একটা গোটা দেশ তার সমস্ত নারী নাগরিকের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের দরজা বন্ধ করে দিয়েছে, এ কথা ভাবতে গেলেও অবিশ্বাস্য লাগে। ফাইল চিত্র।
মতিউল্লা ওয়েসা কন্দহরের মানুষ। গোটা আফগানিস্তান জুড়ে শিক্ষার দাবি নিয়ে চষে বেড়ানো সমাজকর্মী। তিনি দেখেছেন, মৌলবাদের উগ্র রূপ কী ভাবে শিক্ষাঙ্গনকে গ্রাস করে। তাঁর বাবা বন্ধ হয়ে যাওয়া স্কুল খোলার উদ্যোগ করলে স্থানীয় মানুষ তাঁদের তালিবানি শাস্তির ভয়ে বিতাড়ন করে। কাবুলে গিয়ে লেখাপড়া করেন তরুণ ওয়েসা। ভারতেও আসেন ‘মানবাধিকার’ নিয়ে পড়তে। তাঁর সংগঠনের নাম ‘পেনপাথ’। ২৪০০ স্বেচ্ছাসেবক নিয়ে তিনি অগণিত আফগান বালক-বালিকাকে ক্লাসে টেনে আনার কাজ করছেন এক দশকের উপর। সত্তর শতাংশ নিরক্ষর মহিলা নাগরিক নিয়ে আফগানিস্তান খুঁড়িয়ে চলছে। তিনি এই চিত্র বদলাতে চান। গত ২০ ডিসেম্বর যখন তালিবানি ফতোয়া আইনের স্ট্যাম্প মেরে আফগান ছাত্রীর জন্য উচ্চশিক্ষার দরজা বন্ধ করে দিল, ওয়েসা গলা চড়ালেন। বিপরীত লিঙ্গের উপর এই আগ্রাসন তিনি কিছুতেই মানতে প্রস্তুত নন।
নতুন ক্যালেন্ডার এল কিছু খারাপ এবং কিছু ভাল খবর নিয়ে। একটা গোটা দেশ তার সমস্ত নারী নাগরিকের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের দরজা বন্ধ করে দিয়েছে, এ কথা ভাবতে গেলেও অবিশ্বাস্য লাগে। অথচ, আফগানিস্তানের উচ্চশিক্ষা মন্ত্রক ঠিক এই অপকর্মটিই করেছে। যুক্তি কী? এ নিতান্তই ‘সাময়িক সিদ্ধান্ত’। আসলে শিক্ষা তো ‘খরচসাপেক্ষ’ ব্যাপার, তাই ব্যয়সঙ্কোচন করতে গিয়ে মেয়েদের ছেঁটে ফেলা হয়েছে। এ সবই অজুহাত। আসলে মেয়েদের পক্ষে নাকি প্রাথমিক শিক্ষাই যথেষ্ট। অতএব হাই স্কুলে ছাত্রীদের প্রবেশ নিষিদ্ধ। ইচ্ছামতো পোশাক পরা, স্বাধীন ভাবে পুরুষসঙ্গী ছাড়া পথে বেরোনো, পার্ক বা জিমের মতো জায়গায় যাওয়া, এমনকি বেশির ভাগ কর্মক্ষেত্রে তাঁদের যুক্ত থাকা— সমস্তটাই বন্ধ হয়ে গেল তালিবানি নিষেধাজ্ঞায়। গত ফেব্রুয়ারিতে আফগান মেয়েদের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের দরজা খুলেছিল। সারা শরীর আবৃত করে, বিশেষ দরজা দিয়ে ঢুকে, মেয়েদের জন্য বিশেষ ক্লাসে তাঁদের পড়তে হবে নারী বা বৃদ্ধ শিক্ষকের কাছে। এ সমস্ত মেনেও ছাত্রীদের লেখাপড়ার উৎসাহে খামতি ছিল না। কিন্তু এও তালিবান শাসকের সহ্য হল না।
২০২৩ বয়ে এনেছে কিছু সুসমাচারও। তার অন্যতম হল, ইসলামি শাসনের দুনিয়ায় মেয়েদের উপর চলতে থাকা ধারাবাহিক নির্যাতনের প্রতিবাদে তাঁদের সঙ্গে তাঁদের পুরুষ-সহনাগরিকদের পথে নামা। নারী-পুরুষের নির্ভয় সঙ্গতে রাজপথের বুকে বিদ্রোহের সশব্দ পদচারণা। ইরানে লিঙ্গবৈষম্য বিরোধী আন্দোলনের শহিদ মাহেশা আমিনি যে আগুন জ্বেলে দিয়েছেন, তাতে সমান তালে আত্মাহুতি দিয়ে চলেছেন পুরুষ সহযোদ্ধারা। তাঁদের অন্যতম মাজিদ্রেজ়া রাহনাবার্দের কাহিনি শুনতে শুনতে গায়ে কাঁটা দেয়। ইরানের বিক্ষোভে শামিল হওয়ার ‘অপরাধ’-এ তাঁকে ফাঁসিতে ঝোলানো হয়। ভাইরাল হয়েছে তাঁর মৃত্যু-মুহূর্তে বলা কথাগুলো, “আমি চাই না আমার মৃত্যুর পর কেউ শোক করুন বা আমার কবরের সামনে দাঁড়িয়ে কোরান পাঠ করুন। বরং আনন্দ-ফুর্তি করে, গান বাজিয়ে আমার মৃত্যু উদ্যাপন করা হোক।” সৌদি আরব-সহ এমন বেশ কিছু দেশেই নারী আন্দোলন উদ্দীপ্ত হচ্ছে পুরুষের সক্রিয় সমমর্মিতায়।
আফগানিস্তানও সেই একই চিত্র আঁকল তালিবানবিরোধী বিক্ষোভের ক্যানভাসে। মহিলা সহপাঠীদের প্রবেশ নিষিদ্ধ হওয়ায় তাঁরা নিজেরা যেমন সাহস করে প্রতিবাদ নিয়ে পথে নেমেছেন, প্রতিবাদে শামিল তাঁদের পুরুষ সহপাঠীরাও। তাঁরা ক্লাস বয়কট করছেন। প্ল্যাকার্ড নিয়ে পথে নামছেন। বিশেষত কাবুল, কন্দহর, নানগারহারে তো এই প্রতিবাদ বিশ্বকে রীতিমতো চমকে দিয়েছে। ছাত্র মুজাম্মেল বলেছেন, “আমরা আমাদের বয়কট চালিয়েই যাব। আর যদি ছাত্রীদের ক্লাস আবার শুরু না হয় আমরা আমাদের অনুশীলন, এমনকি লেখাপড়াই বন্ধ করে দেব।” আর এক ছাত্র নাউদুল্লা বলেছেন, “আমাদের বোনেদের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের দরজা বন্ধ। আমরাও তাই সেখানে যেতে চাই না।” নানগারহার বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিক্যাল ছাত্ররা তো পরীক্ষাও বয়কট করে বেরিয়ে এসেছেন। শুধু ছাত্র নয়, অনেক অধ্যাপক পর্যন্ত এই বিদ্রোহে শামিল। কাবুল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ওবেইদুল্লা কাজে ইস্তফা দিয়ে বলেছেন, “আফগানিস্তানে নারী শিক্ষার উপর শাসকের এই অবিচার এবং অনৈতিক নিষেধাজ্ঞার বিরুদ্ধে প্রতিবাদে আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুষদ সদস্যের পদ থেকে ইস্তফা দিলাম।”
প্রসঙ্গত, ১৯৯৬-২০০১ এই প্রথম তালিবানি শাসনে লিঙ্গবৈষম্যের ধ্বজা কম ওড়েনি সে দেশে। সে-দিন কিন্তু সাহস করে মানুষের ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টার কথা এ ভাবে আমাদের কানে আসেনি। যক্ষপুরীর রাজা (রক্তকরবী নাটক) নন্দিনীকে বলেছিলেন তাঁকে পরাজিত করতে তাঁরই হাতে হাত রেখে লড়াইয়ে নামতে। পুরুষতন্ত্রকে সমূলে উৎপাটিত করতে নারীকেও লড়তে হবে পুরুষেরই পাশাপাশি। তালিবান যেমন সত্য, বিলকিস বানো যেমন সত্য, ওবেইদুল্লা বা বরুণ বিশ্বাসরাও তেমনই সত্য। বিক্ষোভ, বিপ্লব আর ভীষণ অসম্ভবে এই কথাটি যেন আমাদের মনে থাকে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy