একেবারে গোড়া থেকেই তথ্যের লভ্যতার নিরিখে কোভিড যেন আলিবাবার রত্নগুহার ভান্ডার। বৈশ্বিক অতিমারিতে শ্রেণিবদ্ধ তথ্যের খনি পেয়েছেন ডেটা সায়েন্টিস্ট, রাশিবিজ্ঞানী, কম্পিউটার বিশেষজ্ঞ, মহামারি-বিশারদরা। ইন্টারনেটে কয়েকটা ক্লিকেই মিলছে প্রচুর ডেটা। একেবারে বিনামূল্যে। দেশে দেশে, এমনকি বিভিন্ন শহরে প্রতি দিনের আক্রান্তের সংখ্যা, মৃত্যুর সংখ্যা। সেই সব তথ্যের হৃৎস্পন্দন নিংড়ে কোভিড সংক্রমণের, এবং সে সংক্রান্ত মৃত্যুর ট্র্যাজেক্টরি বা আবক্রপথ নির্ণয়ের চেষ্টা হয়েছে। এই আনুমানিক লেখচিত্রের পথ বেয়ে হিসেব কষার চেষ্টা হয়েছে যে, সংক্রমণের সংখ্যা ঠিক কবে পৌঁছবে তার শীর্ষবিন্দুতে, কোনটা সেই চূড়া, এবং কবে সেই লেখচিত্র নেমে আসবে বিপদসীমার নীচে। এমনকি কত দিন লকডাউন থাকলে কোভিড সংক্রমণের সংখ্যা হয়ে যাবে শূন্য বা তার কাছাকাছি, ডেটা সায়েন্টিস্টরা বাতলে দিলেন সেটাও। কোনও বিশেষজ্ঞের হিসেবে তা ৪৯ দিন, কারও অনুমান ২৯ দিন। দ্বিতীয় বা তৃতীয় তরঙ্গের সময়সীমা, তার সংক্রমণের পরিধিরও হরেক হিসেব হাজির।
বিজ্ঞানীদের এই অনুমানের বহরে সাধারণ মানুষ বিভ্রান্ত, বিমূঢ়, এবং চমৎকৃত! পূর্বাভাসগুলোর বেশির ভাগই দেশ-বিদেশের নামকরা বিশ্ববিদ্যালয় বা ইনস্টিটিউটের বিজ্ঞানীদের গবেষণালব্ধ ফল। মিডিয়াও ঘটা করে এ সবের প্রচার করে। নিউজ় চ্যানেলের প্রাইম টাইমে, সংবাদপত্রের প্রথম পাতায়। এই অবধি ঠিকই ছিল। কিন্তু দেখা গেল, তথাকথিত বিশেষজ্ঞদের এই সমস্ত অনুমান অনেক ক্ষেত্রেই পরস্পরবিরোধী। এবং সময়ের স্রোতে প্রমাণিত হয় যে, অধিকাংশ অনুমানই বাস্তবের সঙ্গে সম্পর্ক-শূন্য। প্রথম দিকে এমন অনুমানও এসেছিল যে, কোভিডে গোটা পৃথিবীতে মৃত্যুর সংখ্যা ২০০৯-এর সোয়াইন ফ্লু-র চাইতেও কম হবে, অর্থাৎ ২,৮৪,০০০-এর কম। ইতিমধ্যেই সরকারি হিসেবে ৩৮ লক্ষ ছাড়িয়েছে সংখ্যাটা। ২০২০’র মার্চে ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ের এক বহু-চর্চিত হিসেবে বলা হল যে, আমেরিকাতে কোভিডে মোট মৃত্যু হবে ১ লক্ষ ৬১ হাজার। মাসখানেকের মধ্যেই সংশোধিত অনুমান এল ৬০,৪১৫। অথচ, এখনও পর্যন্ত সরকারি হিসেবেই আমেরিকাতে মোট কোভিড-মৃত্যু ৬ লক্ষ ছাড়িয়েছে। এই বিশেষজ্ঞরা যে রাশিবিজ্ঞানের গাণিতিক মডেল-নির্ভর অনুমানকে মানুষের চোখে জ্যোতিষের পূর্বাভাসের পর্যায়ে নামিয়ে আনতে পেরেছেন, সে বিষয়ে সন্দেহ কম।
কিন্তু এর কারণ কী? প্রথমে দেখা দরকার যে, এই অনুমানগুলি করা হয়েছে কী ভাবে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই সাহায্য নেওয়া হয়েছে মহামারি-বিদ্যায় বহুল-ব্যবহৃত কোনও না কোনও মডেলের, অথবা রাশিবিজ্ঞানের কিছু সহজ প্রচলিত পদ্ধতির। এ রকম বেশ কিছু মডেল তৈরি হয়েছে গত একশো বছরে। যেমন, ‘সংক্রমণযোগ্য’, ‘সংক্রমিত’ এবং ‘আরোগ্যপ্রাপ্ত’দের নিয়ে সহজতম মডেল হল ‘এসআইআর’। রয়েছে এই মডেলের বিভিন্ন অবস্থান্তরও। যেমন, কিছু আক্রান্তর অসুখের লক্ষণ স্পষ্ট নয়। কিছু মানুষ মারা যান, কিছু সুস্থ হয়ে ওঠেন। তাই ক্ষেত্রবিশেষে ‘মৃত’, ‘সংবাহক’, অথবা ‘প্রতিরোধ ক্ষমতা যুক্ত’দের নিয়ে আর একটু জটিল করা হয় মডেলটাকে। মডেলগুলি আগে থেকেই স্টাডি করা রয়েছে বিস্তারিত ভাবে, এগুলি অন্তর্ভুক্ত করা আছে বিভিন্ন সফটওয়্যার প্যাকেজেও। সেখানে দৈনিক সংক্রমণ, মৃত্যু ইত্যাদির সংখ্যাগুলি ‘ইনপুট’ হিসেবে দিলেই বেরিয়ে আসবে মডেলের প্যারামিটার বা স্থিতিমাপ-গুলির মান। সফটওয়্যার মুহূর্তেই তৈরি করবে ভবিষ্যতের আনুমানিক লেখচিত্রও। এ সবের সাহায্যে তাই কোভিডের গতিপ্রকৃতির কিছু একটা অনুমান করা সাংঘাতিক কঠিন কাজ নয়। কোভিড-পর্বে যে অনুমানগুলি প্রকাশিত হয়েছে মিডিয়াতে, তার বেশির ভাগেই ব্যবহৃত হয়েছে এ ধরনের কোনও না কোনও অতি-সরল মডেল বা তার সামান্য বিচ্যুতি।
কিন্তু এই মডেলগুলি কি আদৌ কোভিডের মতো এক অজানা অসুখের বিস্তারের জটিল রূপচিত্র যথাযথ ভাবে বর্ণনার উপযুক্ত? মডেলগুলির প্রত্যেকটাই দাঁড়িয়ে আছে সংশ্লিষ্ট অসুখের বৈশিষ্ট্য, তার সংক্রমণ, বিস্তার, এবং সেই সঙ্গে সংশ্লিষ্ট জনগোষ্ঠীর আচরণ সম্পর্কিত বেশ কিছু পূর্বানুমানের উপর। সেগুলি না মিললে মডেলটাই মাটি; মডেলের সাহায্যে যে কোনও পূর্বাভাস হয়ে যেতে পারে বাস্তবের সঙ্গে সম্পর্কহীন। কোভিডে সংক্রমণের রসায়ন, তার গতিশীলতা একেবারেই অজানা ছিল শুরুতে। এমনকি শতাব্দীর ভয়ঙ্করতম অতিমারিতে মাস্ক-স্যানিটাইজ়ারে মাখামাখি বছর দেড়েক কাটিয়ে ফেলেও এই রসায়নের অনেকটাই এখনও অপরিজ্ঞাত, ভাইরাসের নতুন রূপ আর তাদের নতুন চরিত্র প্রকাশ পাচ্ছে মাঝেমধ্যেই। তাই শতাব্দী-বিকশিত মহামারিবিদ্যায় প্রচলিত মডেলগুলির কোনটা যে এই অতিমারিতে কতটা সুপ্রযুক্ত, তার তল পাওয়া কঠিন। প্রচলিত কোনও মডেলই কার্যকর না হওয়ার সম্ভাবনাও যথেষ্ট।
শুধুই কি মডেলে ভুল? কোভিডের তথ্যের যথার্থতা নিয়েও প্রবল সন্দেহ দেশে-বিদেশে। সেই প্রথম থেকেই। একে তো অ্যাসিম্পটম্যাটিক রোগীর সংখ্যার হদিস পাওয়াই কঠিন। বিভিন্ন সময়ে নানা দেশের ‘সেরোসার্ভে’-তে পাওয়া প্রতিরোধক্ষমতা সম্পন্ন মানুষের সংখ্যার সঙ্গে নথিবদ্ধ মোট সংক্রমিতের সংখ্যার বিপুল পার্থক্য এই সন্দেহ দৃঢ় করে। অনেকেই মনে করেন, অনেক দেশে মোট কোভিড-আক্রান্ত এবং কোভিডে মৃতের সংখ্যা সরকারি তথ্যের বেশ কয়েক গুণ। দ্য ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল-এর জানুয়ারির এক প্রতিবেদন অনুসারে আমেরিকাতে প্রত্যেক নথিবদ্ধ কোভিড সংক্রমিতের জন্য নাকি রয়েছে অন্তত দু’জন অনথিবদ্ধ সংক্রমিত। সতর্কীকরণ দিয়ে রেখেছে আমেরিকার ‘সেন্টারস ফর ডিজ়িজ় কনট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশন’, বলেছে কোভিডের ক্ষেত্রে যথাযথ গণনা অসম্ভব, কারণ অনেক সময় অসুস্থতা অল্প থাকতে পারে, অসুখের লক্ষণ সঙ্গে সঙ্গে দেখা না-ও দিতে পারে, রিপোর্টিং এবং পরীক্ষায় দেরি হতে পারে, সংক্রমিত প্রত্যেকেরই পরীক্ষাও হয় না ইত্যাদি। ২০২০-তে যখন কোভিডের ঝাপটায় মুমূর্ষু ইটালি ধুঁকছে, মিলানের বিশ্ববিদ্যালয়ের আমার পরিচিত এক অধ্যাপক ইমেলে লিখলেন, তাঁর ধারণা সে দেশে কোভিডে মৃত্যু সরকারি হিসেবের চাইতে অনেক বেশি, কারণ বহু মানুষ মারা যাচ্ছেন কোভিড পরীক্ষা ছাড়াই। ভেঙে পড়া স্বাস্থ্যব্যবস্থা, অপর্যাপ্ত এবং ত্রুটিযুক্ত পরীক্ষা-পদ্ধতি, সামাজিক জড়তা ইত্যাদি নানাবিধ কারণেও কোভিড আক্রান্তের সংখ্যা অনেক কম নথিবদ্ধ হতে পারে। মৃত্যুর কারণ হিসেবে কোভিড এবং কো-মর্বিডিটির সীমারেখাও অনেক ক্ষেত্রে ধূসর। সমস্যা আরও জটিল, কারণ কোভিডের বিশাল তথ্যভান্ডারের সম্ভাব্য ভুলের পরিমাণটাও আপাত-অজানা। অথচ, যে বিশেষজ্ঞরা কোভিডের মডেল-ভিত্তিক পূর্বাভাসে ব্রতী হয়েছেন, তাঁরা মোটের উপর কাজ করে চলেছেন এই সম্ভাব্য অজানা পরিমাণের ভুল তথ্যের ভিত্তিতে, জেনেশুনেই। তথ্য তো অতিমারির নাড়ির স্পন্দন। তাই ভুল স্পন্দনের ভিত্তিতে কোভিড অসুখের নিদান দিলে সেখানেও ভুলের সম্ভাবনা। তথ্যে ভুল থাকলে তাকে খানিকটা ঠিক করে নেওয়াও হয়তো অসম্ভব নয়। কিন্তু পূর্বাভাসের ক্ষেত্রে সে প্রয়াস কেউ দেখিয়ে থাকলে তা আমার নজর এড়িয়েছে। ভুল মডেলের সঙ্গে সম্ভাব্য তথ্যের বিভ্রান্তি এই সমস্ত অনুমানকে হয়তো তাই আরও বিভ্রান্ত করেছে।
এই অবস্থায় প্রচলিত কোনও মডেলকে হুবহু বা সামান্য বদলে ব্যবহার করে প্রাপ্ত কোভিড ডেটার বিশ্লেষণ আসলে অন্ধকারে ঢিল ছোড়ার মতো। তবু কেন হয় এই ধরনের পূর্বাভাস? নীতি-নির্ধারকদের ক্ষেত্রে নাহয় কিছু অনুমানের প্রয়োজন পরিকাঠামোর ব্যবস্থাপনার প্রয়োজনে। কিন্তু বাকিদের, বিশেষ করে শিক্ষাব্রতীদের ক্ষেত্রে, এই অনুমানের খেলাটার কারণ কী? শুধুই অর্থহীন গবেষণাপত্র লিখে নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখা? ১৫ মিনিটের খ্যাতির আশা? যে মিডিয়া ঢাক-ঢোল বাজিয়ে তাঁদের অনুমানকে প্রচার করে, অনুমান না মেলার পরে তারাও কি সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞদের জিজ্ঞেস করে তাঁদের অনুমান না মেলার কারণ? অর্থহীন অনুমানের ফলে সংশ্লিষ্ট জনগোষ্ঠীতে ভয়ের বাতাবরণের বিস্তার যেমন ভয়ঙ্কর, মিথ্যা নির্ভরতার ভরসাও বোধ করি একেবারেই অভিপ্রেত নয়।
ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইনস্টিটিউট
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy