—প্রতীকী চিত্র।
সকালে খবরকাগজ পড়ে জব্বর দিবাস্বপ্ন দেখলাম আজ। কাকেশ্বর কুচকুচে গাছের উপর থেকে গেছোদাদাকে বলছে, কোথায় তুমি— হাই কোর্টে, তাইল্যান্ডে, ভেনিসে না তিহাড় জেলে? যেখানেই থাকো তোমার প্রতিবেদনটা খুব দরকার, সম্পাদকমশাই তাড়া দিচ্ছেন। বিড়াল নীচ থেকে ফ্যাঁচ করে হাঁচি দিয়ে শুরু করল, প্রথমে তো হিসাব করে দেখতে হবে তুমি কোথায় কোথায় থাকতে পারো, আর কোথায় কোথায় থাকতে পারো না! তার পর ফাইভ-জি’তে গুগলবাবাজির পরামর্শ মেনে জায়গাটা ঠিক করে আবার সেই স্লেট-পেনসিলে আঁক কষে বার করতে হবে, তুমি এখন কোথায় আছ! যেখানেই থাকো জলদি খবর পাঠাও। রোদে রাঙা ইটের পাঁজার উপর বসে ঠোঙাভরা বাদামভাজা রাজামশাই ‘খাচ্ছে কিন্তু গিলছে না’, এমনই জানতাম। এখন দেখা গেল উলটপুরাণ— গিলছে কিন্তু খাচ্ছে না।
আজ়াদির অমৃত মহোৎসবের মধ্যে এক সাংসদ মাইনে, ভাতা, ঘন ঘন বিদেশে চিকিৎসা করানোর টাকা, সবই পাচ্ছেন। কিন্তু তাঁর কোনও ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টের খোঁজ কলকাতা হাই কোর্টের মাননীয় বিচারপতি এখনও পাননি, তদন্তকারী সংস্থার আধিকারিকদের যারপরনাই বকাবকি করার পরেও। সে প্রায় ষাট বছর আগের কথা, আমাদের মেডিক্যাল কলেজের ইমারজেন্সিতে সুনীলদা নামে এক জন ছিলেন, মূর্তিমান বিপদভঞ্জন। আমরা তখন বিপ্লব গেরিলাযুদ্ধ মুক্তাঞ্চল ইত্যাদি নানা স্বপ্নে বিভোর, টগবগ করছি। হাতে ধরে ইনজেকশন দেওয়া, ছোটখাটো কেটে গেলে বা মাথা ফেটে গেলে সেলাই করা এই সব কিছুই শেখাতেন সুনীলদা, আর আমরা তখন পাহাড়ের থেকেও ভারী মৃত্যুবরণ করে নরমান বেথুনের পথ ধরে শহিদ হওয়ার দৌড়ে। সেই বোমা-বন্দুকের বিপ্লবকালে একা হাতে সুনীলদা হাসপাতালের ইমারজেন্সি সামলাতেন যেন একটা ঘোরের মধ্যে, দিনে প্রায় আঠারো ঘণ্টা। কিন্তু কখন যে পেথিডিন ইনজেকশনটা নিতেন নেশার জন্য, আমরা বুঝতে পারতাম না। আমরা তখন সবে ফার্স্ট ইয়ার; সিনিয়র বা হাউস সার্জন দাদারা বলতেন, সুনীলদার পেথিডিন নেওয়াটা ‘গিলছে কিন্তু খাচ্ছে না’, তোরা দেখতে পাবি না। কিন্তু রোজ রক্তে পেথিডিন নিশ্চিত।
মৃণাল সেনও এক বার এই কথাটা বলেছিলেন। গীতা সেন চলে যাওয়ার শেষের দিকে কয়েক মাস হাসপাতাল থেকে বাড়িতে এনে আমার ম্যাক্সিলারি সার্জন বন্ধু, গীতাদির ট্র্যাকিয়োস্টমি করে আরও কয়েক সপ্তাহ ওঁকে বাঁচিয়ে রেখেছিল। মৃণাল সেন জিজ্ঞেস করেছিলেন, গীতা কোনও কথা বলছে না, খাচ্ছে না তো মুখ দিয়ে? ডাক্তারের উত্তর ছিল, “খাচ্ছেন, তবে মুখ দিয়ে নয়, টিউব দিয়ে।” মৃণালদার তাৎক্ষণিক উত্তর, “গিলছে কিন্তু খাচ্ছে না!”
এ আর এমন কী আশ্চর্য ব্যাপার। দিল্লীশ্বররা তো দশ বছর আগেই নাগপুর নির্মিত চিত্রনাট্য অনুযায়ী বলে দিয়েছেন, “খাউঙ্গা ভি নহি, খানেকো ভি নহি দুঙ্গা।” গিলতে দেব না, এমন নিদান তো কেউ দেননি। সত্যিই তো, কত রকমের ট্র্যাকিয়োস্টমি করা যায়! ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে জমা না পড়লেও সরাসরি ট্র্যাকিয়োস্টমি টিউব ধরে একেবারে সাগরপারে বা কাছাকাছি তাইল্যান্ড দুবাই অনেক জায়গা আছে, নিশ্চিন্তে সেখানে পৌঁছে বেমালুম হজমও হয়ে যাবে। স্রেফ ম্যাজিকে, বা হাওয়ায় ভর করে চলে যাবে মিলিয়ন ডলার! কাকেশ্বর কুচকুচে স্লেট দেখে চিৎকার করে পড়ে দিল, “হাওলা হাওলা”। আর এখানে ছোটখাটো দু’-দশ কোটি টাকার কাজের ব্যাপার মাত্র। যেমন বাড়িতে এস্কালেটর, ইটালি থেকে মার্বেল আনা, এ সবের জন্য তো অত দূরে ট্র্যাকিয়োস্টমির টিম পাঠানোর দরকার নেই। আরাধনার জন্য অনেক নন্দী-ভৃঙ্গী, চেলাচামুন্ডা আছে হাসপাতালেই। প্রেসিডেন্সি-তিহাড়কে কাঁচকলা দেখিয়ে দিব্যি নিউ টাউন-সেক্টর ফাইভে রাজত্ব করছে অনেকে, শানু লাহিড়ীর নির্মাণকে অশিক্ষিত অবহেলায় সায়েন্স সিটির সামনে বাইপাসের মোড় থেকে উপড়ে ছুড়ে ফেলে দিয়ে।
কেউ নিউ টাউনে বিল্ডিং বানাচ্ছেন। শানু লাহিড়ীর ওই নির্মাণ থেকে পঞ্চাশ মিটার দূরেই রাস্তার ধারে এনার্জি এডুকেশন পার্কেরও একই দশা, প্রায় এক দশক ধরে তার নির্মাণে লেগে ছিলেন অপ্রচলিত বিদ্যুৎ বিষয়ে আন্তর্জাতিক মহলে স্বীকৃত বিশেষজ্ঞ শক্তিপদ গণচৌধুরী। গাছের উপর থেকে কাকেশ্বর বলে উঠল, দাঁড়াও, স্লেটে অঙ্কটা করে নিই। আসল কথাটা হচ্ছে, ‘গিলছে কিন্তু খাচ্ছে না’-বাবাজির নীল গ্লোবের উপরে লোগোটা লাগাতে হবে আসল জায়গায়। তার জন্য শানু লাহিড়ীকে বিদায়। এনার্জি এডুকেশন পার্কে কার নাম ছিল? মৃণাল সেনের— সাংসদ উন্নয়ন কোটা থেকে টাকাটা দিয়েছিলেন শক্তিপদ গণচৌধুরীর অনুরোধে। সে নাম তো মুছে দিতেই হবে, উপায় কী! তা ছাড়া, তার পিছনে ময়লা-ফেলা জমির উপরে কয়েকশো কোটি টাকার বাড়ি বানাতে হবে না!
কিসের পরিবেশ, কিসের বিকল্প শক্তি বিষয়ে পরবর্তী প্রজন্মকে শিক্ষিত করা! ঊর্ধ্বগগনে বাজে মাদল, আমরা চলেছি নাগপুরের ডাকে— নাগপুরের নির্দেশে সমস্ত ধরনের স্মৃতি ভুলে যাওয়া আর ভুলিয়ে দেওয়া আমাদের পবিত্র কর্ম। কর্তার ইচ্ছাতেই এত সব, আমরা নিমিত্ত মাত্র। চেকোস্লোভাকিয়ায় জন্মানো, প্যারিসে আকাশ-ছোঁয়া লেখক চিন্তাবিদ গল্পকার মিলান কুন্দেরার পরিবারের চার জনের প্রাণ গিয়েছিল কনসেনট্রেশন ক্যাম্পের গ্যাস চেম্বারে। সেই কুন্দেরার বইগুলো একটু হাতে নিয়ে ওল্টালেই দেখা যায় কত ভাবে কত বার উনি বলেছেন— স্মৃতির বিস্মরণ নির্মাণ প্রকল্পই সারা দুনিয়ার স্বৈরাচারী আধিপত্যবাদী ক্ষমতার আসল কাজ।
আসলে এই সবই দিল্লীশ্বরদের কৃপায় শেখা কারুকার্য। ছোট নেতাবাবাজি মাত্র কয়েকশো কোটি গিলেছেন তাও খাননি, তাতেই তিহাড়ে! অবশ্য এই সবও সাময়িক আস্তানা— আজ়াদির অমৃত মহোৎসব তাঁবু গুটানোর আগে কার কী হাল হয় একমাত্র গেছোদাদাই জানেন। কাকেশ্বর কুচকুচের ভাঙা স্লেটে কার জন্য কী নিদান আছে কে জানে! এ সব শুনে ফ্যাচফ্যাচ করে হেসে নীচে বিড়ালবাবাজি আবার রুমাল হয়ে যেতে যেতে বলে গেল, ন্যুরেমবার্গ বিচারটা কোথায় হবে তোমরা কিন্তু আগে থেকে ঠিক করে রাখো। তখন আবার সিট ভাগাভাগি নিয়ে ঝগড়া কোরো না। আমার স্লেটে আবার দেখছি ইংরেজিতে লেখা: “কালেক্টিভ মেমরি অব দ্য পিপল ফর বিল্ডিং কনসেন্ট ইজ় ‘দ্য ওয়েপন’ এগেন্সট ফ্যাসিস্ট হেজিমনি।”
মাস তিন-চার আগে বুডাপেস্ট শহরের কেন্দ্রবিন্দুতে প্রায় মিনিট চল্লিশ ধরে তথ্যকেন্দ্র, খাবারের দোকান-সহ সব জায়গায় খোঁজ করেও কিছুতেই হলোকস্ট মেমোরিয়াল সেন্টার খুঁজে পাচ্ছিলাম না, গুগল কাছাকাছি তা দেখানো সত্ত্বেও। মেট্রো স্টেশনের মুখে যখন এক তরুণকে জিজ্ঞেস করছি ‘ওই সিনাগগটি কাছাকাছি কোথায়, বলতে পারেন?’, এক জন বয়স্কা মহিলা হাতটা তুলে এক দিকে একটা বিরাট বাড়ি দেখিয়ে বললেন, ওর পিছনেই আছে, চলে যাও পেয়ে যাবে। একটু থেমে বললেন, তোমরা কি আউশভিৎজ় গিয়েছ? হ্যাঁ বলতে উনি বললেন, “সবাই সব কিছু ভুলে যায়— এটাই ওদের সাফল্য।” আমরা মাত্র পঞ্চাশ মিটার দূরেই আমাদের উদ্দিষ্ট জায়গা খুঁজে পেলাম। এ নাকি ইউরোপের সব থেকে বড় সিনাগগ, প্রায় চার ঘণ্টা কাটালাম। রুদ্ধশ্বাস মনখারাপ আর স্মৃতির বিস্মরণের বিরুদ্ধে চলমান জীবন্ত প্রতিবাদ। এ শহর থেকেই নাকি পাঁচ লক্ষেরও বেশি মানুষকে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল আউশভিৎজ় কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে, ‘ফাইনাল সলিউশন’-এর লক্ষ্যে!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy