— ফাইল চিত্র।
আকবর এবং সীতা, দুই সিংহ-সিংহীর এই নাম নিয়ে মামলা করল বিশ্ব হিন্দু পরিষদ। শুনানি চলাকালীন বিচারপতি প্রশ্ন তোলেন, কোনও ধর্মের আরাধ্য ঈশ্বর-পির-পয়গম্বরের নামে পশুদের নাম রাখাটা কত দূর সমীচীন? এই শুনানির ফলে দুই সিংহের নাম পরিবর্তনের প্রক্রিয়া শুরু হয়, এবং ধর্মীয় ভাবাবেগে আঘাত দেওয়ার অপরাধে বন দফতরের অধিকর্তাকে সাসপেন্ড করা হয়। আপাতদৃষ্টিতে মনে হতেই পারে, কিছুটা সতর্ক হয়ে যদি সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় রাখা যায়, তা হলে যে কোনও শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষই তা চাইবেন। সেই পরিপ্রেক্ষিতে দেখলে, বিচারপতির সঙ্গে দ্বিমত হওয়া মুশকিল। তবুও, বিতর্কের সূত্রপাত যখন হলই, তখন আর একটু খতিয়ে দেখা যাক।
আদালত আইনের ব্যাখ্যাকার, সংবিধানের রক্ষক। সংবিধানের ১৯ (১) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, ভারতের সব নাগরিকের বাক্স্বাধীনতার অধিকার স্বীকৃত। তবে, সে অধিকার শর্তহীন নয়, এবং বাক্স্বাধীনতার নামে যথেচ্ছাচারকে সংবিধান মান্যতা দেয় না। ভারতীয় দণ্ডবিধির ২৯৫(এ) ধারা অনুযায়ী, ধর্মীয় ভাবাবেগে আঘাত করা এক দণ্ডনীয় অপরাধ। এই আইন প্রয়োগের ক্ষেত্রে দু’টি শর্ত পূরণ করতে হয়। এক, বিচার্য বক্তব্যটি কোনও এক গোষ্ঠীর ধর্মীয় ভাবাবেগে আঘাত করে; এবং দুই, সেই আঘাতটি ইচ্ছাকৃত ও বিদ্বেষপরায়ণ। আইনের পরিপ্রেক্ষিতে এই সিংহের নামসংক্রান্ত মামলার গোলমাল এখানেই— যিনি বা যাঁরা এই সিংহ দু’টির নামকরণ করেছিলেন, তাঁরা যে স্রেফ বিদ্বেষ ছড়ানোর অভিপ্রায়ে সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে এ কাজ করেছেন, সেটা মনে করার কোনও কারণ আছে কি? এর চেয়ে অনেক বেশি বিশ্বাসযোগ্য ব্যাখ্যা হত এটা যে, সিংহ শাবকদের শৈশবে তাদের এ দেশে দু’টি খুবই প্রচলিত এবং জনপ্রিয় নাম, আকবর এবং সীতা, নামে নামকরণ করা হয়েছিল। সুদূর ভবিষ্যতে এমন একটি বিতর্ক হতে পারে, নামকরণের সময় এত দূর কল্পনা করা সম্ভব ছিল না। এবং ব্যাপারটির এখানেই ইতি টানা যেত।
বাক্স্বাধীনতার প্রশ্নে আর একটি প্রসঙ্গ উঠে আসে। বাক্স্বাধীনতা রক্ষা করার প্রথম শর্ত হল, যে বক্তব্যের সঙ্গে আমরা সহমত পোষণ করি না, অথচ যা প্রকাশ করার অধিকার আইনে স্বীকৃত, সেই বক্তব্যকে যে কোনও প্রকারে রক্ষা করা। সেই স্বাধীনতা রক্ষা করা অনেক সময়ে আমাদের অস্বস্তির কারণ হলেও, যে-হেতু বাক্স্বাধীনতার দ্বারা গণতন্ত্রের উন্নতিসাধন হয়ে থাকে, সে-হেতু সেই অস্বস্তিটুকু সমাজকে সহ্য করে নিতে হয়। গণতন্ত্রে এটাই দস্তুর। আর একটি প্রশ্ন হল, কলার-তোলা ভক্তিহীনতার যে বাক্স্বাধীনতা, ভারতীয় সংবিধান কি তাকেও রক্ষা করে? ভারতে ‘ব্লাসফেমি’-র বিরুদ্ধে কোনও আইন নেই। ধর্মীয় আধিপত্য যাতে বাক্স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ না করতে পারে, তা নিশ্চিত করাও কি আমাদের সাংবিধানিক কর্তব্য নয়?
যে কোনও মানুষের অধিকার আছে নিজের সন্তান, আত্মীয়পরিজন, এমনকি পোষ্যের ইচ্ছামতো নামকরণ করার। অর্থাৎ, কেউ যদি তাঁর পুত্রের নাম ‘হিটলার’ রাখতে চান, তাঁর সম্পূর্ণ স্বাধীনতা থাকা উচিত সেই নামকরণ করার। নামকরণের স্বাধীনতা তার ব্যক্তিস্বাধীনতার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত, সেখানে দেশের এবং দশের মতামত সম্পূর্ণ ভাবে অপ্রাসঙ্গিক। অতএব প্রশ্ন ওঠে, সিংহের এই নামকরণে দোষ কোথায়? দোষের মধ্যে এই যে, মনুষ্যশিশুর ক্ষেত্রে যে স্বাধীনতা আছে, তা পশুপাখির ক্ষেত্রে নেই। পোষ্য সারমেয়র নামকরণ যদি কোনও দেবতার নামে হয়, সেটি দেবতার অবমাননার শামিল— যদিও কোনও শিশুর একই নাম দিলে তাতে একই দেবতা (বা তার ভক্তেরা) উল্টে তুষ্ট হন। অর্থাৎ, একই নামে পৃথক ফল।
এটি কোনও আইনি বা সাংবিধানিক নীতি নয়, বরং সামাজিক শিষ্টাচারের মধ্যে পড়ে। এই চিন্তার ভিত্তি হল যে, মানুষ সর্বোৎকৃষ্ট জীব, পশু নিকৃষ্ট। পশুর সঙ্গে মানুষের তুলনা চলে না। পৃথিবীর বেশির ভাগ দেশেই পশুর সঙ্গে তুলনা করে বিভিন্ন গালিগালাজের প্রচলন আছে। মানুষ চিন্তাশীল জীব, এবং তার চিন্তার, চেতনার কারণে সে পৃথিবী শাসন করে। সেই পৃথিবীতে অন্য জীবজন্তুকে সে জায়গা ছেড়েছে, কিন্তু তাদের জায়গা সর্বদাই তার নীচে। মানুষের বানানো আইনে তার অধিকার সর্বাগ্রে প্রতিষ্ঠিত। অথচ, এই শ্রেণিবিভাজনের বিপক্ষে ইদানীং বেশ কিছু প্রবল মতামত উঠে আসছে। পশুপ্রেমীরা প্রশ্ন তুলতেই পারেন, যে সন্তানস্নেহে পশুপালন করছে সেই ব্যক্তি তার আরাধ্য দেবতার নামে কেন তার পোষ্যের নামকরণ করতে পারে না? পশু-জগতেও মানুষের তৈরি শ্রেণিবিন্যাস আছে। গবাদি পশুর ক্ষেত্রে যে সকল নাম গ্রহণযোগ্য, অন্যান্য গৃহপালিত পশুর ক্ষেত্রে তা নয়। গরুর নাম সাবিত্রী বা সীতা দিলে সম্ভবত বিতর্ক হবে না, সারমেয়র ক্ষেত্রে সে নাম রাখলে কেলেঙ্কারি! এই বিন্যাসের কোনও যুক্তিগত সারবত্তা আছে কি?
বাক্স্বাধীনতা রক্ষার জন্য সংবিধানের একটি ধারা প্রণয়ন করা হলেও, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা খর্ব করার মতো আইনের ধারা অগুনতি। সংবিধানে প্রতিষ্ঠিত যে কোনও অধিকারেরই সীমা থাকে, কোনও অধিকারই নিঃশর্ত নয়। কিন্তু যে অধিকারের প্রয়োগ গণতন্ত্রের জন্য অত্যাবশ্যক, সেটির সীমা নির্ধারণের ক্ষেত্রে আরও বেশি সচেতন হওয়া দরকার। ধর্মীয় ভাবাবেগকে তুষ্ট করতে গিয়ে ব্যক্তিস্বাধীনতাকে সঙ্কুচিত করে ফেললে ভবিষ্যতে আরও অনেক তসলিমা নাসরিন, সলমন রুশদি বা শার্লি এবদো’র মতো ঘটনা অবশ্যম্ভাবী।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy