর থেকেই বোঝা যাচ্ছিল। সিনেমা দেখে এক সঙ্গে হাসা, এক সঙ্গে নাচা, এক সঙ্গে গলা ফাটানোর আনন্দ ফিরে পেতে এখন সবাই নতুন করে উন্মুখ। পুরনো চাল ভাতে বাড়ার মতো করেই তাই পঠান দেশ জুড়ে এক স্বতঃস্ফূর্ত মানব-শৃঙ্খল তৈরি করে ফেলল।
এ সবের পরেও বয়কট-ট্রোল রাতারাতি বন্ধ হয়ে যাবে, এমন আশা নিশ্চয় করা যায় না। কঙ্গনা রানাউত যেমন ঘৃণাভাষণ জারিই রেখেছেন। কিন্তু এগুলোর সঙ্গে চোখে চোখ রেখে লড়া যে যায়, সেটা শাহরুখ করে দেখিয়েছেন। এর পর ট্রোল বাহিনীকে দেখলে ঠোঁট বেঁকিয়ে বলে দেওয়া যাবে, বড়ে বড়ে দেশোমে অ্যায়সে ছোটি ছোটি বাতেঁ হোতে হি রহতে হ্যায়! দূর হ নচ্ছারেরা!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy