যাত্রী: ‘ভারত জোড়ো যাত্রা’পথে কাশ্মীরে উপস্থিত রাহুল গান্ধী, শ্রীনগর, ৩০ জানুয়ারি। পিটিআই
রাহুল গান্ধী বলতে বিজেপি কী বোঝায়? রাজপরিবারের ছেলে। বাবা, ঠাকুমা, ঠাকুমার বাবা সবাই প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। নরেন্দ্র মোদীর ভাষায় ‘নামদার’ পরিবার। সেই পরিবারের দোহাই দিয়ে রাহুলও প্রধানমন্ত্রী হতে চান। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী হওয়ার যোগ্যতাই তাঁর নেই। কিছুই বোঝেন না। দেশ-দুনিয়ার অভিজ্ঞতা নেই। এক কথায় ‘পাপ্পু’।
রাহুল গান্ধী নিজেও তা জানতেন। বার বার বলতেন, গত তিন দশকে তাঁর পরিবারের কেউ প্রধানমন্ত্রী হননি। তা হলে কেন পরিবারতন্ত্রের অভিযোগ ওঠে! ‘পাপ্পু’-র ভাবমূর্তি থেকে বেরিয়ে আসতে তিনি কখনও অতিরিক্ত আগ্রাসী হয়ে ওঠার চেষ্টা করেছেন, কখনও নরেন্দ্র মোদীকে অস্বস্তিতে ফেলতে তাঁকে লোকসভায় আলিঙ্গন করেছেন, কখনও নিজের পড়াশোনা-করা, বোধবুদ্ধিসম্পন্ন, ওয়াকিবহাল ব্যক্তিত্ব তৈরির চেষ্টা করেছেন। কোনও চেষ্টাই সফল হয়নি।
অগত্যা রাহুল গান্ধীকে রাস্তায় নেমে পড়তে হল। কন্যাকুমারী থেকে শুরু করে ভারত জোড়ো যাত্রা দিল্লিতে পৌঁছনোর পরে রাহুল গান্ধী বললেন, ওই সব ‘ভাবমূর্তি’ নিয়ে তাঁর বিন্দুমাত্র মাথাব্যথা নেই। তিনি ‘রাহুল গান্ধী’ নামক সত্তাকে মেরে ফেলেছেন। যাঁকে দেখা যাচ্ছে, সে রাহুল গান্ধী নয়। রাহুল গান্ধী সাংবাদিকদের মস্তিষ্কে রয়েছে। বিজেপির মস্তিষ্কে রয়েছে। তাঁর মাথায় নেই। ‘রাহুল গান্ধী’-কে তিনি পিছনে ফেলে এসেছেন।
এটা কি সম্ভব? রাহুল গান্ধী বলছেন, সম্ভব। প্রায় সাড়ে তিন হাজার কিলোমিটার পদযাত্রা শেষ করে শ্রীনগরে রাহুল বলেছেন, হিন্দু দর্শনে এরই নাম ‘শূন্যতা’। ইসলামে একেই ‘ফনা’ বলে। দুইয়েরই অর্থ হল, নিজের সত্তার উপরে, নিজের অহঙ্কারের উপরে, নিজের ভাবনাচিন্তার উপর আক্রমণ। নিজের সম্পর্কে মানুষ যে সু-উচ্চ কেল্লার মতো ধ্যানধারণা তৈরি করে ফেলে, ভাবতে থাকে যে আমি এই, আমি সেই, আমার বাড়ি রয়েছে, জ্ঞান রয়েছে, সেই ধ্যানধারণার উপরেই আক্রমণ। নিজের কাছে নিজের ভাবমূর্তিটাকেই গুঁড়িয়ে দেওয়া। যার শেষে পড়ে থাকে শুধুই শূন্যতা।
শ্রীনগরের সেই সভার দিন দশেক পরে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী পর পর দু’দিন লোকসভা ও রাজ্যসভায় বক্তৃতা করলেন। রাহুল বলেছিলেন, তাঁর ‘রাহুল গান্ধী’ সত্তাকে বিসর্জন দেওয়ার কথা। নরেন্দ্র মোদীকে দেখা গেল, তিনি যত্ন করে ‘নরেন্দ্র মোদী’ নামক ব্যক্তিসত্তাকে আরও যত্ন করে সাজাচ্ছেন। বিরোধীরা শিল্পপতি গৌতম আদানির সঙ্গে তাঁর সম্পর্ককে হাতিয়ার করে মোদীর ভাবমূর্তিকে কালি ছেটানোর চেষ্টা করছেন। মোদী নিজের ‘ব্র্যান্ড নরেন্দ্র মোদী’ নামক সত্তার ধুলো ঝেড়ে, তাতে নতুন অলঙ্কার পরিয়ে, তাকে আরও বড় করে তুলে ধরলেন। তাঁর বক্তৃতায় বার বার ‘আমি’ শব্দটা ঘুরে-ফিরে এল। মোদী নিজেই নিজের সত্তাকে ‘মোদী’ নামে পরিচয় দিয়ে বললেন, মোদীর উপরে ভরসা কোনও খবরের কাগজের হেডলাইন বা টিভি চ্যানেলের চকমকে চেহারা থেকে তৈরি হয়নি। জীবন সমর্পণ করতে হয়েছে। প্রতিটা মূহূর্ত দেশের জন্য সমর্পণ করতে হয়েছে। মোদী বলেছেন, মোদী দেশের ২৫ কোটি পরিবারের সদস্য। মোদী দুঃসময়ে ১৪০ কোটি মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছে। তাই তাঁরা মোদীর বিরুদ্ধে কোনও অভিযোগ বিশ্বাস করবে না।
তা হলে বিষয়টা কী দাঁড়াল? এক দিকে রাহুল গান্ধী নিজের পুরনো সত্তা ছেড়ে বেরিয়ে আসতে চাইছেন। তিনি নরেন্দ্র মোদীর বিপরীতে নিজের ব্যক্তিসত্তাকে তুলে ধরতে চাইছেন। অন্য দিকে, নরেন্দ্র মোদী নিজের সত্তাকে আরও বড় আকার দিতে চাইছেন। যে নরেন্দ্র মোদী একাই বিরোধীদের টেক্কা দিতে পারেন। এবং ২০২৪-এর লোকসভা নির্বাচনের প্রেক্ষাপট তৈরি হচ্ছে।
লোকসভা নির্বাচন ‘নরেন্দ্র মোদী বনাম রাহুল গান্ধী’-র লড়াই হলে তা বিজেপির কাছে বরাবরই লোভনীয় বিষয়। এক-একটি রাজ্যে এক-এক বিরোধী দলের সঙ্গে লড়াইয়ের বদলে জাতীয় স্তরে কংগ্রেসের সঙ্গে লড়াই বিজেপির কাছে সহজ। কারণ বিজেপি নেতারা জানেন, ব্যক্তিগত ভাবমূর্তির মুখোমুখি লড়াইতে রাহুল গান্ধী কোনও দিনই নরেন্দ্র মোদীর সঙ্গে যুঝে উঠতে পারবেন না। রাহুল কোনও দিনই নরেন্দ্র মোদীর মতো বাগ্মী নন। রাজনৈতিক, প্রশাসনিক অভিজ্ঞতার নিরিখেও রাহুল অনেক পিছিয়ে। মোদী অনগ্রসর সমাজের সাধারণ, দরিদ্র পরিবার থেকে উঠে আসা নেতা। রাহুল ‘এলিট’ সমাজের প্রতিনিধি। দু’জনের কোনও প্রতিযোগিতাই সম্ভব নয়।
এই গল্পটাই ঘোরানোর চেষ্টা করছেন রাহুল। এক বার তিনি নরেন্দ্র মোদীর নিজের নাম লেখা মহার্ঘ সুট পরিধানের দিকে ইঙ্গিত করে মোদী সরকারকে ‘সুট-বুট কি সরকার’ বলে নিশানা করেছিলেন। সেই তকমা ঝেড়ে ফেলতে মোদীকে যথেষ্ট পরিশ্রম করতে হয়েছিল। শিল্পমহলের জন্য জমি অধিগ্রহণের পথ সহজ করার কাজও করে উঠতে পারেননি তিনি। তাঁকে বার বার নিজের সাধারণ পরিবার থেকে উঠে আসা পরিচয় কাজে লাগাতে হয়েছে। নিজেকে কখনও ‘চা-ওয়ালা’, কখনও ‘কামদার’ হিসেবে পরিচয় দিতে হয়েছে। উল্টো দিকে রাহুল গান্ধী-সহ কংগ্রেস নেতৃত্বকে উচ্চ সমাজের প্রতিনিধি হিসেবে দাগিয়ে তিনি তাঁদের ‘নামদার’ বলে নিশানা করেছেন।
রাহুল গান্ধী এখন নিজের সেই ‘রাজপরিবারের ছেলে’-র সত্তা থেকে বার হতে চাইছেন। তিনি কন্যাকুমারী থেকে কাশ্মীর পায়ে হেঁটে পৌঁছেছেন। এর পরে আবার পূর্ব-পশ্চিম ভারত যাত্রার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। আগের তুলনায় তিনি এখন অনেকটাই আত্মবিশ্বাসী। তাঁকে নিয়ে বিজেপি নেতারা কটাক্ষ করলেও পাঁচ মাস রাস্তায় কাটিয়ে রাহুলের মধ্যে ‘পরোয়া করি না’ মেজাজ এসেছে। এই রাহুলকে দেখে মনে হচ্ছে, তিনি রাজনীতিটা উপভোগ করছেন। মায়ের চাপে বাধ্য হয়ে করছেন না।
প্রশ্ন হল, এই রাহুলও কি নরেন্দ্র মোদীকে টেক্কা দিতে সক্ষম? উত্তর সহজ। কোনও ভাবেই না। আর সেই কারণেই রাহুল নিজের পুরনো ভাবমূর্তি ঝেড়ে ফেলার সঙ্গে ফের নরেন্দ্র মোদীর ভাবমূর্তিতে কালি ছেটাতে চাইছেন। আদানি গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে প্রতারণা, শেয়ার দরে কারচুপির অভিযোগ উঠেছে। সেই সুযোগে রাহুল প্রধানমন্ত্রী মোদীর সঙ্গে শিল্পপতি গৌতম আদানির সম্পর্ক তুলে ধরে মোদী আদানিকে নানা সুবিধা পাইয়ে দিয়েছেন বলে অভিযোগ তুলছেন। বলা বহুল্য, মোদী-আদানির এই সুসম্পর্কই দেশের একমাত্র বিপদ বলে প্রমাণ করতে পারলেই রাহুল সফল হবেন।
নরেন্দ্র মোদীর ব্যক্তিগত ভাবমূর্তিকে আক্রমণ করাটা সঠিক কৌশল কি না, তা নিয়ে ২০১৯-এর লোকসভা নির্বাচনের আগে-পরেও কংগ্রেসের মধ্যে বিতর্ক হয়েছে। কংগ্রেসের প্রবীণদের মত, মোদীকে নিশানা না করে মূল্যবৃদ্ধি, বেকারত্বের মতো সমস্যা নিয়ে সরব হওয়া উচিত। মোদীকে নিশানা করলে তিনি উল্টে সহানুভূতি কুড়োনোর চেষ্টা করবেন। এ বারও মোদী সেটাই করেছেন। দেশের ১৪০ কোটি মানুষকে ‘আমি তোমাদেরই লোক’ বলে বার্তা দিয়ে আমজনতার সমর্থনকে নিজের ‘রক্ষাকবচ’ বলে দাবি করেছেন। উল্টো দিকে রাহুল মনে করছেন, বিজেপি ও কংগ্রেস-সহ বিরোধী শিবিরের মধ্যে ফারাক করে দিচ্ছেন শুধুমাত্র নরেন্দ্র মোদী। তাই তাঁর সু-উচ্চ ভাবমূর্তির দড়ি ধরে টান মারা জরুরি।
নরেন্দ্র মোদীর এই ব্যক্তিসত্তা রাহুল গান্ধীর কাছে যতখানি চিন্তার কারণ, ততটাই বিজেপির কাছে। সময়ের সঙ্গে বিজেপি নরেন্দ্র মোদীর উপরে অতিনির্ভর হয়ে পড়ছে। লোকসভা, রাজ্যসভায় গোটা বিজেপি শিবির যে ভাবে ‘মোদী, মোদী’ জয়ধ্বনি দিচ্ছেন, তাতে তা স্পষ্ট। মোদী না থাকলে কী হবে, তার উত্তর কোনও বিজেপির নেতারই জানা নেই। যে আরএসএস বরাবরই ব্যক্তিপুজোর বিরোধী, সেই আরএসএস-ও আদানি নিয়ে অভিযোগ থেকে মোদীকে বাঁচাতে চাইছে। কারণ, এখন মোদীর আরএসএস-কে দরকার নেই। আরএসএস-এরই মোদীকে দরকার।
২০২৪-এর লোকসভা নির্বাচনে নরেন্দ্র মোদীর ব্যক্তিসত্তা কতখানি কার্যকর হবে, সেটাই মূল প্রশ্ন— রাহুল গান্ধীর সামনে, বিজেপি-আরএসএস-এর সামনেও।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy