নাগরিক: নিজেদের কথা জানাতে উদগ্রীব আজকের নারী।
আমার সেই বন্ধুর বাড়িটা একটু সেকেলে ধাঁচের। দোতলা, উপর-নীচ মিলিয়ে বেশ কয়েকটা বড়সড় ঘর, কিন্তু এক-এক তলায় একটাই বাথরুম। বাড়ির ঠাকুমাটি নীচের তলার একটা ঘরকে ‘নিরামিষ্যি রান্নাঘর’ তো করেইছিলেন, বাথরুমটাকেও ‘নিরামিষ্যি বাথরুম’ বলে দখল করেছিলেন। শরীরের ভিতরে যা যায়, তা শুচি-অশুচি নিয়ে শাস্ত্রে নানা বিচার থাকলেও, যা বেরোয় তা নিয়ে কিস্যু নেই। তবু যত দিন বেঁচেছিলেন, বাড়ির বাথরুমের পঞ্চাশ শতাংশ একাই ভোগ করেছেন ঠাকুমা।
ভারতের সংসদ তেমনই একটি ‘নিরামিষ্যি বাথরুম’— কেন যে পুরুষ প্রায় ৯০ শতাংশ আসনে বসে, কেউ জানে না। এ বার মহিলা বিল (কী এক অদ্ভুত নামে) পাশ হয়েছে, মেয়েরা ঢোকার জন্য দরজা পিটছে, আর ভিতর থেকে জবাব আসছে, “দাঁড়াও, দাঁড়াও, এখনও হয়নি।” যদি দরজা খোলার সাহস দেখাত পুরুষরা, যদি দরজা ভাঙার শক্তি থাকত মেয়েদের, তা হলে এ বারের সাধারণ নির্বাচন হত ঐতিহাসিক। একশো একাশি আসনে মহিলা প্রার্থী দিতে গিয়ে বহু অচেনা মুখ আসত। বহু চেনা হিসাব বানচাল হয়ে যেতে পারত। অনেক মেয়ে হয়তো বর-শ্বশুরের রুমাল-ফেলা ক্যান্ডিডেট হত। তবু, অল্প কিছু টিকিটও যদি আন্দোলন করে উঠে-আসা মেয়েদের হাতে আসত, সংসদের ভিতরে-বাইরে রাজনীতি বদলানোর একটা সম্ভাবনা অন্তত তৈরি হত। একটা দিন নাম-কা-ওয়াস্তে ‘নারীদিবস’ উদ্যাপন নয়, ২০২৪ বছরটাই হত ‘নারীবর্ষ’— স্বাধীনতার অমৃতকালে গণতন্ত্রের সোনার মন্দির খুলে যেত অর্ধেক ভারতবাসীর কাছে।
সে হল না। ‘নিরামিষ্যি’-দের আসনে যাতে হাত না পড়ে, সে জন্য আগে নতুন নতুন আসন তৈরি হবে, তবে মেয়েরা ঢুকতে পাবে অন্দরে। তত দিন শুনবে— হবে, হবে, অমুকটা মিটে যাক, তার পর তোমাদের ব্যাপারটা দেখব। সরকারের কাছে, রাজনৈতিক দলের কাছে, ট্রেড ইউনিয়নের কাছে যা শুনে শুনে মেয়েদের কান পচে গেল। কথাটা কেবল নারী অধিকারের নয়। ‘যুদ্ধু-যুদ্ধু খেলা’-কে সত্যিকারের ক্ষমতার লড়াইয়ে নামিয়ে আনা চাই। যে কোনও অবহেলিত, বঞ্চিত জনগোষ্ঠীর জন্য নির্বাচন এক সুযোগ, রাষ্ট্রক্ষমতা হাতে পাওয়ার। মেয়েদের হাতে দরজার চাবি দিয়েও ভিতর থেকে খিল তুলে রাখল রাজনৈতিক দল। তাই এ বছর ইতিহাস গড়া হল না।
কিংবা, এটাই ইতিহাসের গতি। আমাদের ‘নিরামিষ্যি’ ইতিহাস বইয়ে মেয়েদের আঁশটে লড়াইগুলোর কথা লেখা হয় না, তাই খেয়াল করি না যে একশো বছর আগে ভোটের অধিকার চাইতে গিয়েও মেয়েদের মুখের সামনে দরজা বন্ধ করেছিল রাজনীতি। বিশেষ করে বাংলার মেয়েরা। ১৯১৯ সালে বম্বে, মাদ্রাজের প্রাদেশিক আইনসভা মেয়েদের (সীমিত) ভোটাধিকার দেওয়ার পরে বাংলার মেয়েরা সেই দাবিতে আন্দোলন শুরু করে। নেত্রীরা অনেকেই বেথুন কলেজের গ্র্যাজুয়েট। ১৯২১ সালে বাংলার নানা মফস্সল শহরে প্রচার চালাল তাঁদের ‘বঙ্গীয় নারী সমাজ’। তার পরেও প্রাদেশিক আইনসভায় মেয়েদের ভোটাধিকারের প্রস্তাব হেরে গেল ভোটে।
বাঙালি মেয়েদের কাছে অপ্রত্যাশিত ছিল এই প্রত্যাখ্যান। ফের লড়াই শুরু করল তারা। ১৯২৩ সালে কলকাতা পুরসভায় ভোটের অধিকার পেল মেয়েরা, যদিও তার প্রধান কৃতিত্ব তৎকালীন বড়লাট লর্ড লিটনের (যাঁর বোন ছিলেন সুপরিচিত নারীবাদী)। লিটন বঙ্গীয় নারী সমাজের পাশে দাঁড়ান। ফলে পুরসভার ব্রিটিশ প্রতিনিধি এবং ইংরেজ-ঘেঁষা ভারতীয়রা মেয়েদের পক্ষে ভোট দেন। পাশাপাশি, বঙ্গীয় নারী সমাজ কিছু কৌশলগত উদ্যোগ করে। ‘মেয়েদের ভোটের দাবি কেবল কিছু অভিজাত মহিলার দাবি’, এই সমালোচনার উত্তরে সব ধরনের মেয়েদের, বিশেষত মুসলিম মেয়েদের সংগঠনে আনে। পাশাপাশি, কংগ্রেস-সহ সব দল থেকে দূরত্ব বজায় রাখে বঙ্গীয় নারী সমাজ। বরং জোট বাঁধে তৎকালীন সর্বাধিক সক্রিয় নারী সংগঠন, উইমেন’স ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন-এর সঙ্গে।
১৯২৫ সালে আইনসভায় মেয়েদের ভোটাধিকার পাশ হল সহজেই। কী বদলেছিল মাত্র চার বছরে? প্রতিনিধিদের মানসিকতায় আমূল পরিবর্তন এসেছিল, আদৌ না। বদলে গিয়েছিল আইনসভার সদস্যরা। ১৯২১ সালে অসহযোগ আন্দোলনের ডাকে সাড়া দিয়ে নির্বাচন বয়কট করেছিলেন গান্ধীবাদীরা। তখন আইনসভায় ছিলেন প্রধানত সাবেক কংগ্রেসি নেতা, আর ইংরেজভক্ত জমিদারের দল। তাঁরা মেয়েদের ঘরের বাইরে বেরোনোর প্রস্তাব শুনলেই চটে উঠতেন। চিত্তরঞ্জন দাশের নেতৃত্বে স্বরাজ পার্টি ১৯২৩ সালে বাংলার প্রাদেশিক আইনসভায় অনেকগুলো আসনে জিতে এল। যদিও স্বরাজ পার্টি বা কংগ্রেস, কোনও দল মেয়েদের ভোটাধিকারকে পার্টিগত ভাবে সমর্থন করেনি (সংরক্ষণশীলদের চটানোর ভয়ে), তবু চিত্তরঞ্জনের অনুগামীরা ছিলেন প্রধানত উদারপন্থী। বাংলার মেয়েদের ভোটাধিকার পাশ হয়ে গেল।
নারী-আন্দোলনের প্রথম যুগের লড়াইয়ের এই পর্ব নানা ভাবে আজকের অবস্থার পূর্বসূরি। ২০১০ সালে রাজ্যসভায় পাশ হয়েও চোদ্দো বছর আটকে ছিল মহিলা বিল। কংগ্রেস বা বিজেপি, কেউই পুরুষতন্ত্রের ভিমরুল-চাকে খোঁচাটি মারতে চায়নি। মেয়েদের ‘ভোটব্যাঙ্ক’ নামক মধুভাণ্ডটি লুটে খেতে যেটুকু দরকার, সেটুকুই করেছে।
তবে সে যুগের মেয়েদের লড়াইয়ের কৌশলটিও লক্ষণীয়। রাজনৈতিক বিরোধিতার মোকাবিলায় সে দিন বাংলার মেয়েরা সচেতন ভাবে নারী-আন্দোলনের মঞ্চকে বেছে নিয়েছিলেন। হয়তো সেই যৌথতা খুব এগোতে পারেনি। কিন্তু রাজনৈতিক সক্ষমতা চাইলে কেবল পুরুষতান্ত্রিক দলীয় রাজনীতির উপর নির্ভর করা চলে না, তার বাইরে মেয়েদের সংগঠন দরকার, সেই বোধটা জেগেছিল। তারই চূড়ান্ত প্রকাশ হয় ১৯৩১ সালে, মেয়েদের পৃথক কংগ্রেস গড়ার জন্য সরলা দেবী চৌধুরাণীর আহ্বানে। তিনি বলেছিলেন, পুরুষ চিরকালই মেয়েদের বিশেষ অনুগ্রহের পাত্র বলে দেখবে, যদি না মেয়েরা নিজেরা তা প্রত্যাখ্যান করে, সমান মর্যাদার আসন দাবি করে।
আজ ক্ষমতাসীনের আধিপত্যের ইচ্ছা এমন অতিকায় হয়ে উঠেছে যে, পুরুষ-নারী নির্বিশেষে নাগরিক পর্যবসিত হয়েছে সেই স্থানে, যা পুরুষতন্ত্র নারীকে দিয়ে এসেছে। চারিদিকে বড় বড় পোস্টার, ‘দিদিকে বলো,’ ‘মোদী কা গ্যারান্টি’। কোনও এক শক্তিমান, ন্যায়বান, সর্বগুণধর ব্যক্তি আছেন, তাঁর কাছে আবেদন পৌঁছে দাও, তাঁর উপরে ভরসা রাখো, যা করার তিনি করবেন। যা পাবে না, জানবে তা তোমার পাওয়ার কথাই ছিল না। এ কথাগুলো মেয়েদের কাছে অতি পরিচিত— ঘরে বাপ-পিতেমোর কাছে শুনেছে, বাইরে গান্ধী-নেহরু কিংবা কমিউনিস্ট নেতাদের কাছেও শুনেছে। অনেক ঠেকে ও ঠকে মেয়েরা শিখেছে, ভরসা রাখা যায় কেবল নিজের উপর, নিজের শক্তি আর সাহসের উপর। ক্ষমতাসীনের উপর নির্ভরতার রাজনীতি মেয়েদের রাজনীতি নয়। রাজনীতিতে, কর্মক্ষেত্রে, যে ক’ইঞ্চি এগিয়েছে মেয়েরা, তা নিজেদের ভরসায়। বহু ব্যর্থ জীবন দিয়ে তৈরি পথ, তা দিয়ে মেয়েরা এগিয়েছে সাম্যের দিকে, সাফল্যের দিকে।
রাষ্ট্রশক্তি সে পথে দেওয়াল তুলেছে বার বার। মেয়েদের কণ্ঠহীন করে, শুধু মুখ করে রাখতে চেয়েছে। নব্বইয়ের দশকে মেয়েরা পঞ্চায়েত ব্যবস্থায় প্রবেশ করল, তার পর ক্রমাগত ক্ষয় হয়েছে পঞ্চায়েতের স্বাতন্ত্র্যের। এখন মেয়েরা সংসদে বড় সংখ্যায় আসার আগেই সংসদ তার গণতান্ত্রিক চরিত্র হারাতে বসেছে (সপ্তদশ লোকসভায় পঁয়ত্রিশ শতাংশ বিল পাশ হয়েছে এক ঘণ্টার কম সময়ে)। তাই কেবল খিল ভাঙার নোড়া-কুড়ুল হলেই হবে না, চাই ঝাঁটা, রাজমিস্ত্রির যন্ত্রপাতি। নেতা-সর্বস্ব পৌরুষশাসিত রাজনীতিকে সাফ করে নতুন রাজনীতি গড়লে, তবে না তৈরি হবে মেয়েদের উপযুক্ত সংসদ। দিল্লি দূরে, তবু দিল্লিই যেতে হবে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy