Advertisement
১০ জানুয়ারি ২০২৫
Women

নিজস্ব সর্বনামের পথে

শরৎচন্দ্রের মরমি নারী-চেতনায় আচ্ছন্ন কৈশোর আবেগপীড়িত ছিল, কিন্তু পরবর্তী সময়েও মূল প্রশ্নটা অনড় থেকে গিয়েছে। নারী পূর্ণ আকাশের অধিকারিণী হবে না কেন?

Sun.

প্রতীকী ছবি।

রতন জানা
শেষ আপডেট: ১২ এপ্রিল ২০২৩ ০৮:৫১
Share: Save:

রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন উড়ে এসে জুড়ে বসা এক ‘সে’-র কথা। সময়ের ফেরে চিন্তায় ঠাঁই চাইছে, আলোচনার দাবি জানাচ্ছে আরও আরও সব নিজস্ব সর্বনাম— সে, শে, ষে...।

‘নারী তুমি অর্ধেক আকাশ’। স্কুলবেলায় এই কাব্যচরণটির প্রথম মুগ্ধতা বেশি ক্ষণ আবিষ্ট করতে পারেনি। নারীর জন্য আকাশের মাত্র অর্ধেকটা সীমাবদ্ধ করে দেওয়ার কৃপণতা পীড়া দিয়েছিল। মনে হয়েছিল, পূর্ণ আকাশ নয় কেন? মা-কাকিমা-জেঠিমা-পিসিমারা তো সর্বদা খণ্ডিত, নমিত হয়েই আছেন। অন্তত উদার কাব্যসংসারে কি নারীর সত্তাকে পূর্ণ আকাশের মহিমায় মুক্তি দেওয়া যেত না? ‘নারী তুমি পূর্ণ আকাশ’ বললে কবির বোধদৃষ্টি আরও নন্দিত, আরও মানবিক হয়ে উঠত না কি? বেজে উঠত না কি নারীমুক্তির নান্দনিক ডঙ্কা?

শরৎচন্দ্রের মরমি নারী-চেতনায় আচ্ছন্ন কৈশোর আবেগপীড়িত ছিল, কিন্তু পরবর্তী সময়েও মূল প্রশ্নটা অনড় থেকে গিয়েছে। নারী পূর্ণ আকাশের অধিকারিণী হবে না কেন? সেটা তার প্রাকৃতিক অধিকার, মানবিকও, এবং সে জন্যই আবশ্যিক। প্রত্যেক নারীর এককত্বকে স্বীকৃতি দিতে হলে তাদের প্রত্যেকের জন্মগত পূর্ণ স্বতন্ত্র আকাশের অর্জনকে স্বীকার করতেই হবে। পুরুষ সেই পূর্ণাঙ্গ আকাশ নারীকে দেওয়ার কেউ নয়। সৃষ্টির আদি মুহূর্ত থেকেই ধারণাগত ও অস্তিত্বগত ভাবে তা নারীরই, যেমন পুরুষেরও। নারীকে পুরুষের উপনিবেশে পরিণত করার পুরুষানুক্রমিক ষড়যন্ত্র সে সত্যকে আড়াল করেছে। সেই সত্য উদ্ধারের সংগ্রাম চলতে পারে বর্ণমালা, ভাষা, ব্যাকরণের অস্ত্রেও।

স্কুলজীবনে হেনরি রাইডার হ্যাগার্ড-এর শি প্রথম পাঠের অভিঘাত ভারতীয় নারী-চেতনার উত্তরাধিকারকে নাড়া দিয়েছিল। মনে হয়েছিল, প্রচলিত বর্ণমালা ও ব্যাকরণ শিরোধার্য করেও নারীর নিজস্ব সর্বনাম না হলেই নয়। প্রশ্ন জেগেছিল, ইংরেজি বর্ণসংস্থাপনের বিধি অনুযায়ী ‘S’-এর পরে ‘h’ থাকার সূত্রে হ্যাগার্ড-এর ‘She’-র বঙ্গীয় প্রতিবর্ণীকরণ যেমন ‘শি’ হওয়া উচিত, একই সূত্রে পুরুষের সর্বনাম হিসেবে ‘he’ বা ‘সে’ হলে নারীর সর্বনাম কেন হবে না ‘she’/‘শে’? শিক্ষককে জানালে তিনি তিরস্কার করেছিলেন, এখনই বৈয়াকরণ হয়ে ওঠার চেষ্টা না করাই ভাল, ইংরেজিতে ‘হি’ ‘শি’ দুই সর্বনাম থাকলেও বাংলায় ‘সে’ দিয়েই দু’পক্ষের কাজ বেশ চলবে।

ইদানীং ওপার বাংলায় যে ‘শে’ সর্বনামের পক্ষে সওয়াল শুরু হয়েছে, সেই শিক্ষককে এখন আর তা জানানোর উপায় নেই। অতএব জানালাম নতুনদাদুকে। ‘সব নতুনের পথেই পাথর ছড়ানো’ আপ্তবাক্য আওড়ে তিনি বললেন, নারীর পূর্ণ আকাশ উদ্ধারে ভাষাব্যাকরণের সংগ্রাম অপরিহার্য। গোড়ায় অনভ্যাসের ফোঁটা কমবেশি চড়চড় করলেও নিজস্ব সর্বনাম ‘শে’ নারীকে সেই পূর্ণ আকাশের অধিকারের দিকে এক পা এগিয়ে দিতে পারে। তার জন্য নারীর স্বাতন্ত্র্য-রক্ষার পূর্বাপর বৈয়াকরণিক প্রয়াসের সশ্রদ্ধ বিচারও জরুরি। সেই বিচারে গ্রহণ ও বর্জনের ভূমিকা নির্ধারণ করে দেয় কাণ্ডজ্ঞান।

কী ভাবে? নতুনদাদুর ব্যাখ্যা, আবেগ ভাল, যুক্তির ঘাত-সহ নিয়ন্ত্রিত আবেগ আরও ভাল। ‘অর্ধেক আকাশ’-এর আবেগ নিয়ে খুশি থাকলে তা হবে খণ্ডিত সত্তা-চেতনা। ‘শে’ যদি নারীকে পূর্ণতার বোধ দেয়, ব্যাকরণে তার অঙ্গীকরণ সময়ের অপেক্ষা। গ্রহণ-বর্জনের বিচার তখন আরও ক্ষুরধার হয়ে উঠতে পারে। ‘ছেলেদের মতো পাড়া কাঁপিয়ে হেসো না’— সহবতের নামে এমন তিরস্কারকে থোড়াই কেয়ার শুধু নয়, বাক্‌-ব্যাকরণ থেকে বহিষ্কারের দিন সমাগত। ‘মেয়েদের মতো কাঁদছে দেখো’র গঞ্জনাও পরিত্যাজ্য। ছেলেরা কি কাঁদতে জানে না, যে তাদের কাঁদতে হবে মেয়েদের মতো! মেয়েরা ছেলেদের মতো কাঁদলে কান্নার মহিমা কিছু ক্ষুণ্ণ হবে কি? কান্না ছেলে বা মেয়ে যে যার মতো, ঠিক যেমন হাসি। হাহা, হিহি, হোহো, অট্টহাসি, মুচকি— সব হাসি একই সঙ্গে সুহাসিনীর, সুহাসচন্দ্রেরও। কিন্তু সর্বনামের ক্ষেত্রে সে আর শে-র স্বাতন্ত্র্য অস্তিত্বের ইতিবৃত্তে ঠাঁই চায়।

নাম হলেই তো স্বতন্ত্রতা রক্ষা পায়, সর্বনাম নিয়ে ভাবনা কেন? নতুনদাদু বললেন, পঞ্জাবিতে গুরপ্রীত, হরমনপ্রীত ছেলে ও মেয়ে সকলেরই নাম হয়। কিন্তু সর্বনামে স্বাতন্ত্র্যের বিশিষ্ট ভূমিকা থাকে। সর্বনামের কাছে নামের সীমাবদ্ধতা দুঃসহ হয়ে উঠেছিল রবীন্দ্রনাথের কাছে। সে জন্যই সে-র সৃষ্টি। একটা নামের বদলে সর্বনাম ‘সে’ দিয়ে চরিত্রের পরিচয় কেন তার ব্যাখ্যার দাবি উঠবে, আঁচ করেই সম্ভবত কবি লিখেছিলেন, “নাম বললে ইনি যে কেবলমাত্র ইনিতেই এসে ঠেকবেন, এই ভয়। জগতে আমি আছে এক জন মাত্র, তুমিও তাই, সেই তুমি আমি ছাড়া আর-সকলেই তো সে।” নামের গণ্ডিবদ্ধতার তুলনায় সর্বনামের আপেক্ষিক উৎকর্ষ কবির কাছে মাননীয় মনে হয়েছিল, কেননা তাতে আকাশের মতোই স্বাধীন বিস্তারের দিগন্তহীনতা আছে। ‘আমি’র আত্মপরতা থেকে ‘সে’-র মধ্যে আছে হাঁপ-ছাড়া সর্বজনীনতা।

নতুনদাদুর ভবিষ্যৎ-দর্শন, আগামী রবীন্দ্রনাথেরা ‘শে’-কে জায়গা দেবেন সাদরে, শ্রদ্ধায়, সর্বোপরি শ-যুক্তিতে। কারণ, রবীন্দ্রনাথ ‘এক যে আছে রাজা’র গল্প বলতে চাননি, ‘এক যে আছে মানুষ’-ই তাঁর গল্পের চরিত্র। ভাবী রবীন্দ্রনাথেরা নারী-পুরুষ ছাপিয়ে তাঁর চেয়ে মানুষের কাছে আরও অনেক বেশি এগিয়ে যাবেন, বিশ্বাস ছিল কবির। তা হলে তো সে-শে ছাড়াও আরও অন্তত এক শ্রেণির মানুষের পৃথক সর্বনামের দাবির কথা না ভাবলেই নয়। তৃতীয় লিঙ্গের মানুষের সর্বনাম কী হবে?

“সে ব্যবস্থা বাংলা বর্ণমালাতেই আছে। ‘শ’ আর ‘স’-এর মধ্যে আছে ‘ষ’, তৃতীয় লিঙ্গের সর্বনাম ‘ষে’ হয়ে উঠলে বর্ণমালার সমৃদ্ধি আরও মানবিক, ব্যবহারিক ও ভাষাবিজ্ঞানে আরও বেশি ঐতিহাসিক হতে পারে,” বললেন নতুনদাদু। বাঙালির জিভ শ, ষ, স-এর তফাত করতে পারে না বলে এদের উপযোগিতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে, সর্বনামের লিঙ্গপরিচয়ে তাদের স্বতন্ত্র ব্যবহারের ব্যবস্থা হলে তিন জনেরই কর্মসংস্থান হবে। ভাষা-পথেই ক্রমমুক্তি।

অন্য বিষয়গুলি:

Women Society
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy