Advertisement
২২ নভেম্বর ২০২৪
নারীর রাজনৈতিক অধিকারের প্রশ্নকে সরকার কী ভাবে দেখছে
Women Reservation Bill

মহিলাদের জন্য ‘উপহার’?

সংবিধানের এই ১০৮তম সংশোধনী বিলটিকে সংবাদমাধ্যমে সহজে বোঝা এবং বোঝানোর জন্য কী লেখা হচ্ছে? মহিলা সংরক্ষণ বিল, কখনও বা আরও ছোট করে মহিলা বিল। কিন্তু বিলের গালভরা নামটা কী?

An image of Women

প্রাপক: মহিলা সংরক্ষণ বিল পাশ হওয়ার পর বিজেপি নেত্রীরা উদ্বাহু কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছেন, দিল্লি, ২২ সেপ্টেম্বর। ছবি: পিটিআই।

জাগরী বন্দ্যোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ০৪ অক্টোবর ২০২৩ ০৪:২৮
Share: Save:

হইহই করে পাশ হয়ে গেল মহিলা সংরক্ষণ বিল। কেন্দ্রীয় সরকার দৃশ্যতই পুলকিত। এমন একটি ঐতিহাসিক কাজ সমাধা করতে পেরে তাঁরা যারপরনাই খুশি হয়েছেন। এতটাই খুশি হয়েছেন যে, প্রধানমন্ত্রী নিজেকে ঈশ্বরপ্রেরিত দূত বলেও ভাবতে এবং বলতে শুরু করেছেন। কিন্তু আমরা যারা ঈশ্বরের নেহাতই মামুলি সন্তান, আমাদের ছিদ্রান্বেষী মন কেবলই কুটকুট করে। একে তো এই বিল কবে কাজে পরিণত হবে তার ঠিক নেই। যাঁরা এই বিল পাশ করাতে এত উদ্‌গ্রীব ছিলেন, দেশ জুড়ে মহিলাদের নানা বিপদে-আপদে তাঁরা কী ভূমিকা পালন করেছেন, সেটাও চোখের সামনে দেখা আছে। কিন্তু সেই সব কথা তুলে বিলটি পাশ হওয়ার গুরুত্বকে খাটো করতে চাই না। যে কাঁটাটা খচখচ করছে, সেটা অন্য।

সংবিধানের এই ১০৮তম সংশোধনী বিলটিকে সংবাদমাধ্যমে সহজে বোঝা এবং বোঝানোর জন্য কী লেখা হচ্ছে? মহিলা সংরক্ষণ বিল, কখনও বা আরও ছোট করে মহিলা বিল। কিন্তু বিলের গালভরা নামটা কী? নারীশক্তি বন্দন অধিনিয়ম। চট করে শুনলে পুজোপাঠের বিধিপুস্তক মনে হতে পারে। সংসদীয় প্রতিনিধিত্বের সঙ্গে এই চণ্ডীমঙ্গলের কী যোগসূত্র? ঈশ্বরের দূত ছাড়া সাধারণ বুদ্ধিতে ঠাহর করতে পারা মুশকিল। আবার মুশকিল নয়ও। সরকার কোন দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বিলটিকে দেখছে, এই নামকরণ তারই একটা দলিল। সেখানেই বিসমিল্লায় গলদ।

প্রতিনিধিত্বের অধিকার একটি রাজনৈতিক অধিকার। সংরক্ষণ একটি রাজনৈতিক প্রস্তাবনা, একটি সাংবিধানিক প্রকল্প। তাকে নারীশক্তি বন্দনার মোড়কে চালিয়ে দিলে তার রাজনৈতিকতাকে ভুলিয়ে দেওয়া হয়। নারীর রাজনৈতিক স্বরকে অস্বীকার করা হয়। লোকসভায় কেউ কাউকে বন্দনা করতে আসে না। লোকসভা মানে ময়দানি রাজনীতিতে লড়ে আসা, দাবিদাওয়া নিয়ে সরব হওয়া, তর্ক-বিতর্কে যোগ দিয়ে রাজনৈতিক অবস্থানকে তুলে ধরা। সংরক্ষণ চাওয়া হয় সমাজের বিভিন্ন বর্গের উপযুক্ত প্রতিনিধিত্বের দাবিতে। নির্বাচনী প্রতিযোগিতা এবং আইনসভার কাজকর্মে যাতে বহুবর্গীয় কণ্ঠস্বর জায়গা পায়, সেটা নিশ্চিত করাই তার উদ্দেশ্য। এই রাজনৈতিক বণ্টনের প্রশ্নে বন্দনার স্থান কোথায়? যা আমার ন্যায্যত প্রাপ্র্য, যা আমার সাম্যের অধিকার, তাকে অর্চনার ডালি বলে এগিয়ে দিলে কিছুমাত্র গৌরব নেই, বরং হীনতারই প্রাবল্য আছে।

নারীর স্বশক্তিকরণ একটি সামাজিক-রাজনৈতিক দাবি। লিঙ্গসাম্যের বাস্তবায়ন সংবিধানপ্রদত্ত মৌলিক অধিকারের অঙ্গ। নারীকে সমদৃষ্টিতে দেখাই তার মূল উপাত্ত। সেখানে বন্দনার কথা উঠবে কেন আদৌ? রাষ্ট্র কি তবে নিজেকে দেবী-র ছবি বিশ্বাসের আসনে বসাচ্ছে? এই আরোপিত দেবীত্বে কোন লাভটা হবে নারীর? কে চেয়েছে দেবী হতে? কে চেয়েছে বন্দনা? ‘পূজা করি মোরে রাখিবে ঊর্ধ্বে সে নহি নহি, হেলা করি মোরে রাখিবে পিছে সে নহি নহি।’ রক্তমাংসের শরীর নিয়ে মাথা উঁচু করে বাঁচতে চায় নারী। সে চায় প্রতিনিধিত্ব। সে চায় সমানাধিকার। সে চায় বৈষম্যের অবসান। এই অত্যন্ত সোজাসাপ্টা রাজনৈতিক ভাষ্যে কোনও শক্তির আরাধনা, মাহাত্ম্যের গুণকীর্তন, মাতৃকা উপাসনার স্থান নেই। থাকতে পারে না। যদি থাকে, তা হলে বুঝতে হবে, নারীকে নারী বলে দেখাই যে যথেষ্ট, সেই গোড়ার কথাটাই বেমালুম হাপিশ হয়ে গিয়েছে। বুঝতে হবে, নারীর ব্যক্তিসত্তাকে কিছুতেই ব্যক্তিসত্তার মর্যাদা দেওয়া যাচ্ছে না বলেই নারীশক্তি জাতীয় ভাবগম্ভীর শব্দের আমদানি করতে হচ্ছে। এই যে তথাকথিত নারীশক্তির তথাকথিত বন্দনা, তার অন্তর্নিহিত সারশূন্যতা এবং পিতৃতান্ত্রিক রাজনীতি সম্পর্কে সচেতন না হলে নারীকেও মোহ আবরণের জালে পড়তে হবে। নাকের বদলে নরুন পেয়ে খুশি থাকতে হবে আজীবন।

চার পাশে একটু তাকালেই মালুম হবে, শাসক শিবির বার বারই এই দিকভ্রান্তকারী বাগাড়ম্বরের পসরা সাজাচ্ছেন। এই ক’দিন আগে চন্দ্রযানের সাফল্যকে কেন্দ্র করেও সেটা ঘটতে দেখা গেল। ইসরো-র মহিলা বিজ্ঞানীদের সারিবদ্ধ ছবি ভাইরাল হওয়ামাত্র শুরু হয়ে গেল শাড়ির জয়জয়কার। উৎসবে, অনুষ্ঠানে, নিত্য প্রয়োজনে মহিলারা শাড়ি পরেই থাকেন। কিন্তু সেই শাড়িকে কেন্দ্র করে যখন নারীত্বের আদর্শ মার্কা সংস্কারী বার্তা ধেয়ে আসে, তখন শাড়ি আর স্রেফ পোশাক থাকে না। মহিলা বিজ্ঞানীরাও আর শুধু বিজ্ঞানী থাকেন না। বিজ্ঞানের পাশাপাশি ‘ভারতীয় ঐতিহ্য’ রক্ষার গুরুভার তাঁদের মাথায় চাপে। নারীশক্তির বন্দনা তখন গলায় ফাঁস হয়ে এঁটে বসে। কেরিয়ারসফল নারীকে যেমন বার বার বলতে হয়, তিনি যা করেছেন সংসারকে অবহেলা না করেই করেছেন, মহিলা বিজ্ঞানীর শাড়ি পরা ছবি দেখিয়েও বলা হতে থাকে, এঁরা বিজ্ঞানের সাধনা করেছেন, কিন্তু শাড়ির সংস্কার ছাড়েননি। এই কথাটাই আর কয়েক পা হেঁটে এগিয়ে গেলে ‘জিনস পরা মেয়েরাই ধর্ষিত হয়’-এর ভাষ্যে পৌঁছবে। সে প্রসঙ্গের অবতারণা যদি নাও করি, পিতৃতন্ত্রের ফাঁদটিকে অন্তত চিনে নিতে বলব। যেখানে মহিলারা বিজ্ঞানে সাফল্য পাচ্ছেন এটা বলা আর যথেষ্ট থাকছে না। তাঁরা যে শাড়ি পরে চন্দ্র জয় করেছেন, সেটাই মুখ্য হয়ে উঠছে। শাড়ি/সালোয়ার কামিজ়/শার্ট-প্যান্ট যা-ই পরুন না কেন, নারীর মর্যাদা, নারীর পরিচয় তাঁর কর্মে। পুরুষের মতোই। নারীর সাফল্যকে যদি সত্যিই উদ্‌যাপন করতে হয়, তবে সবার আগে নারীকে পূর্ণাঙ্গ স্বরাট ব্যক্তি হিসাবে দেখার প্রাথমিক অক্ষরজ্ঞানটুকু রপ্ত করতে হবে। নইলে বার বারই বিজ্ঞানের আলোচনায় শাড়ি আর প্রতিনিধিত্বের অধিকারে শক্তিপূজার কাঁসর-ঘণ্টা বাজতে থাকবে।

এ কথা ভেবে নেওয়া ভুল যে, শাসক শিবির স্রেফ অসচেতনতাবশত এই কাজগুলো করে চলেছেন। তাঁরা ইচ্ছে করেই এই গুলিয়ে দেওয়ার খেলায় নেমেছেন। প্রতিটি পরিসরকে নিজেদের মৌলবাদী মতাদর্শের আরকে চুবিয়ে নেবেন বলেই পরিকল্পিত পথে এগোচ্ছেন। নইলে যাঁরা প্রকৃতই বিজ্ঞানের অগ্রগতি নিয়ে ভাবিত, তাঁরা বিজ্ঞানের সিলেবাস থেকে ডারউইন বাদ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিতেন না। যাঁরা নারীশক্তির জয়গানে আগ্রহী, তাঁদের চোখের সামনে পদকজয়ী খেলোয়াড়দের রাস্তায় ফেলে মারা হত না। প্রজাতন্ত্র দিবসের প্যারেডে যাঁরা মেয়েদের সামনে রেখে হাততালি কুড়োন, দেশে নারীর প্রতি অপরাধের পরিসংখ্যান দেখে তাঁদের লজ্জিত হওয়ার কথা ছিল (এনসিআরবি-র রিপোর্ট অনুযায়ী ২০২০ থেকে ২০২১-এ দেশে নারীর প্রতি অপরাধের হার বেড়েছে ১৫.৩ শতাংশ)। দেশবাসীর হিতচিন্তায় ঘুম ভুলেছেন বলে যাঁরা দাবি করেন, দেশে বেকারত্বের চলতি হার দেখে তাঁদের ঘুম সত্যিই ছুটে যাওয়া উচিত ছিল (সিএমআইই-র রিপোর্ট অনুযায়ী অগস্ট মাসে বেকারত্বের হার ৮.৪ শতাংশ)। ভারতীয় গণতন্ত্রের সনাতনি রূপ খুঁজতে গিয়ে যাঁরা ইতিহাস আর পুরাণ মিশিয়ে দিচ্ছেন, সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতার সারণিতে তাঁরা এখন কোথায় দাঁড়িয়ে, সে কথা তাঁদের মনে রাখা দরকার ছিল (আরএসএফ-এর সমীক্ষা অনুযায়ী ১৮০ দেশের তালিকায় ভারত ১৬১-তে)। শাসক শিবির এর কোনওটাই করেননি। নারীশক্তি বন্দনার অধিনিয়মটিও তাঁরা নিয়ে এলেন, নির্বাচনে মোদী-বন্দনার কাজে লাগবে বলে। ওই একটি বন্দনায় তাঁরা কোনও ফাঁক রাখেন না।

২০১৯-এর নির্বাচনের আগে মোদীজি কুম্ভে গিয়েছিলেন। স্নান সেরে উঠে নিজে হাতে সাফাই কর্মীদের পা ধুইয়ে দিয়েছিলেন। বন্দনার মোড়কে সেও ছিল মানবতার প্রতি এক তীব্র অশ্লীল অপমান। যাদের সমাজ নিচুতলায় বসিয়েছে, আমি তাদের সেবা করছি— এই দৃশ্যভাষ্যে আমিত্বের পুজোই সব। মানুষকে সম্মানিত করতে হলে তার পা ধুইয়ে দেওয়ার দরকার পড়ে না। এই লুটিয়ে পড়া ভক্তির দেখনদারিতে আসলে যে সেই মানুষটি আমার চেয়ে কত আলাদা আর আমি কত মহান, সেইটাই জাহির করা হয়। ভয় হয়, নারীশক্তির বন্দনাও না তেমনই কিছু দাঁড়িয়ে যায়। ঈশ্বরের দূতের প্রতি তাই সবিনয় নিবেদন, অধিকারের লড়াইকে পিতৃতন্ত্রের উপঢৌকন বলে চালাবেন না স্যর! খারাপ লাগে।

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy