— ফাইল চিত্র।
সরবেড়িয়া থেকে ধামাখালি অবধি দশ কিলোমিটার রাস্তার দু’পাশে যত দূর দেখা যায়, এবং ধামাখালি ফেরিঘাট থেকে ভটভটি বোট ডাইনে-বাঁয়ে যত জায়গায় নিয়ে যায়, সর্বত্র শেখ শাহজাহানের সাম্রাজ্যের জাল। সন্দেশখালি গ্রাম তো বটেই, বেড়মজুর, আতাপুর, জেলেখালি, তুষখালি, ঝুপখালি, দুর্গামণ্ডপ— গত কয়েক সপ্তাহে বিখ্যাত হয়ে ওঠা এই সব দ্বীপ-গ্রামে শাহজাহান আর তার সাঙাতদের দাপটের কথা গত পাঁচ-সাত বছরে শোনা গিয়েছে বাতাসে কান পাতলেই। তবে, কান পাততে হয়েছে বিলক্ষণ— গত কয়েক দিনের ক্ষোভের বিস্ফোরণের আগে কেউ উঁচু গলায় এ সব কথা বলার সাহস করেননি।
শাহজাহান, শিবু হাজরা, উত্তম সর্দাররা এই যে ত্রাসের রাজত্ব গড়ে তুলেছিলেন, তা চরিত্রগত ভাবে পশ্চিমবঙ্গের অন্যান্য অঞ্চলের চেয়ে কতটা আলাদা? পশ্চিমবঙ্গ এখন এক বিস্তীর্ণ মনসবদারি— কয়েক বর্গ কিলোমিটার অন্তর পাল্টে যায় মনসবদারের নাম। সংবাদমাধ্যমের দৌলতে তেমন কয়েক জনের নাম রাজ্যবাসী জেনেছেন— বীরভূমে অনুব্রত মণ্ডল, ভাঙড়ে আরাবুল ইসলাম, সন্দেশখালিতে শেখ শাহজাহান যেমন। বাকিদের কথা স্থানীয় মানুষরা জানেন। কেন পশ্চিমবঙ্গে এখন এই মনসবদারি ব্যবস্থা নির্বিকল্প, সে কথায় আসব, কিন্তু সন্দেশখালি অঞ্চলের কি কোনও বিশেষ বৈশিষ্ট্য আছে? যে সম্পদ থেকে মনসবদাররা খাজনা আদায় করেন, অথবা যে সম্পদ লুট হয়, সন্দেশখালির ক্ষেত্রে তার চরিত্র কি আলাদা?
উত্তরটা জানা এবং অজানা। খেতে নদীর নোনা জল ঢুকিয়ে তাকে চাষের অনুপযুক্ত করে দিয়ে শেষ অবধি চিংড়ি চাষের ঘের তৈরি করার জন্য সে জমি দখল করার প্রক্রিয়াটি গত কয়েক সপ্তাহে বহু আলোচিত। ভৌগোলিক কারণেই সেই দখলদারির চরিত্র রাজ্যের অন্যান্য অঞ্চলের চেয়ে আলাদা। আর কোথাও এত দ্রুত পাল্টে দেওয়া যায় না জমির চরিত্র— সুন্দরবনের দ্বীপে যায়, কারণ এক বার নোনা জল জমিতে ঢুকলে সে জমি অন্তত কয়েকটা বর্ষা না-খাওয়া অবধি ফের চাষের যোগ্য হয় না। তত দিন অবধি জমি ফেলে রাখা গরিব বা নিম্নমধ্যবিত্তের পক্ষে কঠিন। কিন্তু, তার চেয়েও বড় কথা হল, চার পাশের সব জমি যদি চরিত্র পাল্টে ভেড়ি বা জলকর হয়ে উঠতে থাকে, একা কারও পক্ষেই নিজের জমিকে চাষের জন্য রেখে দেওয়া অসম্ভব।
প্রশ্ন হল, শুধু কি জবরদখলের কারণেই জমির চরিত্র পাল্টেছে? তৃণমূল ক্ষমতায় আসার পরে, শাহজাহানরা দোর্দণ্ডপ্রতাপ হয়ে ওঠার পরই সন্দেশখালি অঞ্চলের কৃষিজমি ক্রমে জলকর হয়ে উঠেছে? তা তো নয়। ১৯৮০-র দশক থেকেই পাল্টে যেতে থাকে জমির চরিত্র— যে জমিতে এক সময় ধান চাষ হত, সেখানে তৈরি হয় জলকর। ছোটখাটো নয়, এক লপ্তে পাঁচ-সাতশো বিঘা মাপের জলকর। ভূমি সংস্কারের উল্টো পথে হেঁটে ফের জমির মালিকানা পুঞ্জীভূত হতে থাকে বড়লোকদের হাতে। কেন, সে কারণ আছে অর্থনীতিতে। এখন সন্দেশখালি অঞ্চলে জলকরের জমির মালিকরা বছরে বিঘাপ্রতি আট থেকে ন’হাজার টাকা লিজ় পান। সেচব্যবস্থাহীন, নোনা জলে ঘেরা বৃষ্টিনির্ভর এক ফসলি জমিতে গায়েগতরে খেটে, কৃষিশ্রমিক নিয়োগ করে কি সে টাকা উপার্জন করা সম্ভব? ২০২২ সালের এক সমীক্ষা থেকে জানা যাচ্ছে, পশ্চিমবঙ্গে ধানচাষে বিঘাপ্রতি গড় লাভ থাকে ৮৫০০ টাকার কাছাকাছি। যে বছর আলুর ভাল দাম পাওয়া যায়, সে বছরও বিঘাপ্রতি চাষে লাভ থাকে বড় জোর ১০,০০০ টাকা। অনুমান করা চলে, তুলনায় অনেক কম উৎপাদনশীল সন্দেশখালির কৃষিজমিতে প্রাণপণ খেটেও এর কাছাকাছি উপার্জন করা কঠিন। জমি জলকরে লিজ় দিলে ঘরে বসে উপার্জন করা যায় এই টাকা। রাজনৈতিক ভাবে প্রভাবশালীদের চাপ এখন যেমন আছে, আগের আমলেও ছিল— জমানাভেদে সে চাপের মাত্রা পাল্টেছে, চরিত্র নয়— কিন্তু, কোনও আমলেই শুধু চাপে পড়ে মানুষ জমি দিয়েছেন বলে মনে হয় না।
জমির সেই চরিত্র পরিবর্তনে শ্রেণির গল্প ছিল বিলক্ষণ— যে কোনও জমির ক্ষেত্রেই যেমন থাকে। জলকরে জমি দিয়ে দিলে বড় আয়তনের জমির মালিকের লাভ; জমির আয়তন যত ছোট হয়, লাভের মাপও সে ভাবেই কমতে থাকে। ছোট জমির মালিকের ক্ষেত্রে জমি যতখানি রোজগারের, তার চেয়ে বেশি বেঁচে থাকার উপাদান— জমির ফসল বাজারে বিক্রি করে সংসার চলে যতটা, তার চেয়ে বেশি সেই ফসল পাতে খাবার জোগায়। সে জমি থেকে লিজ়ের যতটুকু টাকা পাওয়া যায়, তা দিয়ে বাজার থেকে খাবার কিনতে গেলে পাতে টান পড়ে। হঠাৎ প্রয়োজনে জমি বিক্রি করাও মুশকিল। এর চেয়েও বড় সমস্যা ভূমিহীনদের। কৃষিতে কয়েক মাস হলেও যাঁদের শ্রমিকের কাজ জুটত, জমিতে জলকর হলে তাঁদের পরিযায়ী শ্রমিক হওয়া ছাড়া উপায় থাকে না। ঘটনাক্রমে, সন্দেশখালি অঞ্চলে কর্মক্ষম বয়সের পুরুষদের একটা বড় অংশ এখন পরিযায়ী। কিন্তু, আবারও সেই কথা— বাজারের নিয়ম মেনে জমিতে জলকর হলে যে সমস্যা, শাহজাহানরা গায়ের জোরে জমি দখল করলেও সেই সমস্যাই। সিঙ্গুরে কারা জমি দিতে চেয়েছিলেন, আর কারা আপত্তি করেছিলেন, সেটা ভাবলেই বোঝা যাবে, এ সমস্যা সন্দেশখালির নিজস্ব হতে পারে না।
সন্দেশখালির মূল সমস্যাটি জমির চরিত্র পাল্টে যাওয়ায় নেই, আছে রাজ্য জুড়ে চলা মনসবদারি মডেলে। তৃণমূল কংগ্রেসের রাজত্বে অলিখিত নিয়ম দাঁড়িয়েছে, যিনি যতটুকু জায়গায় নিজের দাপট বজায় রাখতে পারবেন, সেখানকার খাজনা আদায়ের অধিকারও তাঁরই। সে খাজনা দু’দিক থেকেই আসে— সরকারি বরাদ্দ বণ্টনের ক্ষেত্রেও, আবার স্থানীয় সম্পদের দখলের মাধ্যমেও। খেয়াল করে দেখার, গোটা রাজ্য যে ভঙ্গিতে চলে, শাহজাহান বা শিবু-উত্তমরা তার চেয়ে খুব আলাদা কিছু করেননি। ফারাক যদি থাকেও, তা মাত্রার, চরিত্রের নয়। রাত এগারোটায় পার্টি অফিসে ডেকে পাঠানো, দোকান-বাজারে দেদার দেনা ফেলে রাখা, গোটা এলাকার যাবতীয় ঘটনায় বিচারের কর্তা হয়ে বসা, বিরুদ্ধতার আভাসমাত্র দেখলে গায়ের জোরে শাসন করা— এমনকি, মহিলাদের প্রতি অতি ঘৃণ্য যে আচরণের খবর রোজ প্রকাশিত হচ্ছে, তাও যে শুধুমাত্র সন্দেশখালির সমস্যা নয়, সে প্রমাণও কার্যত রোজই মিলছে। মনসবদারি চালানোর জন্য এই দাপটের কোনও বিকল্প নেই। মানুষ যদি ভয় না পায়, তা হলে খাজনা দেবে কেন?
প্রশ্ন হল গোটা রাজ্য যে ভাবে চলছে, ঠিক সেই চলনেই সন্দেশখালিতে কেন এমন ক্ষোভের বিস্ফোরণ ঘটল?
সেখানে আবার সন্দেশখালির নিজস্ব চরিত্র গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। রাজ্য জুড়ে মনসবদাররা যে স্থানীয় সম্পদ লুট করেন, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তা সর্বজনীন সম্পদ— নদীর বালি, জঙ্গলের কাঠ, খাদানের কয়লা। এমন সম্পদ লুটে মনসবদারদের লাভ হয় বিলক্ষণ, কিন্তু সাধারণ মানুষের প্রত্যক্ষ ক্ষতি হয় না। সন্দেশখালিতে এমন সর্বজনীন সম্পদ হতে পারত নদীর জল। কিন্তু, সে জলের আর্থিক মূল্য নেই তেমন। নদীর পাড়ের মাটির আছে, তাকে লুট করে ইটভাটাও চলছে। কিন্তু, সন্দেশখালির আসল মূল্যবান সম্পদ হল জলকর— নোনা জলে সোনা ফলানোর জন্য যা অত্যাবশ্যক। মুশকিল হল, সে জমি ব্যক্তিমালিকানার অধীন। জমির মালিকের জলকরে জমি দিতে আপত্তি যদি না-ও থাকে, লিজ়ের টাকা না পেলে আপত্তি থাকবে তো বটেই। কিন্তু, মনসবদারির মডেলে তো লিজ়ের টাকা কড়ায়-গন্ডায় মিটিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা নেই। থাকতে পারে না, কারণ এই ব্যবস্থার মূল শর্তই হল, যত দিন হাতে ক্ষমতা থাকবে, তত দিন অবধি সর্বোচ্চ পরিমাণ সম্পদ শুষে নেওয়া। সন্দেশখালিতে শাহজাহানরা ঠিক তাই করেছেন। নিয়মিত লিজ়ের টাকা পেলে যাঁদের জমি দিতে আপত্তি থাকত না, এই গা-জোয়ারিতে চটেছেন তাঁরাও, জমি দিতে অসম্মত হয়েছেন। এবং, অসম্মতির মাত্রা যত বেড়েছে, শাহজাহানদের অত্যাচারও ততই বেড়েছে।
গোলমালটা আসলে এখানেই— সর্বজনীন সম্পদ লুণ্ঠনের মডেলটিকে ব্যক্তিগত সম্পদের ঘাড়ে চাপিয়ে দেওয়া। ত্রাণের বা কর্মসংস্থান যোজনার টাকা লুট হলে মানুষ যতখানি চটে, তার চেয়েও বেশি চটে জমির অধিকার কেড়ে নিলে। কেন, সে এক আলাদা আলোচনা। এ ভাবে জমি দখল করে নেওয়া যে মারাত্মক ভুল হচ্ছে, শাহজাহান-শিবু-উত্তমরা সে কথা বুঝবেন না, তা এক রকম প্রত্যাশিতই। কিন্তু, তাঁদের যাঁরা নেতা, তাঁরাও এই ভুল ধরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করলেন না কেন, সেটাই আশ্চর্যের। না কি, এখানে যে কোনও ভুল আছে, লুণ্ঠনের পলিটিক্যাল ইকনমিও যে সর্বত্র এক রকম হয় না, সেটাই বোঝেননি তাঁরা?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy