উদ্যাপন: নববর্ষের সকালে মঙ্গল শোভাযাত্রা। কলকাতা, ২০১৮। ফাইল চিত্র।
১৪২৯ সালের পয়লা চৈত্র আমি ভিয়েনা গিয়েছিলাম আমার শিক্ষকস্থানীয় মানুষ ইতিহাসবিদ রণজিৎ গুহকে দেখতে। আর কিছু দিনের মধ্যেই তিনি শতবর্ষ পূর্ণ করবেন। কথায় কথায় জিজ্ঞেস করলাম, আজকাল কী নিয়ে ভাবেন? বললেন, “জীবন।” আমি বললাম, জীবন নিয়ে কী ভাবেন? বললেন, “এই, জীবনের অর্থ কী, তাই নিয়ে ভাবি।” আমি কিছুটা কৌতুক, কিছুটা আগ্রহভরে বলি, অর্থ কী? শীর্ণদেহী, ক্ষীণকণ্ঠী মানুষটি তাঁর ঈষৎ ঘোলাটে চোখ দু’টি দূরে প্রসারিত করে বললেন, “উৎসাহ। উৎসাহ থেকেই স্মৃতি।” কথাটার মধ্যে এমন একটা উপলব্ধিজাত জোরালো সত্য ছিল যে, আমি খানিক ক্ষণ একটু চুপ করেই ছিলাম। ঠিকই তো, যা নিয়ে আমাদের স্ফূর্তির ভাব হয়, সেখানে যে জীবনীশক্তিরই একটি স্ফুরণ ঘটে, তা কে অস্বীকার করবে? এবং হয়তো সে সব কথাই আমাদের স্মৃতিতে, ব্যবহারে বেঁচে থাকে।
বাঙালি জীবনে পয়লা বৈশাখের তাৎপর্য নিয়ে ভাবতে গিয়ে রণজিৎদার কথাটাই আবার মনে পড়ল। ভাবলাম, নববর্ষের যে সব উৎসব আমরা জনজীবনে দেখি— তা ঢাকার রাস্তায় পান্তা-ইলিশ খাওয়ার হিড়িকই হোক, বা বাড়িতে চৈত্রসংক্রান্তির তেতো, নাড়ু ইত্যাদির সেবন বা নিদেনপক্ষে কলকাতার নানান বাঙালি রেস্তরাঁর পয়লা বৈশাখের অনুমেয় মেনুই হোক— সেই সব ‘উৎসাহ’-এ বাঙালির কোন জীবনের স্ফুরণ হয়? একটু ভাবলে বুঝতে অসুবিধে হয় না যে, এটি সকল বাঙালির লৌকিক জীবন। আজ তার একটা নাগরিক প্রকাশ দেখতে পাই, কিন্তু এই জীবনের উৎস স্পষ্টতই পুরাতন কৃষিভিত্তিক গ্রামীণ সমাজের পালা-পার্বণে, মেলা-উৎসবে। ঋতুচক্রের আবর্তনে, ফসল ঘরে আনা আর জমিদারি ও দোকানির হালখাতার হিসাবের স্মৃতি-ইতিহাস বহন করে আর পাঁজির হাত ধরে যে পয়লা বৈশাখ ফিরে ফিরে আসে, তার নিয়মিত প্রত্যাবর্তন প্রাকৃতিক ইতিহাসের সত্য। সুকুমার রায় তাঁর ‘বর্ষশেষ’ কবিতায় জগতের এই ঘুরপাক খাবার কথাটা নিয়ে তাঁর স্বভাবসিদ্ধ ভাবে রসিকতা করেছিলেন: “রবি যায় শশী যায় গ্রহ তারা সব যায়/ বিনা কাঁটা কম্পাসে বিনা কল কব্জায়।”
কিন্তু প্রাকৃতিক হলেও পৃথিবীর ঘোরাঘুরির তথা ঋতু-পরিবর্তনের সত্যকে একটা মানুষী অর্থ দিয়ে বাঙালি তার গ্রামীণ, ঋতুনির্ভর লৌকিক জীবনের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ করে নিয়েছিল। সময়ের একমুখী স্রোত, আর যেন তারই সঙ্গে আড়াআড়ি ভাবে চক্রাকারে ঋতুদের যাওয়া আর আসা— এই দুইয়ের হিসাব রেখে আমরা কালের অমোঘ যাত্রার সঙ্গে নিজেদের নশ্বর জীবন মেলাই। তাই এই দিনটির প্রত্যাবর্তনকে আমরা উদ্যাপন করি। পুরনো বছরকে বিদায় দেওয়া, নতুন বছরকে বরণ করা ঘিরে আমাদের বাঙালি লৌকিক জীবনের একটা নবীকরণ হয়। যুগের নিয়মে আজ এই লৌকিক জীবন শহরমুখী। কিন্তু পরিবর্তন হলেও এ জীবন দীর্ঘস্থায়ী। এর শিকড় ইতিহাসের— এমনকি আমাদের শরীরেরও— গভীরে। শহুরে মানুষ বলতে পারেন, “চলো, ঢাকার পয়লা বোশেখ দেখে আসি” বা “আজ কোনও বাঙালি রেস্তরাঁয় খেয়ে আসি”— কিন্তু এই ইচ্ছার মধ্যে প্রচ্ছন্ন যে উৎসাহ, সে তার সমস্ত শহুরে চেহারা নিয়েও যার কথা স্মরণ করিয়ে দেয়, তা আমাদের লৌকিক জীবন। নগরায়ণ, ‘গ্লোবায়ন’-এর ভিতর দিয়েও বাঙালির এই লৌকিক জীবনের ধারা বহমানা।
যেখানে আমরা, পশ্চিমবঙ্গের বাঙালিরা, ‘সত্তার কর্কট’-এ ভুগি— কথাটা বিষ্ণু দে’র কাছ থেকে ধার করে বললাম— সেটা আমাদের আধুনিক ব্যক্তি-জীবন বা জাতীয় জীবন রচনার ক্ষেত্রে। এক সময়, ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে, রবীন্দ্রনাথ প্রমুখেরা চেয়েছিলেন বাংলা নববর্ষ-উৎসব পালনের ভিতর দিয়ে বাঙালির একটি সার্বভৌম ব্যক্তি-সত্তা ও জাতি-সত্তা গড়ে তুলতে। পশ্চিমে যাকে বলা হত— বা এখনও হয়— নিউ ইয়ার্স রেজ়লিউশন, তা থেকে গ্রহণ করেছিলেন নববর্ষে সঙ্কল্পের ধারণা। “নব বৎসরে করিলাম পণ/ লব স্বদেশের দীক্ষা” (উৎসর্গ) থেকে শুরু করে “আজি বাঁধিতেছি বসি সংকল্প নূতন/ অন্তরে আমার” (নববর্ষে, চিত্রা, ১৩০১) ইত্যাদি পঙ্ক্তিগুলো স্মরণ করুন। রবীন্দ্রনাথ জানতেন, “বিশ্বজগতে... নববর্ষ চিরপ্রবহমান নদীর মতো অবিশ্রাম চলেছে... প্রকৃতির মধ্যে নববর্ষের দিন বলে কোনো একটা বিশেষ দিন নেই।” কিন্তু “সেই [নিত্য] নববর্ষকে মানুষ সহজে গ্রহণ করতে পারে না— তাকে চিন্তা করে গ্রহণ করতে হয়... তাই মানুষের পক্ষে নববর্ষকে অন্তরের মধ্যে গ্রহণ করা একটা কঠিন সাধনা, এ তার পক্ষে স্বাভাবিক ঘটনা নয়।” (নববর্ষ, শান্তিনিকেতন, ১৩১৮)।
অন্যত্রও নববর্ষের ‘ব্রত’র কথা বলেছেন রবীন্দ্রনাথ, প্রার্থনার কথা। ধর্ম গ্রন্থে গ্রন্থিত ১৩০৮ সালে প্রদত্ত দু’টি ভাষণ— ‘বর্ষশেষ’ ও ‘নববর্ষ’— এক সঙ্গে মিলিয়ে পড়লে সে কথা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। ব্যর্থ প্রাণের আবর্জনা সরিয়ে ফেলা তাঁর সঙ্কল্প, সেই ‘ব্রতগ্রহণ’-এর জন্য হৃদয় প্রস্তুত (নববর্ষ), প্রার্থনা করছেন, ‘তুমি আমাকে পরাভূত হইতে দিয়ো না’ (বর্ষশেষ)। এই প্রার্থনা শুধু ব্যক্তিগত প্রার্থনা ছিল না রবীন্দ্রনাথের। আশ্রমিকদের প্রতি ভাষণ এগুলো, রবীন্দ্রনাথের কল্পিত গোষ্ঠীজীবনে ‘নববর্ষ’ পালনের স্থান কী ছিল, তারই একটা আভাস পাওয়া যায় এই সব কবিতা ও প্রবন্ধ পড়লে। কেবল বাঙালির চিরাচরিত লৌকিক জীবনের স্ফুরণে তা আবদ্ধ ছিল না। জাতীয় জীবন ও ব্যক্তিজীবনের মধ্যে একটি সমন্বয়ের সূত্র খুঁজতেন তিনি— বিশ্বস্রষ্টার কাছে প্রণত, কিন্তু নিজের মধ্যে সার্বভৌম এক সত্তার ধারণাই ছিল সেই সূত্র।
পশ্চিমবঙ্গের বাঙালির এই জাতিসত্তা তৈরি করার প্রকল্পটি— চালু বাংলায় যাকে বলে ‘ঘেঁটে গেছে’। দেশভাগ তো হয়েছেই, এবং তাতে সত্তানির্মাণ ও ভাষার প্রশ্নে ভুগেছি আমরাই বেশি। ‘পশ্চিমবঙ্গবাসী’ বলেও বৃহৎ কোনও সত্তা তৈরি করতে পারিনি। সমতটের মানুষ গায়ে রাজনৈতিক ধাক্কা এসে না পড়লে, বা পর্যটনের প্রয়োজন ছাড়া উত্তরবঙ্গের মানুষের কথা নিয়ে ভাবিত হন না। সংবাদ ও সাংস্কৃতিক মাধ্যমের বাংলা ভাষার মধ্যে এখনও আঞ্চলিক বাংলা প্রান্তিক হয়ে থাকে। আর পশ্চিমবঙ্গের বাঙালি-অবাঙালি মুসলমানরা আমাদের ভোটব্যাঙ্ক না দেশের শত্রু, রাজনৈতিক বিতণ্ডা এখনও এই প্রশ্নের বাইরে বেরোতে পারে না। এ দিকে সচ্ছল বাঙালি হিন্দি আর ইংরেজির রাজত্বে বিচরণ করেন, ভাবেন ‘ইন্ডি-বং’ হওয়াতেই এখন যাবতীয় সাফল্যের চাবিকাঠি। আর তাঁদের দোষই বা দিই কী বলে? গত বেশ কয়েক দশক ধরে পশ্চিমবঙ্গের শাসকরা দেশভাঙা বাঙালির এই ‘জাতিসত্তা’র সঙ্কটের দিকটা ধর্তব্যের মধ্যেই আনেননি। তাই ‘ইন্ডি-বং’এর আড়ালেও রয়ে গিয়েছে ওই লুচিপ্রিয়, ইলিশলুব্ধ বাঙালিই— আমাদের লৌকিক জীবন।
রবীন্দ্রনাথের কাঙ্ক্ষিত নববৎসরের ‘পণ’ যে বাঙালির ধাতে পোষাবে না, এই সত্য মনে হয় অনেক দিন আগেই বুঝেছিলেন সুকুমার রায়। তাঁর অননুকরণীয় ভঙ্গিতে লিখেছিলেন ‘নিরুপায়’ কবিতাটি: “বসি বছরের পয়লা তারিখে/ মনের খাতায় রাখিলাম লিখে—/ ‘সহজ উদরে ধরিবে যেটুক্/ সেইটুকু খাব, হবো না পেটুক’।” কিন্তু প্রতিজ্ঞা করলে কী হবে? মাস দুই পরে কবি খাতাটি খুলে দেখেন, এরই মধ্যে মনের সঙ্কল্প গভীর ভাবে বিচলিত! মন একটি অন্য কথা তার নিজের খাতায় লিখেছে: “লিখিয়াছে, যদি নেমন্তন্নে/ কেঁদে ওঠে প্রাণ লুচির জন্যে/ উচিত হবে কি কাঁদানো তাহারে?”... আর কী? লুচির মাধ্যাকর্ষণের এই প্রবল শক্তির কাছে কবির সঙ্কল্প আত্মসমর্পণ করে ভেসে গেল! এবং শেষ পর্যন্ত জয় হল আমাদের লৌকিক জীবনেরই। রবীন্দ্রনাথের নয়, বলরাম, নকুড়েরই জয় হল যেন। সেখানেই আমাদের সবার উৎসাহ।
ঠাট্টা নয়। রণজিৎদার কথাটায় ফিরে আসি। পড়শি দেশ বাংলাদেশে জাতিসত্তার কথাটা সচেতন ভাবে এগিয়েছে। জাতি হিসেবে ওঁরা বাঙালি হবেন, না আরও বৃহত্তর অর্থে ‘বাংলাদেশি’ হবেন, এই নিয়ে ওঁরা সোৎসাহে তর্কে মাতেন। পশ্চিমবঙ্গে বাঙালির তথা পশ্চিমবঙ্গবাসীর আত্মপরিচয়ের প্রশ্নটি আজ রাজনীতির আঙিনায় অবজ্ঞাত, অবহেলিত। আমরা নিজেদের অজানতেই বাঙালির অর্থবলের অভাবে ও ভারতে অন্যান্য ভাষাভাষীর অর্থবলের প্রভাবে পরিবর্তিত হচ্ছি। কলকাতার কিছু নামী-দামি স্কুলে বাংলা একটি ঐচ্ছিক ভাষা হয়ে গেছে। পরিবর্তন স্বাভাবিক। ইতিহাসের ধর্ম। কিন্তু সেই পরিবর্তন নিয়ে কি আমরা ও আমাদের রাজনৈতিক নেতারা সচেতন ভাবে আলোচনা করব না? আমাদের কী প্রেয়, কী আমাদের জন্য শ্রেয়, কী-ই বা সম্ভাব্য ও বাস্তব, এই সব প্রশ্ন এড়িয়ে গিয়ে আমরা কি কেবলই ঘটনার ধাক্কার শিকার হব? নববর্ষের উৎসবের মধ্যে দিয়ে যেন এই প্রশ্নটিও সচেতন ভাবে উত্থিত ও বিতর্কিত হয়, সেই কামনা করি।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy