বহু, বহু বছর আগে এক অগ্রজ সুন্দর একটি খাম দিয়েছিলেন অনুজ সাংবাদিককে, আশীর্বাদ-সহ। অনুজটি খাম খুলে অবাক। দিন কয়েক আগে তাঁর নামাঙ্কিত, পরিভাষায় যে ‘বাইলাইন স্টোরি’ সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়েছে, সেই পৃষ্ঠাটি পর্যবসিত হয়েছে ঠোঙায় এবং মুড়ি-তেলেভাজার দোকান থেকে অগ্রজ সেটি নিয়ে খামে পুরেছেন। অগ্রজ বলেছিলেন, “এ হল সাংবাদিকতার সেরা উপহার। ঠোঙা মানে তুমি জনপ্রিয় হয়ে উঠেছ। বাড়িতে কাগজ রাখা হচ্ছে বলেই তো ঠোঙা হচ্ছে।”
‘খবরের কাগজ তো পর দিনই ঠোঙা’— এই বাক্য বঙ্গ সাংবাদিকতার পরিচিত ও প্রাচীন শিক্ষা। প্রথম শিক্ষা, বাইলাইন পেলে ঔদ্ধত্যের জায়গা নেই, পর দিনই তো তুমি ঠোঙা! দ্বিতীয় শিক্ষা, খবরের কাগজে আগামিকাল বলে কিছু নেই। আজ যা করবে, প্রাণ ঢেলে করো, পর দিন লোকে তা পড়বে, পরশু ঠোঙা। ফলে ওই স্টোরির ফলোআপ যখন করা হবে, পুরনো কথা মনে করিয়ে দিতে হবে। কারণ, যিনি আগের লেখা পড়েননি, তেমন নতুন পাঠক লেখাটি পড়বেন। এবং আগে পড়লেও পাঠক তা সবিস্তার মনে রাখবেন, এমন ভাবার কারণ নেই। অর্থাৎ তুমি নশ্বর, তোমার লেখার আয়ু আরও নশ্বর— এই লাল-সঙ্কেত প্রাচীনতম। তেমন সেই বাধাকে ঝেড়ে ফেলে, যা লিখেছি, তা ভুলে যেতে দেব না— এই প্রতিস্পর্ধাও সংবাদপত্রে দীর্ঘ দিনের।
‘এত পড়ার সময় নেই’, ‘সবই তো সারা দিন ধরে দেখলাম বা শুনলাম, তা হলে আর কী পড়ব’— যুগ যুগ ধরে এই প্রশ্ন সামলানোর সাহস সংবাদপত্রের সাংবাদিকদের দিয়ে চলেছেন পাঠকরাই। কারণ, পাঠকই বলেন, ‘কাগজে লিখেছে’ বা ‘আমি বাজি ধরে বলছি, কথাটা ঠিক, কাগজে লিখেছে’। অর্থাৎ অখণ্ড আস্থা।
কেন আস্থা? কারণ, কিছু বলতে ভুল হলে তৎক্ষণাৎ শুধরে নেওয়া যায়, দেখানোয় ভুল থাকলে সরিয়ে দেওয়া যায় চটজলদি, হোয়াটসঅ্যাপে যা কিছু ইচ্ছা, পাঠিয়ে দিয়ে ভুলে যাওয়া যায়, ওয়েবে মুছে ফেলা যায়, কিন্তু ছাপার অক্ষরে এক বার ভুল বেরোলে তৎক্ষণাৎ শুধরানোর উপায় নেই। অপেক্ষা পর দিন পর্যন্ত। ফলে সংবাদপত্রে যা প্রকাশিত হয়, তা দশ বার যাচাই করে তবেই দেওয়া হয়— সেই আস্থাটুকু থাকেই পাঠকের। আর সেই আস্থাভঙ্গের শাস্তি? দৈনন্দিন চিঠিপত্র তো আছেই, ইদানীং সেই ভুলটুকুতে গোল করে দাগিয়ে সমাজমাধ্যমে লেখা— ‘পত্রিকা শেষে এই লিখল’! ‘দ্য সানডে টাইমস’-এর প্রবাদপ্রতিম সম্পাদক স্যর হ্যারল্ড এভানস তাঁর ‘ডিলেমাজ় অব দ্য ডিজিটাল ইরা’ নিবন্ধে লিখেছিলেন, সংবাদপত্র প্রতিষ্ঠানগুলি দিনের পর দিন শুধু নিউজ়প্রিন্ট উগরে দেয় না। যথার্থ ভাল সংবাদপত্র খবর সংগ্রহ করে, যাচাই করে, তার পর বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে তা তুলে ধরে, যা পড়ে আমরা সিদ্ধান্ত নিই বা নিতে পারি। ‘অ্যাট দ্য হায়েস্ট লেভেলস, দ্য নিউজ়পেপার ইজ় আ পাবলিক ট্রাস্ট ডেডিকেটেড টু পাবলিক সার্ভিস।’
পাঠকের এই আস্থার আভাস পাওয়া গেল নতুন করে। করোনা পরবর্তী সময়ে সি ভোটারের দেশজোড়া সমীক্ষায় জানা গিয়েছিল, ৬৬ শতাংশের কাছে এখনও সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সংবাদমাধ্যম— সংবাদপত্র। এবং ৬৩ শতাংশ উত্তরদাতা জানিয়েছিলেন, করোনাকালে, ভুয়ো খবর বা প্রচারের যুগে, সংবাদপত্র আরও বেশি নির্ভরযোগ্য সংবাদ উৎস হয়ে উঠেছে। বিশ্লেষকেরা এ-ও বলছেন, এই মনোভাব হোয়াটসঅ্যাপ বা সমাজমাধ্যমে ভুয়ো, অসমর্থিত খবর বা জল্পনার ঝড় এবং ভুয়ো ভিডিয়োর অভিজ্ঞতাসঞ্জাত। যে কারণে করোনা পরবর্তী কালে অরম্যাক্স মিডিয়ার ‘সংবাদের বিশ্বাসযোগ্যতা সূচক’ সমীক্ষায় শীর্ষে সংবাদপত্র, সবার নীচে হোয়াটসঅ্যাপ। আর ৬১ শতাংশ উত্তরদাতার কাছে ভুয়ো খবর বিশেষ উদ্বেগের কারণ।
আবার, সি ভোটার সমীক্ষায় ৫২ শতাংশ উত্তরদাতা জানিয়েছিলেন, টেলিভিশনে, মোবাইলে বা ইন্টারনেটে কোনও ম্যাচ দেখার পরও সংবাদপত্রে তা সবিস্তার পড়তে চান তাঁরা। কেন পড়তে চান? বহু, বহু বছর আগে কপিলদেবের ৪০০ উইকেট প্রাপ্তির পর দিন এই সংবাদপত্রে লেখা হয়েছিল— কপিল শিখর স্পর্শ করলেন, তবে সমাপ্তি ঘটল ৪০০ উইকেট পাওয়ার আগের মুহূর্ত পর্যন্ত বুকের মধ্যে বয়ে নিয়ে চলা সেই সাফল্য-আকুলতার, উথালপাথাল উদ্বেগ, প্রতি মুহূর্তের অপেক্ষার। সাফল্যের শিখরে দাঁড়িয়ে এমন মন-কেমন কোনও লাইভ বিবরণী বলেনি। বলেও না।
আসলে টেলিভিশন পরবর্তী যুগে যে প্রশ্ন উঠত, সমাজমাধ্যম এবং মোবাইল-খবরের যুগেও তা সত্য। সারা দিন ধরে একটি ঘটনা, একটি ম্যাচের প্রতি সেকেন্ড দেখার পর দিনও আগ্রহ থাকে, ‘কাগজে কী লিখল?’ ‘যা দেখলাম, তার বেশি কী দিল?’ ‘যা দেখলাম, তা-ও লিখল তো?’ কোনও সেটপিস গোল মোবাইলে ১০১ বার দেখার পরও খবরের কাগজে পাঠক দেখতে চান গোলের গ্রাফিক্স, পড়তে চান শটের বিশ্লেষণ।
উন্নাওয়ে এক ধর্ষিতা কন্যা, যে মরে গিয়েছিল জ্বলতে জ্বলতে কয়েক বছর আগে, তার সংবাদ, অন্তর্তদন্ত ভরে রেখেছিল সংবাদমাধ্যম। তবে গত লোকসভা ভোটের আগে তার বাবার সঙ্গে সাক্ষাতের পর সংবাদপত্রে যা লিখেছিলেন এক নবীন সাংবাদিক, তা কি দেখিয়েছিল আর কেউ? ‘দাওয়ার এক ধারে চৌকির উপরে বসে শাক দিয়ে ভাত খাচ্ছেন বৃদ্ধ। অন্য ধারে মাটিতে রাখা শিল-নোড়ায় সদ্য বাটা সেই শাকের আস্তর। অপ্রবাসে, অঋণের শাকান্নে এত খানি হাহাকার মাখা থাকতে পারে, না দেখলে বিশ্বাস হত না।’
বার্লিনের দেওয়াল যখন ভেঙে পড়েছে, সংসার-অন্তপ্রাণ এক প্রৌঢ়া ঘরোয়া আড্ডায় ব্যাখ্যা করতেন নতুন পৃথিবী গড়ে ওঠার কারণ। বলেছিলেন, “জানব না কেন, আমি কাগজ পড়ি তো।” এখন গ্রামে গিয়ে শুনতে হয়, “ব্রেক্সিটের প্রভাব নিয়ে আপনারা কেন গ্রাফিক্স দিলেন না? গ্রামে থাকি বলে ভাবেন কিছু জানি না?” পাঠক খবর পড়েন এবং খবরের বেশি কিছু পড়তে চান। এখানেই তো প্রকৃত পরীক্ষা। পরীক্ষা পড়ানোর। পরীক্ষা স্পর্শ করানোর।
আমরা যা ভালবাসি, তা স্পর্শ করি। মানুষ, ফুল, নদীর জল, পাহাড়, মাটি, গাছ, অন্য প্রিয় প্রাণী, কলম, বই, শব্দ, অক্ষর।
শঙ্খ ঘোষ লিখেছিলেন, “আমরা যখন সত্যিকারের সংযোগ চাই, আমরা যখন কথা বলি, আমরা ঠিক এমনই কিছু শব্দ খুঁজে নিতে চাই, এমনই কিছু কথা, যা অন্ধের স্পর্শের মতো, একেবারে বুকের ভিতরে গিয়ে পৌঁছয়। পারি না হয়তো, কিন্তু খুঁজতে তবু হয়, সবসময়েই খুঁজে যেতে হয়, শব্দের সেই অভ্যন্তরীণ স্পর্শ।”
আর আমরা যখন লেখার মধ্যে সেই সংযোগ চাই ছাপার অক্ষরে, দৈনন্দিন ঘটনা, তথ্য, দুর্ঘটনা, হত্যা, রাজনীতি, সমাজজীবনের খবর নিয়ে? আমাদের প্রতিস্পর্ধী হয়ে উঠতেই হয়। সময়হীন এবং মোবাইলবদ্ধ পৃথিবীতে হাতে, হৃদয়ে, মস্তিষ্কে খবর স্পর্শ করানোটাই প্রতিস্পর্ধা। প্রতিস্পর্ধা এইখানে যে, আমি দুই হাতের মধ্যে ধরতে বাধ্য করব, যা লিখছি— যাচাই করা তথ্য, বিশ্লেষণ, সংবাদের ভিতরের সংবাদ, অনুসন্ধান এবং ‘অবিন ঠাকুর’-এর মতো ছবি লেখার চেষ্টা। যা পড়ে পাঠক অন্যকে বলবেন, “পড়েছেন? কী লিখেছে!” এভানস তো তাকেই বলছেন খবর, যা থেকে পাঠক জ্ঞান আহরণ করেন এবং অন্যকে পাঠান।
এই প্রতিস্পর্ধার আধারের সুবিধাও রয়েছে। এভানস সংবাদপত্রকে বলেছেন, ‘সাইমলটেনাস মিডিয়া’। কারণ, একটা পাতায় পাশাপাশি, উপর-নীচে অসংখ্য খবর, যেখানে এক বার চোখ বুলিয়েই আপনি বুঝে নিতে পারছেন, কোন খবরটা পড়বেন বিস্তারিত, কোনটা শুধু শিরোনাম, কোনটা প্রথম পরিচ্ছেদ। ইচ্ছেমতো, ফিরে ফিরে পড়তে পারছেন একই খবর। পরেও। আর টেলিভিশন তাঁর কথায় ‘সিকোয়েনশিয়াল মিডিয়া’। আপনাকে খবর দেখতে হবে পূর্বনির্ধারিত ক্রমে, আপনাকে অপেক্ষা করতে হবে পরের খবরের জন্য এবং আপনি চাইলেই খবর ‘রিওয়াইন্ড’ করতে পারবেন না।
স্টেট অব প্লে নামে হাল আমলের একটি ফিল্মে দেখানো হয়েছিল, একটি সংবাদপত্রের দফতরে (যার ডিজিটাল উপস্থিতিও রয়েছে) লেখা হচ্ছে এক সেনেটরের কুকীর্তির খবর। সেই সংবাদ খুঁড়ে আনার কুশীলবের অন্যতম— ডিজিটালের নবীন সাংবাদিক প্রিন্টের অগ্রজকে বলছে, “ওয়েল ইউ নো, আ পিস দিস বিগ, পিপল শুড প্রবাবলি হ্যাভ নিউজ়পেপার অন দেয়ার হ্যান্ডস, হোয়েন দে রিড ইট।” এত বড় খবর তো হাতে ধরে পড়ার মতো খবর! ওই ফিল্মেই বলা হয়েছে, মানুষ প্রকৃত খবর এবং ভুয়ো খবরের তফাত বোঝেন এবং কেউ কেউ যে সত্য খুঁজে বার করে তা ছাপার অক্ষরে প্রকাশ করার সাহস দেখাচ্ছেন, তাতে তাঁরা তৃপ্ত।
অর্থাৎ, শতং বদ, মা লিখ-তে আশ্রয় নেওয়া নয়। এ হল সত্যকে ছাপার অক্ষরে স্থায়ী ভাবে প্রকাশ করার স্পর্ধা। এই স্পর্ধাই স্বপ্ন দেখাক প্রতি মুহূর্তে।
বাড়িতে, অফিসে, চায়ের দোকানে, আড্ডায় ঘুরে বেড়াক সত্যের সেই স্পর্শ। ভার্চুয়াল যুগে সেই স্পর্শই থাক প্রতিস্পর্ধা হয়ে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy