Advertisement
০৩ ডিসেম্বর ২০২৪
ভিজে খড়, উঁচু জমির ধান, আলু বাঁচানো, ক্ষতির ভাগাভাগি
Cyclone Michaung

অতিবৃষ্টির কয়েক কাহন

ডিসেম্বরের গোড়ায় মিগজাউম সাইক্লোনজনিত নিম্নচাপ এনে দিয়েছে কলকাতায় বর্ষা ও কয়েক জেলায় ভারী অকালবর্ষণ। নিচু জমিতে এখনও জল দাঁড়িয়ে। ওখানে গাড়ি নামবে না। অনেক ধান কাটা যায়নি।

An image of River

দামোদর নদ। —ফাইল চিত্র।

অনিতা অগ্নিহোত্রী
শেষ আপডেট: ০৩ জানুয়ারি ২০২৪ ০৮:৩০
Share: Save:

দামোদর। এই নদ আর তার জলের বেড়াজালকে দেখেছিলাম চল্লিশ বছর আগে, যখন গিরিডি জেলার তেনুঘাটের টিলার উপরের বাড়িটিতে আমার বাস ছিল। দামোদর ও বরাকরের দুই ধারা ছোটনাগপুরের মালভূমি থেকে বার হয়ে বাংলায় এসেছে। আসানসোলের কাছে বরাকর মিশেছে দামোদরে। আর এখানে, দামোদর বয়ে গেছে বর্ধমান ও বাঁকুড়া জেলার সীমান্ত জলরেখা হয়ে। সোনামুখী টাউন ছাড়িয়ে রাধামোহন পুরের পথে কেবল হেমন্তের ধান কাটা মাঠ। গোছা গোছা ধান কেটে শোয়ানো আছে মাটিতে। কোথাও আবার আকাটা ধান মলিন হয়ে দাঁড়িয়ে। কাছেই দামোদরের ক্যানাল। তার পাশেই নাবাল জমিগুলি। ডিসেম্বরের গোড়ায় মিগজাউম সাইক্লোনজনিত নিম্নচাপ এনে দিয়েছে কলকাতায় বর্ষা ও কয়েক জেলায় ভারী অকালবর্ষণ।

নিচু জমিতে এখনও জল দাঁড়িয়ে। ওখানে গাড়ি নামবে না। অনেক ধান কাটা যায়নি। যাঁরা মাথায় করে ধানের বোঝা তুলে আনতে পেরেছেন, তাঁরা ধান এনে দিচ্ছেন পথের ধারে দাঁড়ানো মেশিনে। আলাদা হয়ে যাচ্ছে ধান আর খড়। মেশিন থেকে বেরোনো ধানের ঢিপি শুকোনো হচ্ছে পথের ধারে ক্যানালের কালভার্টে। দু’-তিন দিন রোদ পেলেই এ ধান শুকিয়ে যাবে। এ খড়ে কোনও কাজ হবে না। কালো হয়ে যাওয়া ভিজে খড়। আমার পাশে হাঁটছেন অবসরপ্রাপ্ত মাস্টারমশাই ও তরুণ কথাকার। দু’জনেই কৃষক। স্যরের জমিজমা বেশি, মানুষজন আছে, তরুণের চাষ ছোট, নিজের হাতে কাজ। মাঠেই তাঁদের ধান শুকোচ্ছে। বৃষ্টি হবে বলেছিল আবহাওয়া দফতর, এত বৃষ্টি বলেনি। বললেই বা কী করা যেত? পুরো মাঠের ধান তুলে আনা যায় না কি! গাই-বলদের খড়ের জন্য মাস্টারমশাই কিছু ধান কেটে নিয়েছিলেন আগেভাগে, সে সবও নষ্ট। যাঁরা কার্তিকের শেষে আলু তুলে ধান লাগিয়েছিলেন, ক্ষতি তাঁদের বেশি। শোল বা নিচু জমিতে জল ঢুকেছে। এখন মাঠে মাঠে আলু। তাতে সবুজ পাতা কিন্তু ফসল আসেনি। জেগে আছে উঁচু বা ডাঙা জমির ধান। সেখানে জল দাঁড়াতে পারেনি।

১০০ দিনের কাজের মজুরি আটকে থাকায় কি মানুষের মনে ক্ষোভ? তেমন তো মনে হয় না, স্থানীয়দের মুখে শোনা গেল। অন্তত নির্বাচনে ‘ইসু’ হবে না। এমনিতেই ১০০ দিন নামেই, কাজ বছরে পায় বিশ দিনও না। কারণ, পরিবার নির্বিশেষে গ্রামের সবার ‘জব কার্ড’ আছে। কোনও প্রকল্প মঞ্জুর হলে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে সবাইকে কাজ দেওয়া হয়। এ ছাড়া আছে বয়স্ক বা দুর্বলরা, যাঁরা কাজ না করেই মজুরির ভাগ পান। কাগজে হয়তো হরির নামে ২০ দিন দেখানো, কিন্তু আসলে তার কাজ ৫ দিনের, মজুরিও তাই। পার্টির প্রভাবশালীরা যেখানে জব কার্ড হস্তগত করেন, সেখানে এই ভাগাভাগির হিসাব আরও ঝাপসা। আগে পঞ্চায়েতে টাকা আসত, এখন হিতাধিকারীর ব্যাঙ্কে আসে। ব্যাঙ্ক থেকে টাকা তুলে ভাগ-বাঁটোয়ারা করাতেও অভ্যস্ত মানুষ। এখন শীতে খেতের কাজে মজুরি ২০০ টাকা। তাও চার-পাঁচ ঘণ্টা কাজ। বকেয়া টাকা নিয়ে লোকের বিশেষ মাথাব্যথা নেই, কারণ বকেয়ার লোকসান ভাগাভাগি হয়ে গেছে পুরো গ্রামের মধ্যে।

বাউরি বাগদিদের একটা বড় অংশ ভূমিহীন। রিকশা চালানো আর শহুরে-মজদুরি ছাড়াও তাঁদের মতো প্রান্তিক চাষিরা বাইরের রাজ্যে যান কাজ খুঁজতে। চেন্নাই, বেঙ্গালুরু, হরিয়ানা। চাষের কাজ আর ক’মাস? খিদে কমেছে, বদলেছে খাদ্যাভ্যাস। আগে ফসল ফুরোলে, বর্ষা পর্যন্ত মাসে বেশ ক’দিন উপোস বাঁধা ছিল গরিব ও প্রান্তিক চাষির।

দামোদরের চরে যেখানে কেবল শরবন ছিল, সেখানে দামোদরের জল এনে দিয়েছে সম্পন্নতা। আনাজ, ফুলের চাষ হচ্ছে ধান আর আলুর পাশাপাশি। রাধামোহন পুরের কাছে দেখে এসেছি ডিভিসির ক্যানাল। সিমেন্টে বাঁধাই হচ্ছে। গরু জল খেতে নামলে আর উঠতে পারে না। মরে যায় পাড়ের লতাগুল্ম কীটপতঙ্গ সমন্বিত এক প্রাকৃতিক ব্যবস্থা। কিন্তু সে সব শুনবে কে? এ হল জলসম্পদ মন্ত্রকের আধুনিকীকরণ প্রকল্প, তার পিছনে আছে সিমেন্টের ব্যবহারের অর্থনীতি। ডিভিসি আসার আগে ১৯৩২ সালে বন্যা নিয়ন্ত্রণের জন্য সোনামুখীর নিত্যানন্দপুরের কাছে তৈরি হয়েছিল অ্যান্ডারসন বাঁধ। জলকে বিভক্ত করে বইয়ে দেওয়ার জন্য পাকা বাঁধ ও জলবিভাজিকার সারি। জলস্তর বাড়লে তার উপর দিয়ে বয়ে যায়। বর্ষার সময় ভরা নদীর বহমান জলের দিকে তাকালে মনে হয়ে যেন হিরের আংটি যাচ্ছে ঘুরতে ঘুরতে। শীতের নদী এখন অনেক শান্ত। বিস্তীর্ণ চর। রণডিহার দহটুকু বাদ দিলে সবুজ জলের মৃদু গান। বছরশেষে গাড়ি ভরে শহুরে পর্যটকরা আসবেন। গান হবে ডিজে বাজিয়ে, পিকনিক হবে নদীর দুই তীরে। এখন জল কম, তাই চরে চাষ হচ্ছে।

সমিতিমানা-র সঙ্গে লেগে বেলোয়া গ্রাম, বাংলাদেশ থেকে আসা চাষিরা বসত করেছেন। দাসমশাই ফরিদপুরের উপজেলা মধুখালি থেকে এখানে এসেছিলেন আত্মীয়স্বজনের ডাকে, ফিরে গিয়েছিলেন ১৯৯০-এ, আবার ফিরে এসেছেন। দুই দেশের মাঝে তাঁর জলেরই মতো যাওয়া আসা। বলছিলেন, ৮-১০ বছর ধরে বিপর্যয়ের তীব্রতা বেড়েছে। হারিয়ে যাচ্ছে ঋতুর বৈশিষ্ট্য। প্রকৃতি আগে আবহাওয়ার পূর্বাভাস জানাত। এখন জানায় না। চাষের অর্থনীতি অনিশ্চয়তায় ডোবা। চাষ কী দেবে শেষ পর্যন্ত চাষি জানেন না। কখনও বস্তার দাম ১৫০, কখনও ২৫০। সারের দাম বেড়েছে, কীটনাশকের খরচ আছে। অকারণে সারের কৃত্রিম অভাব সৃষ্টি করা হয়েছে। ১৪০০ টাকা কেজির সার ১৮০০ দিয়ে কিনতে হচ্ছে। জমিতে বরবটি ছিল, পটল ছিল কার্তিকে, ধান ছিল না। তা তুলে দাসমশাই আলু লাগিয়েছিলেন। অনেকেই লাল সোনা ধান সবে কেটে আলু লাগিয়েছেন। জল এসে ডুবিয়ে দিয়ে গেছে আলু। এখন শেষ বেলায় কয়েক বিঘেতে স্প্রে করে আলু বাঁচানোর চেষ্টা। যতটুকু বাঁচানো যায়। ক্ষতিপূরণ দেওয়ার কথা সরকার বললেও চাষি জানেন জমি ও ফসলের মাপে তা হয় না। একটা গড় টাকা সবাইকে দেওয়া হয়। যাঁর বেশি ফসল বরবাদ, তাঁর লাভ হয় না। যাঁর ক্ষতি কম, তিনি বেশি পান। এটাই গণতান্ত্রিকতা।

দুপুরে ভাত খাওয়ার নিমন্ত্রণ নিত্যানন্দপুরের শ্রীমতী দাসের ঘরে। কন্যা প্রাইমারি শিক্ষিকা, ভাল লেখে। লম্বা বড় দানার সেদ্ধ চালের ভাত, কী যে মিষ্টি তার স্বাদ। নদীর চিরা বটাই মাছের ঝাল। একতলা পাকা বাড়িটির সামনে রান্নাঘরের চালা, তাতে দু’টি নিকানো উনুন। ছোট উনুনে টগবগ করে ফুটছে ডাল, সারা বাড়ির গা থেকে বেরিয়ে আসছে রান্নার সুগন্ধ। গোবর দিয়ে নিকানো উঠোন। একটি প্রাচীন কাঁঠাল গাছ, তার সর্ব-অঙ্গে কাঁঠাল ধরে। খেয়ে কুলানো যায় না। জালি দেওয়া ঘেরার মধ্যে বড় বড় মোরগ, তাদের মাথার উপর রোদের আঁচ এড়াতে মশারি টাঙানো। উঠোন পেরিয়ে দু’ধারে ফুলের গাছ, গোলাপ, অন্য গ্রামীণ ফুল, আরও কী শাকপাতা। এঁরা আগে অন্য জায়গায় থাকতেন, সেখানে নদীর ভাঙন আরম্ভ হয়েছে বলে এখানে চলে এসেছেন। বাড়ির পিছনে সরু এক নালা, তার যোগ দামোদরের সঙ্গে। বর্ষায় তোড়ে জল বয়। এখন শীতে রাঙা শালুক ফুটে আছে।

গৃহবধূ আবার কৃষানিও। চাষের কাজ করেন নিজের হাতে। আলু খেতে মাটি আলগা করে ছোট-হাত-লাঙল কেমন করে চালাতে হয় দেখালেন কর্তৃত্বের সঙ্গে। দেখাতে নিয়ে চলেছেন দামোদরের ভাঙন। সমিতিমানা-র কাছে উত্তর নিত্যানন্দপুরে নদী ভাঙছে। পূর্ব বাংলা থেকে আসা কৃষকরা নদী পাড়ে চাষবাসে সোনা ফলিয়েছিলেন। নদীর বুকে যেখানে জলস্রোত ছিল, সেখানে গজিয়ে উঠছে চর। নদী সরে এসে খেয়ে নিচ্ছে চাষের খেত। সারি সারি বাঁশের বাঁধন দিয়ে গত বছর যেখানে জল ঠেকানো হয়েছিল, সেখানে নদী বাধা পেয়েছে, আর এগোয়নি। সোনামুখী বড়জোড়া এলাকায় ভাঙনের অন্যতম কারণ অবৈধ বালির খনন। নদীর গভীর থেকে মেশিন দিয়ে নির্বিচারে তুলে আনা হচ্ছে বালি। নদীর গতিপথ পাল্টায়। কিছু মানুষের লোভের জন্য বিপন্ন হয় বহু মানুষের জীবন।

গাই-বলদ গিয়েছিল ওপারে চরে ঘাস খেতে। জল ভেঙে বিকেলের আলোয় নদী পেরিয়ে তারা হেঁটে আসছে। ভেসে আসছে এক ডিঙিনৌকা। গোবর কুড়ানোর সুবিধে বলে বালির উপরেই মন্ডার মতো গোল গোল ঘুঁটে দেওয়া হয়েছে। হেমন্তের বেলা পড়ে আসে। পশ্চিমে সূর্য ঢলে। দামোদরের তীরে ফুরিয়ে আসে এক হ্রস্ব শীতের বেলা।

অন্য বিষয়গুলি:

Depression sudden rainfall Winter season Farmers Winter crops Crop Damage
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy