স্বপ্নাভিযান? পাঞ্চেত বাঁধ উদ্বোধনে প্রধানমন্ত্রী নেহরু ও বুধনি মেঝেন, ৬ ডিসেম্বর, ১৯৫৯। —ফাইল চিত্র।
সম্প্রতি ওড়িশায় ঘটে যাওয়া রেল-দুর্ঘটনায় যে সহনাগরিককে গ্যাস-কাটার দিয়ে কেটে কামরা থেকে বার করতে হয়, তাঁরা অসংরক্ষিত সিটের পরিযায়ী শ্রমিক, যাঁদের সংখ্যা ও পরিচয় দিতে অক্ষম ভারতের রেল মন্ত্রক। বীভৎস মৃত্যুমিছিল দেখতে দেখতে অতিমারির সময় মহারাষ্ট্রের ঔরঙ্গাবাদের কাছে রেল-দুর্ঘটনায় মারা যাওয়া ষোলো জন গোন্ড পরিযায়ী শ্রমিকদের কথা মনে পড়ে যাচ্ছিল। মহারাষ্ট্রের জালনার ইস্পাত কারখানা থেকে দেড়শো কিমি দূরে তাঁরা হেঁটে যাচ্ছিলেন ‘শ্রমিক স্পেশাল’ ট্রেন ধরতে। গন্তব্য মধ্যপ্রদেশ। নাহ্, সশরীরে বাড়ি তাঁরা পৌঁছননি।
বর্তমান স্মৃতিলঘু প্রজন্ম এই গোন্ড জনজাতি শ্রমিকদের যেমন মনে রাখেনি, তেমনই অষ্টাদশ থেকে বিংশ শতক জুড়ে ভারতবর্ষে ঔপনিবেশিক বিরোধী ‘আজ়াদি’র লড়াইয়ে জনজাতি বিদ্রোহগুলোর গুরুত্বপূর্ণ অবদান থাকা সত্ত্বেও তাদের কীর্তি বিস্মৃতির অতলে। অথচ, উপমহাদেশের বিভিন্ন জনজাতি গোষ্ঠীর রাজদ্রোহ ঔপনিবেশিক শাসনের ভবিষ্যৎকে অনিশ্চিত করে তুলেছিল। ধারাবাহিক হওয়ার ফলে বিশেষ কোনও কেন্দ্রীভূত ঘটনা, স্থানিক বা কালিক পরিসরে সীমাবদ্ধ ছিল না এই অভ্যুত্থানগুলি। কোনও সংখ্যাসূচক শুরু বা তাৎক্ষণিক ভাবে নিঃশেষিত হওয়ার দায় এদের ছিল না। দায় ছিল শুধু, কালানুক্রমিক ভাবে অন্যায়ের বিরুদ্ধে সংগঠিত প্রতিরোধে গড়ে তোলার ইতিহাস নির্মাণ করার।
অষ্টাদশ থেকে বিংশ শতকে ব্রিটিশ আধিকারিক ও ভারতীয় মহাজন, ব্যবসায়ী ও জমিদারদের বিরুদ্ধে বর্তমান ঝাড়খণ্ড, পশ্চিমবঙ্গ ও বিহারে মালপাহাড়িয়া, কোল, হো, মুন্ডা, ভূমিজ, সাঁওতাল ও ওরাওঁ জনজাতিরা বিদ্রোহ সংগঠিত করে। বিদ্রোহে জেগে ওঠেন মধ্যপ্রদেশের গোন্ড, রাজস্থানের ভিল, গুজরাতের নায়েক, ওড়িশার খোন্ড, জুয়াং ও ভুঁইয়া জনজাতিরাও। মহারাষ্ট্রের কোলি ও অন্ধ্রপ্রদেশের কোয়া জনজাতিরাও বিদ্রোহ সংগঠিত করে। উত্তর-পূর্ব ভারতেরও মিসমি, গারো, ডাফলা, সিংফো, কুকি, খাসি, লুসাই, খামতি, নাগা বিবিধ জনজাতিরা উপনিবেশ বিরোধী বিদ্রোহ গড়ে তোলে।
বিভিন্ন অঞ্চলে উপনিবেশ স্থাপন করা কোম্পানি-সরকারের কাছে এ-হেন জনজাতিরা ছিল হিংস্র, আদিম, অশান্তি সৃষ্টিকারী, আইন-শৃঙ্খলায় সমস্যা তৈরি করা ‘অপরাধপ্রবণ সম্প্রদায়’ মাত্র। আসলে সংঘর্ষটা ছিল ব্রিটিশ সরকারের বণিকসুলভ মনোভাব ও তাদের মুদ্রাভিত্তিক অর্থনীতির সঙ্গে জনজাতিদের বিনিময়ভিত্তিক অর্থনীতির। সমানাধিকার ও সমমাত্রিক সমাজজীবন ও স্থানীয় রীতিনীতি দ্বারা চালিত প্রশাসনিক কাঠামোতে অভ্যস্ত জনজাতিরা বাণিজ্যভিত্তিক অর্থনীতি, আমলাতান্ত্রিক বিচারব্যবস্থা ও রাজনৈতিক শৃঙ্খলশাসনের জন্য প্রস্তুত ছিল না। মূলত এই সংঘাতের ফলেই ৩০ জুন ১৮৫৫-এ সিধু-কানু-চাঁদ-ভৈরো-ঝানো-ফুলো মুর্মুরা সাঁওতাল হুলের কথা ঘোষণা করেন। ভারতের মানচিত্রে জন্ম নেয় আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন অধিকারী সাঁওতাল পরগনা। কিন্তু ভিন্ন সামাজিক-সাংস্কৃতিক জীবনধারা ও জীবনদর্শনে বিশ্বাসী সাঁওতালদের প্রতি বাঙালি বুদ্ধিজীবীরা এতটাই ঘৃণা পোষণ করতেন যে, হুলের পর ফ্রেন্ড অব ইন্ডিয়া ও ক্যালকাটা রিভিউ মতামত দেয় যে ‘অসভ্য’, ‘কুৎসিত’, ‘কালো ভূত’ সাঁওতালদের যেন বর্মার ভয়ানক জঙ্গলে নির্বাসনে পাঠানো হয় অথবা গুলি করে বা ফাঁসি দিয়ে হত্যা করা হয়।
স্বাধীনতা-পরবর্তী কালেও এই অপরায়ণের গরলটুকুই ছিল পড়ে। বুধনি মেঝেন-এর কথা মনে পড়ে। নির্মাণ কাজে চুক্তিবদ্ধ এই সাঁওতাল শ্রমিকের হাত ধরেই স্বাধীন ভারতের উন্নয়নের ‘নয়া দৌড়’ শুরু হয়। ১৯৫৯ সালের ৬ ডিসেম্বর দামোদর ভ্যালি কর্পোরেশনের পক্ষ থেকে তাঁকে বেছে নেওয়া হয়েছিল বোতাম টিপে পাঞ্চেত বাঁধে বিদ্যুৎকেন্দ্রের উদ্বোধনের জন্য। মঞ্চে উপস্থিত প্রধানমন্ত্রী পণ্ডিত নেহরু যে-হেতু তাঁকে মালা পরিয়ে দেন, মালাবদল বিয়ের প্রতীক, এই ধারণায় সম্প্রদায়ের বাইরে বিয়ে করার অপরাধে সাঁওতাল সমাজ বুধনিকে বহিষ্কার করে। তিন বছর পর অসংখ্য জনজাতি শ্রমিকদের সঙ্গে তাঁকেও ছাঁটাই করা হয়। রাজীব গান্ধী প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন শুনে চরম আর্থিক বিপর্যয়ের সঙ্গে যুঝে জীবনযুদ্ধ চালিয়ে যাওয়া বুধনি ১৯৮৪ সালে দিল্লি ছুটে যান কাজ ফিরে পাওয়ার আশায়। তবে সে গুড়ে কেবল বালিই ছিল।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, ১৯৫৩ সালে ডিভিসি প্রকল্পের জন্য যে ৪১,০০০ একর জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছিল তার বেশির ভাগই এই জনজাতিদের উৎখাত করে। ১২০০ পরিবার তাদের ঘরবাড়ি, বসতভিটা, জমি ও জীবিকা হারিয়েছিল। পর্যাপ্ত ক্ষতিপূরণ এবং চাকরি কেবল প্রতিশ্রুতি হয়েই থেকে যায়। ৬ ফেব্রুয়ারি ২০০৯ সালে এক জেলা ডেপুটি কমিশনার ডিভিসি ব্যবস্থাপনাকে ‘স্বৈরাচারী, অমানবিক এবং দায়িত্বজ্ঞানহীন’ বলেন বটে, বিষয়টি আইনসভায়ও উত্থাপিত হয়েছিল, কিন্তু ‘উন্নয়ন’-এর উষালগ্ন থেকেই জনজাতিরা ‘কোল্যাটারাল ড্যামেজ’ বই তো কিছু নয়!
বনাধিকার আইন (২০০৬) সংশোধনের মাধ্যমে বনাঞ্চল থেকে জঙ্গলবাসী ও জনজাতিদের উচ্ছেদের ষড়যন্ত্র আজও বহাল। ভারতীয় সংবিধানের পঞ্চম এবং ষষ্ঠ তফসিল অনুযায়ী খনিজ সম্পদশালী জনজাতি-অধ্যুষিত অঞ্চলগুলিতে আদিবাসীদের পূর্ণ স্বশাসনের অধিকার আছে। পঞ্চায়েত আইন (১৯৯৬) অনুযায়ী এই সব অঞ্চলে জনজাতি গ্রামসভা-ই সর্বোচ্চ প্রশাসনিক ক্ষমতার অধিকারী। তাই তাদের অনুমোদন ও সিদ্ধান্ত ছাড়া ‘উন্নয়ন’-এর নামে কোনও অনাদিবাসীকেই এমন জমি বেচা বা হস্তান্তর করা যায় না।
দেশি ও বিদেশি কর্পোরেট বৃহৎ পুঁজি অতি-মুনাফার লোভে জনজাতিদের এই অধিকারগুলো লঙ্ঘিত করে যখন জল, জঙ্গল ও জমি লুট করতে গেছে, চূড়ান্ত প্রতিরোধ গড়ে তুলেছেন ওড়িশার ডোংরিয়া কোন্ধ জনজাতি ও ঝাড়খণ্ডের পাতালগড়ি প্রতিরোধ আন্দোলনের নির্মাতা জনজাতিরা।
পশ্চিমবঙ্গেও বন্যপ্রকৃতি, জঙ্গল ও জমির সঙ্গে জনজাতিদের দীর্ঘ সহাবস্থান। তাই বারংবার রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় কর্পোরেট পুঁজির আগ্রাসনের মুখোমুখি দাঁড়াতে হচ্ছে তাদেরই। এই শতাব্দীর গোড়ায় তদানীন্তন রাজ্য সরকার অযোধ্যা পাহাড়ে পুরুলিয়া পাম্পড স্টোরেজ প্রোজেক্ট (পিপিএসপি) নামক এক জলবিদ্যুৎ প্রকল্প গ্রহণ করে। জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সি থেকে ঋণ নিয়ে করা এই উদ্যোগকে একটি পরিবেশবান্ধব প্রকল্প বলে দাবি করলেও অধিগ্রহণ করা ৪৪২ হেক্টর জমির মধ্যে ৩৭৩ হেক্টর ছিল বনভূমি। এই প্রকল্প শত শত হেক্টর ঘন বনভূমি ধ্বংস করেছে, নদী ও ভূগর্ভস্থ স্রোতকে বাধাগ্রস্ত করেছে ও জনজাতির জীবিকা নির্বাহের ক্ষেত্রে তীব্র সমস্যার সৃষ্টি করেছে। পুরুলিয়ায় এমনিই জলের অভাব, তদুপরি সমস্ত নদী জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের দিকে টানায় চাষের খেতে জল নেই। অন্য দিকে, আবাদি জমি ও বনাঞ্চলের বড় অংশ বাঁধের জলাধারের জলে নিমজ্জিত। ফলত অসংখ্য জনজাতিভুক্ত মানুষকে উদ্বাস্তু ও পরিযায়ী শ্রমিক হতে বাধ্য করা হচ্ছে।
সম্প্রতি বীরভূম জেলার ডেউচা-পাঁচামিতে খোলামুখ কয়লা খনির জন্য নেওয়া জমির আশি শতাংশতেই জনজাতির বসতি। প্রকল্পটি বাস্তবায়নের জন্য যে শুধু তাদের উচ্ছেদ করে বাস্তুচ্যুত করা হবে তা-ই নয়— মাটি, নদী, জঙ্গল, কৃষিজমি, জলস্তর ও পরিবেশ নষ্ট হওয়ারও আশঙ্কা আছে। যে-হেতু প্রকৃতি, জমি, বাস্তুতন্ত্র বাঁচাবার এই লড়াইয়ে জনজাতি মহিলারা সক্রিয় ভূমিকা পালন করছেন, ২৩ ডিসেম্বর ২০২২-এ প্রতিরোধ করতে আসা ৩২ বছরের মায়নামতি সোরেনের ‘উন্নয়নের স্বার্থে’ গর্ভপাতও হয়। উল্লেখ্য যে, দেশের প্রথম জনজাতি রাষ্ট্রপতি যখন মার্চ মাসে প্রথম বার এই রাজ্যে সফরে আসেন, তখন গৃহবন্দি করে রাখা হল বীরভূমের ছয় জনজাতি নেতাকে।
এই মুহূর্তে মণিপুরে কুকি জনজাতি এবং রাজনৈতিক প্রভাবশালী হিন্দু মেইতেইদের মধ্যে হিংসাত্মক সংঘর্ষ চলছে। ব্যাপক ভাবে প্রাণ হারাচ্ছেন ও বাস্তুচ্যুত হচ্ছেন জনজাতি মানুষ৷
তবে কি আজ়াদির মহোৎসবে বলপূর্বক উচ্ছেদ, গৃহহীনতা, নিরন্তর জীবিকাচ্যুতি, দারিদ্র, খাদ্য-নিরাপত্তাহীনতা, শারীরিক ও মানসিক লাঞ্ছনা এবং সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বিচ্ছিন্নতাকেই ‘অমৃত’ বলে পান করতে হবে জনজাতিদের?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy