অপমান: রাহুল গান্ধীকে ক্ষমা চাইতে হবে, এই দাবিতে বিজেপি কর্মীদের বিক্ষোভ। ২৫ মার্চ ২০২৩, মুম্বই। পিটিআই
গত লোকসভা ভোটের আগে সে সময়ের তিন কংগ্রেস-শাসিত রাজ্যের পরিস্থিতি ঘুরে দেখার দায়িত্ব পড়েছিল— ছত্তীসগঢ়, মধ্যপ্রদেশ ও রাজস্থান। যাত্রা শুরু ছত্তীসগঢ়ের রাজধানী রায়পুর থেকে। রিপোর্টারের ডায়েরি বলছে, দিনটা ছিল ১৬ এপ্রিল ২০১৯। সে দিনই ছত্তীসগঢ়ে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর দু’খানা জনসভা। একটি বিলাসপুর ডিভিশনের কোরবায়। অন্যটি ভাটাপারাতে।লোকসভা নির্বাচনের প্রচারে তখন রীতিমতো আগুন ঝরছে। প্রধানমন্ত্রী নিত্যনতুন অস্ত্র বার করছেন তূণীর থেকে। ছত্তীসগঢ়ের জোড়া জনসভায় তিনি নতুন তির ছুড়লেন। ভাটাপারায় গান্ধী পরিবারকে নিশানা করে বললেন, ওঁরা প্রতি দিন সীমা ছাড়াচ্ছেন। ওঁদের মতে, যাঁর পদবিই মোদী, সে-ই চোর। এ কেমন রাজনীতি? বাহবা কুড়োতে পুরো সম্প্রদায়ের গায়ে চোর তকমা লাগিয়ে দিয়েছে। এর পরে কোরবার জনসভায় আরও এক ধাপ এগোলেন মোদী। বললেন, ছত্তীসগঢ়ে সাহু সমাজের বহু মানুষ রয়েছেন। ছত্তীসগঢ়ে যাঁদের পদবি সাহু, গুজরাতে তাঁরাই মোদী। ওঁরা বলছে, সব মোদী চোর। তা হলে কি গোটা সাহু সমাজের লোকই চোর?
ছত্তীসগঢ়ের রাজনীতিতে সে দিন হইচই পড়ে গিয়েছিল। এ তো ‘মাস্টারস্ট্রোক’! রাজ্যে সাহু সম্প্রদায় গুরুত্বপূর্ণ ভোটব্যাঙ্ক। সংখ্যায় তো বটেই, প্রভাবেও। সাহুদের বড় অংশই ব্যবসায়ী। মোদী এক তিরে গোটা সাহু সম্প্রদায়কে কাছে টেনে নিলেন। হাতিয়ার করলেন রাহুল গান্ধীর তিন দিন আগের বক্তৃতাকে। ১৩ এপ্রিল কর্নাটকের কোলারে প্রচারে গিয়েছিলেন রাহুল। সেখানেই তিনি বলেন, “একটা ছোট্ট প্রশ্ন করছি। সব চোরের পদবি মোদী কী করে হল? নীরব মোদী, ললিত মোদী, নরেন্দ্র মোদী।” দোভাষী নিয়ে বক্তৃতা করেছিলেন রাহুল। কংগ্রেসের এক স্থানীয় নেতা জনসভায় তাঁর কথা অনুবাদ করেছিলেন। সেই বক্তৃতা খুব বেশি হইচই ফেলেনি। মোদী নিজেই রাহুলের বক্তৃতাকে প্রচারের আলোয় নিয়ে এলেন।
প্রায় চার বছর পরে কোলারের সেই বক্তৃতার জেরেই রাহুল গান্ধী এখন লোকসভার ‘ডিসকোয়ালিফায়েড’ সাংসদ। গুজরাতের ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে রাহুলের সাজা, সাংসদ পদ খারিজকে ‘নরেন্দ্র মোদীর ষড়যন্ত্র’ বলে কংগ্রেস প্রতিহিংসার রাজনীতির অভিযোগ তুলেছে। পাশে পেয়েছে সমস্ত বিরোধী দলকে। তৃণমূলের মতো কংগ্রেসের সংসর্গ এড়িয়ে চলা দলও এই প্রশ্নে কংগ্রেসের পাশে। গত কয়েক দিনে কিছু প্রশ্ন ঘুরপাক খেয়েই চলেছে— এতে কি আখেরে রাহুলেরই লাভ হল না? জরুরি অবস্থার পরে ইন্দিরা গান্ধীকে গ্রেফতার হতে হয়েছিল। সেখান থেকেই ঘুরে দাঁড়িয়েছিলেন ইন্দিরা। রাহুলের কি এখান থেকেই উত্থান হবে? তা হলে ২০২৪-এর লোকসভা ভোটের ঠিক এক বছর আগে কি নরেন্দ্র মোদী-অমিত শাহ জুটি ভুল করে ফেললেন?
প্রশ্নটা ভুল নয়। নরেন্দ্র মোদী, অমিত শাহের মতো ধুরন্ধর রাজনীতিক এই প্রশ্ন নিয়ে ভাবনাচিন্তা করেননি, সেটা ধরে নেওয়াটা ভুল।
যুদ্ধের নিয়ম বলে, আপনি কার সঙ্গে লড়বেন, সেটা যদি আপনি নিজেই ঠিক করতে পারেন, তা হলে জয় নিশ্চিত। নরেন্দ্র মোদীও সেটাই করছেন। তিনি হিসাব কষেই রাহুলকে নিজের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে তুলে আনছেন। কারণ তাঁর মতে, লড়াইটা তাঁর সঙ্গে রাহুলের হলে তিনিই এগিয়ে থাকবেন। রাহুলের তুলনায় তিনি রাজনৈতিক, প্রশাসনিক অভিজ্ঞতায় অনেক এগিয়ে। ব্যক্তিগত জনপ্রিয়তার নিরিখে রাহুল তাঁর ধারেকাছে আসেন না। উপরন্তু রাহুল প্রধান বিরোধী মুখ হয়ে উঠলে বিরোধী ঐক্যে ফাটল ধরবে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, অখিলেশ যাদব বা অরবিন্দ কেজরীওয়ালরা রাহুলের নেতৃত্ব মেনে নেবেন না। মোদী-শাহর হিসাব অনুযায়ী, রাহুল ইন্দিরা গান্ধীর নাতি হতে পারেন, কিন্তু তিনি ইন্দিরা নন। ইন্দিরা গান্ধী যা পেরেছিলেন, রাহুলের পক্ষে তা করা কঠিন।
হিসাবে ভুল হয়। বামফ্রন্ট জমানায় জ্যোতি বসু-বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যরা ঠিক এই ভুলটাই করেছিলেন। কংগ্রেসের নেতা-নেত্রীদের মধ্যে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রধান বিরোধী মুখ হয়ে ওঠার পিছনে জ্যোতি বসুর অবদান কম ছিল না। তিনি নিজেই প্রিয়রঞ্জন দাশমুন্সি, সোমেন মিত্র, সুব্রত মুখোপাধ্যায়দের বদলে মমতাকে নিশানা করতেন। যাতে মমতাই কংগ্রেসের প্রধান মুখ হয়ে ওঠেন। লড়াইটা জ্যোতি বসু বনাম মমতা হয়ে ওঠে। কংগ্রেসের মধ্যে ফাটল তৈরি হয়। বাম জমানার শেষবেলাতেও সিপিএম নেতৃত্বের বিশ্বাস ছিল, বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের সঙ্গে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ব্যক্তিগত লড়াই হলে পশ্চিমবঙ্গের বাঙালি শিক্ষিত, সংস্কৃতিমনস্ক ধোপদুরস্ত ভাবমূর্তির বুদ্ধদেবকেই বেছে নেবেন। সে হিসাব মেলেনি।
নরেন্দ্র মোদী, অমিত শাহদের আসল হিসাব অবশ্য অন্য— তা হল ওবিসি রাজনীতি। ২০১৯-এর আগে রাহুল গান্ধীর মোদী পদবি নিয়ে মন্তব্যকে অস্ত্র করে নরেন্দ্র মোদী ছত্তীসগঢ়ে গিয়ে অভিযোগ তুলেছেন, তিনি গুজরাতের মোদীদের সঙ্গে ছত্তীসগঢ়ের সাহুদেরও চোর বলে অপমান করেছেন। এক বারও বলেননি, রাহুল ওবিসি অর্থাৎ অন্যান্য অনগ্রসর শ্রেণির মানুষকে অপমান করেছেন। কারণ, ছত্তীসগঢ়ের সাহুরা ওবিসি নন। নরেন্দ্র মোদী নিজে ওবিসি হলেও গুজরাতের সব মোদী পদবিধারী ওবিসি নন। কাজেই ‘সব চোরের পদবি মোদী কেন’ বলে প্রশ্ন তুললে, সব মোদীকে চোর বলা হয়েছে বলে অভিযোগ তোলা যায়, কিন্তু ‘গোটা ওবিসি সমাজকে চোর বলা হয়েছে’ বলে দাবি করা যায় না। ২০১৯-এর আগে রাহুলের মন্তব্যকে হাতিয়ার করে ২০২৪-এর আগে বিজেপি সেটাই গুলিয়ে দিতে চাইছে। অভিযোগ তুলছে, রাহুল ওবিসি-দের অপমান করেছেন। তারই শাস্তি পেয়েছেন। এটা নিয়েই বিজেপির ওবিসি মোর্চা দেশ জুড়ে প্রচারে নামছে। মোদী-শাহ মনে করছেন, উপরে-উপরে রাহুলের পাশে বিরোধীরা এককাট্টা হলে হবেন। তাঁরা নীচের তলায় গোটা ওবিসি সমাজকে— অর্থাৎ, দেশের সিংহভাগ ভোটারকে— বিজেপির পাশে টেনে আনবেন।
নরেন্দ্র মোদী মোধ ঘাঞ্চি সম্প্রদায়ের প্রতিনিধি। এই মোধ ঘাঞ্চি, তেলি, তেলি সাহু, তেলি রাঠৌর সম্প্রদায়গুলির আদতে পেশা ছিল ভোজ্য তেল তৈরি করা। গুজরাতের হিন্দুদের সঙ্গে মুসলিম, পার্সিদের মধ্যেও মোদী পদবি দেখা যায়। হিন্দুদের মধ্যে মোদী পদবিধারীদের একটা বড় অংশ মোধ বণিক সম্প্রদায়ভুক্ত। তাঁরা ওবিসি নন। মহাত্মা গান্ধী এই মোধ বণিক সম্প্রদায়ের মানুষ ছিলেন। নরেন্দ্র মোদীর মোধ ঘাঞ্চি সম্প্রদায়ও প্রথমে ওবিসি-তালিকাভুক্ত ছিল না। কংগ্রেস অভিযোগ তোলে, নরেন্দ্র মোদী গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পরে নিজের সম্প্রদায়কে ওবিসি-তালিকাভুক্ত করেছিলেন। বিজেপি দাবি করে, আগেই সেই সিদ্ধান্ত হয়েছিল। এ নিয়ে বিতর্ক থাকলেও মোদী জমানায় বিজেপি যে দেশের ওবিসি ভোটের সিংহভাগ নিজের ঝোলায় পুরে ফেলেছে, তা নিয়ে কোনও বিতর্ক নেই। সাধারণ ধারণা হল, ওবিসিরা বোধ হয় দেশের একটা ছোট অংশ। বাস্তব হল, ওবিসিরাই দেশে সংখ্যাগুরু। মণ্ডল কমিশনের রিপোর্টেই বলা ছিল, ওবিসিদের সংখ্যা দেশের জনসংখ্যার ৫২ শতাংশ। ২০০৬-এ সরকারি সমীক্ষায় বলা হয়েছিল, ওবিসিদের সংখ্যা ৪১ শতাংশ। বিজেপি নেতাদের হিসাবে, দেশের ওবিসিদের অর্ধেক ভোটই তাঁরা পেয়ে থাকেন। এখন রাহুলের বিরুদ্ধে ওবিসিদের অপমান করার অভিযোগ তুলে বাকি অর্ধেকও তাঁরা ঝোলায় পুরতে চাইছেন।
আর রাহুলের সাংসদ পদ খারিজকে গণতন্ত্রের উপর আক্রমণ বলে বিরোধীদের অভিযোগের মোকাবিলা কী ভাবে হবে? বলা বাহুল্য, রাহুল গান্ধী তাঁর দু’বছরের কারাদণ্ডের সাজার বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে গিয়ে স্থগিতাদেশ নিয়ে এলেই সঙ্গে সঙ্গে তাঁর সাংসদ পদ ফিরিয়ে দেওয়া হবে। কংগ্রেস যে প্রতিহিংসার রাজনীতির অভিযোগ তুলে সহানুভূতির হাওয়ায় বেলুন ফোলাতে চাইছে, রাহুলের সাংসদ পদ ফিরিয়ে তা ফুটো করে দেওয়া হবে। এখন বিজেপি নেতারা বলেন, ন্যাশনাল হেরাল্ড মামলায় অভিযুক্ত সনিয়া-রাহুল আগাম জামিনের দয়ায় বাইরে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। এর পর তাঁরা বলবেন, রাহুল আদালতের দাক্ষিণ্যে সাংসদ পদে রয়েছেন!
রাজনীতিতে ছলের অভাব হয় না।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy