Advertisement
২০ ডিসেম্বর ২০২৪
Teesta River

হিমালয়ের স্বার্থ বনাম উন্নয়ন

পাহাড়ের গায়ে ঢাল থাকে। আর নদীর বুকে থাকে জল। বিদ্যুৎ উৎপাদনের লোভনীয় হাতছানি। সেটা উত্তরাখণ্ডের গঙ্গা হোক কিংবা উত্তরবঙ্গের তিস্তা।

সুপ্রতিম কর্মকার
শেষ আপডেট: ০৬ এপ্রিল ২০২১ ০৪:৪৪
Share: Save:

আকাশফাটা একটা গম্ভীর শব্দ পাহাড়ের আড়াল থেকে ভেসে আসছিল। মুহূর্তগুলো একটু করে এগোচ্ছিল, আর গগনবিদারী শব্দটা আরও বিকট হয়ে উঠছিল। গঢ়বালিদের কাছে এই শব্দটা খুব চেনা। ২০১৩ সালের জুন মাসে শেষ শুনেছিলেন তাঁরা। এ হল নদীর রেগে ওঠার ডাক। উত্তরাখণ্ডের গঢ়বাল হিমালয়ে যা ঘটল, সেই ভয় দার্জিলিং হিমালয়েও কি নেই? পাহাড় শাসনের রীতি এখানেও সেই এক।

পাহাড়ের গায়ে ঢাল থাকে। আর নদীর বুকে থাকে জল। বিদ্যুৎ উৎপাদনের লোভনীয় হাতছানি। সেটা উত্তরাখণ্ডের গঙ্গা হোক কিংবা উত্তরবঙ্গের তিস্তা। আর তার জন্য পাহাড়ি নদীগুলোর বুকের উপর কখনও চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে কংক্রিটের বাঁধ। কখনও আস্ত একটা নদীকে মাটির নীচের টানেলের মধ্যে দিয়ে ঘুরিয়ে দেওয়া হয়েছে। উদ্দেশ্য, জলের ভিতরে টারবাইন ঘুরিয়ে বিদ্যুৎ তৈরি। যে পরিমাণ বিদ্যুৎ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করে বাঁধ বানানো কিংবা টানেল তৈরি শুরু হয়েছিল, তা কোনও ক্ষেত্রেই ধরা যায়নি। সবচেয়ে বড় সমস্যা পলি নিয়ন্ত্রণ।

উত্তরাখণ্ডের উঁচু পাহাড়ের গায়ে চিরসবুজ পাইনের জঙ্গল। তা যেমন জল ধরে রাখে, তেমনই শিকড়ের কামড়ে মাটির কণাকে আগলে রাখে। তাই গঢ়বালি মানুষেরা বংশপরম্পরায় পাইনের জঙ্গলকে পুজো করে এসেছেন। জঙ্গল নিধনের পালা পুরোদমে শুরু হয় ২০১২-১৩ সাল নাগাদ। ফলে উত্তরাখণ্ডে ভূমিক্ষয়ের পরিমাণও বাড়তে থাকে। ঠিক একই রকম অবস্থার সাক্ষী উত্তরবঙ্গ। নগরায়ণ, রেলপথ ও সড়কপথের প্রসার হচ্ছে, যা তথাকথিত ‘উন্নয়ন’-এর মানদণ্ড। এ ছাড়া কাঠের চোরাচালান। এমন আরও অনেক অত্যাচারের ফলে গত কয়েক দশকে সঙ্কুচিত হয়েছে জঙ্গল। মাটির ক্ষয় বেড়েছে। যার সরাসরি প্রভাব পড়েছে তিস্তা নদীর পেটের উপর তৈরি গজলডোবা ব্যারাজে। পলি জমার পরিমাণ বেড়েছে সেখানে, যা বিদ্যুৎ উৎপাদনের উপর ক্ষতিকর প্রভাবও ফেলেছে।

চামোলীতে ঋষিগঙ্গা নদীতে হড়পা বানে ১৭০ জন মানুষের নিখোঁজ হয়ে যাওয়ার এই ঘটনা আরও একটা বিষয়কে উস্কে দেয়। নন্দাদেবী পাহাড়টা হিমবাহে ভর্তি। সেই হিমবাহ-গলা জলে ঋষিগঙ্গা নদীর জন্ম। রাইনির কাছে ঋষিগঙ্গা নদী ধৌলির কাছে এসে মেশে। আর সেখানেই জলবিদ্যুৎ প্রকল্পটা। এই প্রকল্পের জন্য পাহাড়ের ভিতর দিয়ে নির্মিত টানেলগুলো কাদাপাঁকে বন্ধ।

ঠিক একই অবস্থা উত্তরবঙ্গেও। ২০১৯ সালে সেবক থেকে রংপো রেল প্রকল্প উত্তরবঙ্গের পরিবেশকর্মীদের রাতের ঘুম কেড়ে নিয়েছিল। সেখানে ৪৫ কিলোমিটার পথে ১৪টা টানেল আর ১৪টা ব্রিজ তৈরি করে যথাক্রমে হিমালয়ের পেটের মধ্যে দিয়ে আর পিঠের উপর দিয়ে নিয়ে যাওয়ার কথা ছিল। সিকিমের দিকে প্রকল্পের কাজ শুরুও হয়েছিল। পরিবেশবিদরা বিস্তারিত প্রকল্প রিপোর্টের ভিত্তিতে দাবি করেছিলেন, তিস্তা ব্যারাজের নীচেই তৈরি হবে গ্রাউন্ড রেলওয়ে স্টেশন। বার কয়েক মৃদু কম্পন বড় বিপর্যয়ের আভাস দিয়ে গিয়েছে। নবীন হিমালয় পর্বত শিশুর মতো অস্থির। অনবরত চলতে থাকে তার শরীর গঠনের কাজ। হিমালয়ের অবস্থান ভূমিকম্পপ্রবণ এলাকার উপরেই। তাই হিমালয় নিয়ে যে কোনও ধরনের এক্সপেরিমেন্ট বিপদের। সে কথা বার বার বলেছেন ভূতাত্ত্বিকেরা।

বিশ্ব উষ্ণায়নের থাবা হিমালয়ের উপর গভীর প্রভাব ফেলেছে। এ কথা অস্বীকার করার জায়গা নেই। কিন্তু ২০১৩ সালে উত্তরাখণ্ডে বিধ্বংসী বিপর্যয়ের পরেও কোনও শিক্ষা নেওয়া হয়নি। তার পরেও ৯০০ কিলোমিটার দীর্ঘ চার ধাম সড়ক যোজনার কাজ বন্ধ হয়নি। পরিবেশবিদদের দাবি ছিল, গঢ়বাল হিমালয়কে বাঁচাতে পাহাড়ের গায়ে সর্বাধিক সাড়ে পাঁচ মিটার চওড়া রাস্তা করা দরকার, তার বেশি নয়। সেখানে উত্তরাখণ্ড সরকার দশ মিটার চওড়া রাস্তা করা থেকে বিরত হয়নি। কাজেই গাছ কাটার সংখ্যাটা এক ধাক্কায় দ্বিগুণ বেড়েছে। অলকানন্দার উপর পিপলকোটি বাঁধের কাজ এখনও পুরোদমেই চলছে।

২০১৮ সালে ভারতের বিশিষ্ট পরিবেশবিজ্ঞানী গুরুদাস আগরওয়াল ওরফে স্বামী সানন্দজি বাঁধবিহীন ‘অবিরল ও নির্মল’ গঙ্গার জন্য ১১১ দিন অনশন করেছিলেন ও প্রাণত্যাগ করেছিলেন। আমাদের জীবনের মূল পাঠ হল, হিমালয় না বাঁচলে গঙ্গা বাঁচে না। আর গঙ্গা না বাঁচলে এই ভারতভূমি বাঁচবে না। কেন্দ্রীয় সরকারের নথি বলছে, প্রতি দশ জন ভারতীয়ের মধ্যে চার জন গঙ্গার জলকে ব্যবহার করেন। তা সত্ত্বেও এখনও পর্যন্ত হিমালয়কে নিয়ে কোনও নীতি নির্মাণ হল না। যে নীতির ভিত্তিতে হিমালয়ের প্রাকৃতিক সম্পদের সংরক্ষণ, মাটি ও জলের ব্যবস্থাপনা, বৃষ্টির তথ্যের বিশ্লেষণ ইত্যাদির মাধ্যমে হিমালয়ের সুস্থায়ী উন্নয়নের পথ খোঁজা প্রয়োজন।

এখনও সতর্ক না হলে বিপদ সম্মুখে। হিমালয় উত্তরাখণ্ডকে ধ্বংস করছে। আগামী দিনগুলোতে উত্তরবঙ্গকে ধ্বংস করবে না, সেই ভরসা আছে কি?

অন্য বিষয়গুলি:

North Bengal Teesta River
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy