Advertisement
১৩ নভেম্বর ২০২৪
‘যাত্রা’য় সাফল্য এসেছে, ‘জোয়ার’ কী দেবে
Lok Sabha Election

জোটের জটে বাংলা

বাংলায় বিজেপি-বিরোধী রাজনীতির অন্তরমহলে এই মানসিকতা কাজ করছে। তার ছায়া পড়ে বৃহত্তর রাজনীতির ক্ষেত্রেও।

An image of TMC Workers

নতুন: অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘নব জোয়ার’ কর্মসূচিতে সমর্থকরা। ফাইল ছবি।

দেবাশিস ভট্টাচার্য
শেষ আপডেট: ১৮ মে ২০২৩ ০৬:০১
Share: Save:

বেঙ্গল থেকে বেঙ্গালুরু! বড় গুছিয়ে বলেছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। কর্নাটকে বিজেপি পর্যুদস্ত হওয়ার পরে বাংলার মুখ্যমন্ত্রীর এই মন্তব্যকে কিছুটা ক্ষত উস্কে নুন ছেটানোও বলা যেতে পারে। কারণ, এই রাজ্যে দু’শোর স্বপ্ন দেখিয়ে বিজেপি শেষ করেছিল ৭৭-এ। আর কর্নাটকে ২২৪ আসনের দৌড়ে নিজে মাঠে নেমে নরেন্দ্র মোদী দলকে ৬৬ ‘উপহার’ দিলেন! উপরন্তু দাক্ষিণাত্যের সব রাজ্যই এখন বিজেপির হাতছাড়া হয়ে গেল।

লোকসভা নির্বাচনের আগে বাকি আছে রাজস্থান, মধ্যপ্রদেশ, তেলঙ্গানা, ছত্তীসগঢ় প্রভৃতি রাজ্যের ভোট। বিরোধীদের পক্ষে আশাবাদী হওয়া স্বাভাবিক। এটাও সকলের জানা যে, বিহারের মুখ্যমন্ত্রী নীতীশ কুমার বিরোধী নেতাদের মধ্যে সমন্বয়ের কাজে নেমেছেন। খুব তাড়াতাড়ি বিরোধী দলগুলিকে তিনি বৈঠকে বসাতে চান। ধারণা, তৃণমূল নেত্রী মমতা তাতে যোগ দেবেন।

এ হল বিরোধী ঐক্য-প্রয়াসের একটি ‘স্বচ্ছ’ দিক। যেখানে দুইয়ের সঙ্গে দুই যোগ করলে চার হওয়া নিশ্চিত। কিন্তু বাংলার রাজনীতি কি সেই হিসাব মেনে চলছে? জাতীয় রাজনীতির প্রেক্ষিতে কর্নাটকের অভিঘাত নিয়ে আলোচনার সময় এটি অত্যন্ত জরুরি প্রশ্ন।

গেলাসে অর্ধেক জল থাকলে সেটি অর্ধেক ভর্তি। আবার সত্যের অপলাপ না ঘটিয়ে গেলাসটি অর্ধেক খালি বললে সেই পরিবেশনের কায়দায় এক চিমটে কৌশলও মেশানো যায়! বাংলায় বিজেপি-বিরোধী রাজনীতির অন্তরমহলে এই মানসিকতা কাজ করছে। তার ছায়া পড়ে বৃহত্তর রাজনীতির ক্ষেত্রেও। আজ এটা ব্যাখ্যার অপেক্ষা রাখে না। কর্নাটকের রায় নিয়ে বাংলার বিজেপি-বিরোধী তিন দলের প্রতিক্রিয়া এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ।

সেখানে এই রাজ্যের মতোই বিজেপির বিরুদ্ধে একক দলের আধিপত্য কায়েম হল। এখানে মমতার তৃণমূল কংগ্রেস যেমন একা বিজেপিকে পরাস্ত করেছিল, ওখানে তেমনই করেছে কংগ্রেস। এখানে তৃণমূলের দাপটে বিজেপি-বিরোধী কংগ্রেস ও সিপিএম নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছিল। ওখানে কংগ্রেসের ধাক্কায় দেবগৌড়ার বিজেপি-বিরোধী আঞ্চলিক দল জেডি(এস) পর্যন্ত কোণঠাসা। প্রাপ্তি মাত্র ১৯। আসল লড়াই হয়েছে দুই জাতীয় দলের।

মমতার প্রতিক্রিয়ায় বিজয়ী কংগ্রেসের নাম উচ্চারিত না-হওয়া রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের নজর এড়ায়নি। তিনি সাধুবাদ দিয়েছেন শুধু কর্নাটকের জনগণকে। সেই সঙ্গে অবশ্য আশা ব্যক্ত করেছেন লোকসভায় ‘সবাইকে নিয়ে’ বিরোধী জোট গড়ে বিজেপির পরাজয় নিশ্চিত করার।

যদিও বাংলার কংগ্রেস ও সিপিএম ফের জানিয়ে দিয়েছে, তৃণমূলের সঙ্গে এখানে কোনও জোট তারা করবে না। জোট থাকবে কংগ্রেস ও সিপিএমের। লড়াই হবে বিজেপি ও তৃণমূল, উভয়ের বিরুদ্ধে। তা হলে? বিজেপিকে হারাতে ‘একের বিরুদ্ধে এক’ প্রার্থী দেওয়ার এবং যেখানে যে দল ‘শক্তিশালী’ তাকে সমর্থন করার জন্য মমতার যে রণনীতি, তা কি তাঁর নিজের রাজ্যেই ধাক্কা খাবে? রাজনীতি সদা পরিবর্তনশীল। তবু আজ এই মূহূর্তে দাঁড়িয়ে এখানে সার্বিক জোটের ছবিটি ঝাপসা মনে হওয়া স্বাভাবিক।

এ কথা ঠিক যে, বিজেপি কংগ্রেস সিপিএম তিন পক্ষকে হারিয়ে জিতে আসার নজির মমতা গড়েছেন একাধিক বার। অর্থাৎ, তিনি প্রমাণ করেছেন, এখানে তাঁরা ‘অপ্রতিরোধ্য’। আবার কংগ্রেস-সিপিএম জোটের পরে সম্প্রতি সাগরদিঘি উপনির্বাচনের ফল যে তৃণমূলকে ঘা দিয়েছে, এটাও ঘটনা।

আসলে বাস্তবতার জমিতে ধ্রুব সত্য বলে কিছু হতে পারে না। রাজনীতিতে তো নয়ই। সময় এবং পরিস্থিতির সঙ্গে তার অবস্থান বদলাতে থাকে। ভোট-ব্যাঙ্কের ‘মালিকানা’ থেকে ভোটের বিন্যাস সর্বত্র তখন ওই বদল টের পাওয়া যায়। সেইমতো বদল ঘটে দলগুলির রাজনৈতিক নকশারও। মমতা কিছু দিন আগেও বিজেপির বিরুদ্ধে ‘একলা’ চলার কথা বলতেন। তাঁর সেই ভাবনায় কংগ্রেস সম্পর্কে ‘শীতলতা’ টের পাওয়া যেত। তিনি তা গোপন করার বিশেষ চেষ্টাও করেননি। কিন্তু কর্নাটকের পরে রাজনীতির সম্ভাব্য গতিপথ বুঝতে তাঁর মতো বিচক্ষণের ‘ভুল’ হওয়ার কথা নয়। বিরোধীদের ‘সার্বিক’ ঐক্যের প্রয়োজনীয়তা ব্যাখ্যা করতে গিয়ে কংগ্রেস হাই কম্যান্ডের উদ্দেশে তাঁর এখনকার বার্তাটি তাই খুব ইঙ্গিতপূর্ণ। যার সারমর্ম হল, উপরের স্তরে জোট করতে হলে রাজ্যেও যেন তৃণমূলের বিরুদ্ধে কংগ্রেস লড়াই না করে।

তৃণমূল নেত্রীর এই ‘জোট-সূত্র’ কংগ্রেস হাই কম্যান্ড কী ভাবে নেবেন, তাঁরা রাজ্য দলের মতামতকে প্রাধান্য দেবেন, না কি ‘বৃহত্তর’ স্বার্থ গুরুত্ব পাবে, কংগ্রেস-সিপিএম জোটের ভবিষ্যৎই বা কোথায় দাঁড়াবে— এ সব প্রশ্নের উত্তর এখন কালের গর্ভে। অধিক জল্পনা নিরর্থক। তবে একটি কথা। লোকসভার আগে যে ক’টি রাজ্যে ভোট হবে, সেখানে কংগ্রেস কেমন ফল করে, তার উপরেও বিরোধী রাজনীতির চেহারা কিন্তু অনেকাংশে নির্ভর করবে। বস্তুত এই রাজ্যগুলির মধ্যে একমাত্র কেসিআর-এর তেলঙ্গানা ছাড়া বাকিগুলিতে আঞ্চলিক দল বলতে তেমন কেউ নেই। অর্থাৎ, লড়াই কার্যত হবে সরাসরি বিজেপির সঙ্গে কংগ্রেসের। যদি কংগ্রেস ‘কর্নাটক-ম্যাজিক’ দেখাতে পারে, লোকসভার আগে বিরোধী জোটে তার অবস্থান তা হলে ‘পাকা’ হতে বাধ্য। আর সেটা না-হলে বিরোধী শিবিরে নেতৃত্ব প্রত্যাশীদের ঠান্ডা লড়াই ফের চাঙ্গা হবে।

রাহুল গান্ধী যখন হেঁটে ‘ভারত জোড়ো’ যাত্রা করেছিলেন, বিরোধী শিবিরে কেউ কেউ তখন তাতে বিশেষ গুরুত্ব দিতে চাননি। বিজেপিকে নিশানায় রেখে কংগ্রেসের অন্যতম শীর্ষ নেতার প্রতিবাদ ছিল দেশে ‘হিংসা ও ভয়ের বাতাবরণ, সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ সৃষ্টি, ক্রমবর্ধমান বেকারত্ব, আর্থিক বৈষম্য’ ইত্যাদির বিরুদ্ধে। কর্নাটকে কংগ্রেস অভিযোগ তুলেছিল বিজেপি সরকারের আর্থিক দুর্নীতির (কাটমানি) বিরুদ্ধেও। ফলের পরে যদিও অনেকেই বলছেন, এর পিছনে রাহুলের ওই যাত্রা কর্মসূচির বড় অবদান আছে।

রাজ্যে অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের চলতি ‘নব জোয়ার’ কর্মসূচিও এখন একটি উল্লেখযোগ্য আলোচনার বিষয়। ভিড়ের বহরে তা বেশ নজর কেড়েছে। আবার মাঠে-ঘাটে-টিভির পর্দায় বিতর্কের পরিসরও তৈরি হয়েছে। রাজনীতিতে এই রকম দৃশ্যমানতার কিছু কার্যকারিতা হয়তো আছে। পক্ষে বা বিপক্ষে নিরন্তর প্রচারে থাকাও একটি কৌশল। কিন্তু তুলনা করে দেখলে রাহুলের কর্মসূচি এবং অভিষেকের কর্মসূচির মধ্যে মূলগত কিছু তফাত চোখে পড়ে। রাহুলের ‘যাত্রা’ ছিল সরাসরি দেশের শাসকের বিরুদ্ধে বিরোধী নেতার অভিযান। অন্য দিকে, অভিষেক দু’মাসের জন্য পথে নেমেছেন মূলত তাঁর নিজের দলে ‘ঢেউ’ তোলার ঘোষণা করে।

পঞ্চায়েত ও লোকসভা ভোটকে সামনে রেখে অভিষেকের এই কর্মসূচি তৃণমূলকে সাংগঠনিক ভাবে কতটা এগিয়ে দিতে পারছে, দলের ভিতরকার খানা-খন্দ কতটা মেরামত করা যাচ্ছে, এগুলি অবশ্যই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন— বিশেষত বর্তমান সময়ে, যখন শাসক তৃণমূল নানা দিক থেকে চাপের মুখে এবং দুয়ারে পর পর ভোট। তবে তাঁর অভিযানের ‘ট্যাগ লাইন’ থেকে ধারণা হয়, ‘নব জোয়ার’ প্রকৃতপক্ষে তৃণমূলে নতুন প্রজন্মের ‘প্রাধান্য’ প্রতিষ্ঠা করা। অভিষেক ইতিমধ্যেই দলে মমতার ঠিক পরে দ্বিতীয় শীর্ষ নেতার মান্যতা পেয়ে গিয়েছেন। এ বার কোচবিহার থেকে কাকদ্বীপ পর্যন্ত ঘুরে দলীয় কর্মীদের সঙ্গে ‘সরাসরি সংযোগ’ তৈরির মাধ্যমে অভিষেকের নেতৃত্বকে নিচুতলা পর্যন্ত ‘গ্রহণযোগ্য’ করে তোলার একটি বার্তাও এই অভিযানে মিশে আছে। আপাত ভাবে এটি তৃণমূলের অভ্যন্তরীণ বিষয়। দলে কার কী অবস্থান হবে, সেটা একান্তই তাঁদের ব্যাপার। মমতা নিজেও তাঁর দলে নতুন প্রজন্মকে এগিয়ে আনতে চেয়েছেন।

তবে ‘নব জোয়ার’-এর স্রোতে ‘দুর্নীতির আবর্জনা’ দূর করে আজ তৃণমূলকে ‘পরিচ্ছন্ন’ করার চ্যালেঞ্জ অভিষেককে নিতে হল কেন, তা অনুমান করা কঠিন নয়। বিষয়টি তৃণমূলের ভোট-ভবিষ্যতের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত। তাই ‘জোয়ার’ কী দেয়, আগামী দিনে তার উপরেও অনেক কিছু নির্ভর করবে।

অন্য বিষয়গুলি:

Lok Sabha Election TMC BJP
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE