আলকাতরার অনেক গুণ। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা তাকে প্রয়োজনীয় ওষুধের তালিকায় রেখেছে। খুশকি এবং চর্মরোগ সারানোর কাজে লাগে। ফলে বিরোধীদের গায়ে আলকাতরা লাগলে এবং এমন অসুখ থাকলে সেরে যাবে।
কয়লা পুড়িয়ে তৈরি আলকাতরা রাস্তাঘাট তৈরির কাজে লাগে। বারে বারে লাগে। রাস্তা ভেঙে গিয়েছে, একটু ইট, খোয়া দিয়ে দুমদুম করে পিটিয়ে দিন, আর অনেকখানি পিচ ঢেলে দিন। ১০০ শতাংশ নিশ্চয়তা— সাত দিনের মধ্যে আবার ভাঙবে। আবার আলকাতরা, আবার টাকা। টাকা শক্তির উৎস, আলকাতরা টাকার উৎস অর্থাৎ শক্তির উৎস। বাড়ির ছাদের ফুটোফাটা ঢেকে জল পড়া বন্ধ করতে আলকাতরার ব্যবহার অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। ফলে ‘আমার হাতেও আলকাতরা আছে’ শুনে এত নিন্দেমন্দ করার কোনও যুক্তিই নেই।
যেমন ‘ধর, ধর ওই চোর, ওই চোর’ বলে এত লাফালাফিরও কিছু নেই। না বলে পরের দ্রব্য নিলে তাকে চুরি করা বলে। তা পরের দ্রব্য নেওয়ার আগে নিজের ভেবে নিলেই হল। আগে রেলের সম্পত্তিরক্ষায় লেখা থাকত— রেল আপনার, যত্ন করুন, রক্ষা করুন গোছের কথা, কিন্তু তার পর নিজের ভেবে রেলের কামরায় ইচ্ছেমতো লেখালিখি শুরু হয়ে গেল, বাথরুমের মগ পর্যন্ত হাপিশ হয়ে গেল। অর্থাৎ আমাদের করের টাকায় যে সম্পত্তি, তা নিয়ে আমরা যা খুশি করতে পারি।
রাজনীতির চরিতামৃতও তাই। ‘গভর্নমেন্ট অব দ্য পিপল, ফর দ্য পিপল, বাই দ্য পিপল’। তা-ই যদি হয়, জনগণের সরকারের মন্ত্রী হয়ে জনগণের টাকা আমার বলে লুটেপুটে নিতে পারব না? এ তো আমার টাকা, আমার হক। রেশনের চাল, হাসপাতালের বেড, রাস্তাঘাট, সরকারি প্রকল্প, কলেজে ভর্তি, স্কুলের চাকরি, বদলি— জনগণের কিছুই স্বাভাবিক অধিকার নয়, কিছুই মৌলিক অধিকার নয়, ক্ষমতার পায়ে পুষ্পাঞ্জলি না দিলে তুমি কিচ্ছুটি পাবে না। এই যদি আমার মনোভাব হয়, তা হলে যেখানে পাব, সেখানেই জনগণের টাকা হকের টাকা মনে করে চেটেপুটে লুট করব। অর্থাৎ আমি খাব। রাস্তা সারাইয়ে খাব, নতুন বাড়ি করলে খাব, বাড়ি রং করলে খাব, কারখানা করলে খাব, আর চাকরি চাইলে তো খাবই। কারণ, আমি জনগণের প্রতিনিধি, আমার অসীম ক্ষমতা। আমার গায়ে হাত দেবে কে? জনগণের টাকা আমার টাকা। তবে এ বার এমন খেয়েছি যে বদহজম হয়ে গিয়েছে। হড় হড় করে সব বেরিয়ে পড়েছে। ক্ষমতার দম্ভের বদহজম তো এমনই হয়।
স্থানীয় পুরপ্রতিনিধি আগে থাকতেন মাটির ঘরে, নতুন দল ক্ষমতায় আসার পর তিনি একাধিকবার কাউন্সিলর হয়েছেন, এখন তাঁর তিনতলা বাড়ি। তাঁর এলাকায় ফুটপাতে পেভার ব্লক বসেছে, অটোর অপেক্ষায় দাঁড়ানোর জন্য ছাউনি হয়েছে, কল বসেছে, আমরা তাতেই ধন্য ধন্য করে বলেছি, “আহা! তা খাক না একটু, কাজ তো করেছে।” মুখোমুখি দেখা হলে মিনমিন করে বলি, “রাস্তার লাইটটা একটু দেখবেন, রাস্তাটায় বালি, ইট জমেছে, একটু দেখবেন, নর্দমা বন্ধ হয়ে গিয়েছে, একটু দেখবেন।” আর না বলতেই যদি কাজ হয়ে যায়, তবে তা আমরা করদাতার অধিকার নয়, পরম সৌভাগ্য বলে মনে করি, তখন তো ‘বদন তুলে বলো সবে হল্লুমানের জয়’। আসলে খেলে আপত্তি নেই, বেশি খেয়ে বদহজম হয়ে যাওয়ায় আমাদেরও হজম করা মুশকিল হয়ে পড়েছে।
আসলে এত খেয়েছে তো আমরা জানতামই না!
বলেন কি মশাই, জানতেন না? চাকরিপ্রার্থীরা মামলা সেই কবে থেকে লড়ছেন, কবে থেকে ধর্নায় বসেছেন। জানতেন না? তৃণমূল সরকার ২০১১ সালে ক্ষমতায় আসার পরে তৎকালীন নিয়ম অনুযায়ী, ‘রিজনাল লেভেল সিলেকশন টেস্ট’ হয়েছিল ২০১২ সালে। ২০১৩ সালে নিয়োগ হয়। দেখা যায়, ৪৬ হাজারের মতো শূন্য পদের জন্য ৩৬,১৪০ জনের মেধা তালিকা বেরিয়েছে। নিয়োগ হয় ২৯ হাজার ৫৭৫ জনের। প্রশ্ন ওঠে, ৩৬,১৪০ জনের মেধা তালিকা থেকে ২৯,৫৭৫ জনের নিয়োগ কেন? সে বারও মেধা তালিকায় র্যাঙ্ক হেরফেরের অভিযোগ ওঠে। তার পরেই ধর্না অবস্থান শুরু হয়। আর এই নিয়োগকে কেন্দ্র করে প্রথম মামলা হয় ২০১৪ সালে।
স্কুল নিয়োগ দুর্নীতির মামলাকারীদের অন্যতম আইনজীবী সুদীপ্ত দাশগুপ্তের হিসাব, বর্তমানে প্রাথমিক শিক্ষা থেকে কলেজ সার্ভিস কমিশন পর্যন্ত কয়েক হাজার মামলা রয়েছে। শুধু তাঁর হাতেই হাজার দুয়েক মামলা। আর এক আইনজীবী ফিরদৌস শামিমের বক্তব্য, তাঁর কাছে প্রায় ৫০০ মামলা আছে। মামলা পিছু গড়ে ২০ জন করে চাকরিপ্রার্থী হলে মোট মামলাকারী দশ হাজার।
জানতেন না? কেউ জানত না?
খাব না, খেতেও দেব না— এক জন তো এ কথা বলে বিপাকে পড়ে গিয়েছেন। একে তো লোকজন খেয়েদেয়ে বিদেশে পালিয়ে গিয়েছে আর তিনি নিজে আবার গরিব, মধ্যবিত্তের রান্নাঘরে আগুন লাগিয়ে দু’বেলার খাবারই খেয়ে ফেলেছেন। আর এ ক্ষেত্রে তো চোখের সামনে শতমুখে খাওয়া। তদন্তের অভিমুখই বলে দিচ্ছে, যে পেরেছে, খেয়েছে। আর তা যখন সংবাদমাধ্যমে তুলে ধরা হয়েছে, তখনই তা হয়ে গিয়েছে চক্রান্ত! পঞ্চায়েতের কর্মী, প্রধান বা উপপ্রধান বা খুদে নেতা অট্টালিকা তুলে ফেলেছেন, দলের লোকরাই নেতাদের কাছে নালিশ করে তাঁদের কেশাগ্র স্পর্শ করতে পারে না এবং আমজনতা সে বাড়ি দেখতে যায় (এখন যেমন পার্থ-অর্পিতাকে দেখতে যাচ্ছে)।
না, কিছুই তো দেখতে পাইনি।
সত্তর-আশির দশকে পাড়াগুলোর কথা মনে পড়ে যাচ্ছে। মাঝরাতে চোর-চোর রব উঠল। বাবা-জ্যাঠা, কাকা-দাদা-ভাই সকলে ঘুম ভেঙে উঠে দৌড়ল, মা-জেঠিমা, কাকিমারাও বাড়ির বাইরে, এক গলি থেকে এক গলিতে চোর দৌড়চ্ছে, পিছনে পাড়ার লোক, রাস্তার টিমটিমে আলো, আর টর্চ নিয়ে, হঠাৎ কে বললে, “আরে! চৌধুরী বাড়ির আধ হওয়া তেতলার জানলায় কে দাঁড়িয়ে?” ফের ধর ধর ধর! চোর তো জানলায় দাঁড়িয়ে ভেংচি কেটে ফুড়ুৎ। ছাদ বেয়ে, টপকে পালাতে গিয়ে কিছু চোরাই মাল খসে পড়ত। পর দিন, এ বাড়ির কাকিমা, ও বাড়ির কাকু সেগুলো যত্ন করে খুঁজে নিয়ে গিয়ে যাঁর ধন তাঁকে দিতেন।
এখনও তেমন একটা উত্তেজনা হচ্ছে। আজ এখানে ‘রেড’, তো কাল ওখানে। এখানে সোনা, তো ওখানে টাকার বস্তা। এখানে জমি তো ওখানে অট্টালিকা। আজ এখানে ‘ঠিকাদারি আর দল এক সঙ্গে করা চলবে না’, তো ঠিকাদার বলছে, ‘ঠিকাদারি করব না তো খাব কী, খাওয়াব কী’। আজ এক মুখ বলছে, যথেষ্ট প্রমাণ পেলে তবে ব্যবস্থা করা হবে, ২৪ ঘণ্টা কাটতে কাটতে আর এক মুখ বলছে, সাসপেন্ড করা হল। সব মিলিয়ে টেনিস ম্যাচ দেখার মতো মাথাটা এক বার ও দিকে, আর এক বার এ দিকে ঘুরছে। সততা, ন্যায়, দায়বদ্ধতা, সব চুরি হয়ে গেল। আমরা কিন্তু খেলাটা দেখছি মন দিয়ে! মাঝেমধ্যে গাড়ি থেকে নেমে ধর্মতলায় শতরঞ্চি বিছিয়ে যাঁরা বসে রয়েছেন, চাকরি-চাকরি করে মাথা খাচ্ছেন, তাঁদের একটু দেখে আসব, যাঁরা যোগ্য, তাঁরা চাকরি পাবেন— এই বলে নিশ্চয়তা দেব। আরে এই চাকরি আমার হক, যোগ্যতায়, পরীক্ষায় পাশ করে চাকরি পাওয়ার যোগ্যতা অর্জন করেছি, তাকে দয়াদাক্ষিণ্যের টুকরো, ক্ষমতা দেখানোর পালক করলে চলবে কেন? এ কথা বললে চলবে কেন, ও তো বড় চোর। এ তো পাড়ার মোড়ে চায়ের কাপে তর্ক করার মতো বালখিল্য যুক্তি। ও চোর বলে আমারও চুরি করার অধিকার জন্মে গেল? এ কি চুরির খোলা বাজার যে, কার চুরি কত কিলো বলে ওজন করে দেখবে জনতা? চুরি হবে না, এই ঝান্ডাই তো ওড়ানোর কথা ছিল।
আসলে মূলে সেই ক্ষমতা। ক্ষমতার দম্ভ। দম্ভের জোরে যা খুশি তাই করব, দম্ভের জোরে আমি যা দেখব এবং দেখাব, সেটাই সত্য, আমিই নর্দমায় নিক্ষেপ করব আবার আমিই ত্রাতা হব। সম্ভবামি যুগে, যুগে।
পুনশ্চ: দোলের সময় পাড়ার দুষ্টু ছেলেদের কাজই হল, অন্যকে বাঁদুরে রং ছুড়ে মারা। অত্যন্ত বিপজ্জনক রং। সহজে ওঠে না। নিজের হাত থেকেও নয়। তাতে কী! হাতে বাঁদুরে রং থাকলে লোকে দেখলেই পালাবে— খুদে মস্তানের তাতেই আনন্দ।
আলকাতরাও হাতে লাগলে সহজে ওঠে না।
এর মধ্যে কে আবার রটিয়ে দিল, রবি ঠাকুর বলেছেন, ‘দ্যাখ তো, আমার নোবেলটা অর্পিতার ফ্ল্যাটে পাওয়া যায় কি না।’
রবীন্দ্রনাথ এ কথা বলেননি। ইহা একটি ‘মিম’।
রবীন্দ্রনাথ মারা গিয়েছেন।
তাঁর ফুল-বিদ্ধ ফটো আমাদের সব মালা প্রত্যাখ্যান করছে।
আমরা কিছুই দেখিনি।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy