—ফাইল চিত্র।
পশ্চিমবঙ্গ-সহ গোটা দেশে শব্দবাজির বিরুদ্ধে আইন ও আন্দোলন যাঁর রায়কে ঘিরে শুরু, প্রয়াত সেই বিচারপতি ভগবতীপ্রসাদ বন্দ্যোপাধ্যায় কয়েক বছর আগে শব্দবাজির তাণ্ডব প্রসঙ্গে বলেছিলেন, রাজ্যে বাজির বিরুদ্ধে ল আছে অর্ডার নেই! বেঁচে থাকলে তিনি দেখতেন, এই রাজ্যে তাঁর নির্দেশের ভিত্তিতে তৈরি হওয়া আইনও আজ আর নেই।
নব্বইয়ের দশক থেকে পশ্চিমবঙ্গে বাজির যে সর্বোচ্চ শব্দমাত্রা নব্বই ডেসিবেলে আটকে ছিল বহু আইনি লড়াই ও প্রশাসনিক সক্রিয়তার হাত ধরে, তা হঠাৎ করেই রাজ্য দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের এক নির্দেশে রাতারাতি বাকি দেশের মতো ১২৫ ডেসিবেলে পাল্টে গেল পুজো শুরু হওয়ার ঠিক আগে। পরিবর্তনের, যা নাকি রাজ্যের আইনি কর্তাদের ‘পরামর্শ’ক্রমে হয়েছে, পিছনে মূল যুক্তি— ২০১৮ সালের সুপ্রিম কোর্টের সবুজ বাজি সংক্রান্ত নির্দেশে শব্দমাত্রা নিয়ে কোনও কিছু বলা নেই, শুধুমাত্র কেন্দ্রীয় পরিবেশ সংস্থা নিরি-কে এ ধরনের বাজি তৈরির দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। যে-হেতু নিরি ১২৫ ডেসিবেলের শব্দবাজি তৈরি করে, তাই এ রাজ্যেও সেই নিয়ম হল।
সারা দেশে ১৯৯৯ সাল থেকে ১২৫ ডেসিবেল সর্বোচ্চ বাজি ফাটানোর শব্দসীমা থাকলেও, রাজ্যে তা সব সময়ই ৯০ ছিল এবং গত দু’দশকে বহু বার এর বিরুদ্ধে বাজি ব্যবসায়ীরা আদালতে আবেদন করলেও তা প্রায় প্রত্যেক বারই নাকচ হয়ে যায়। গোটা দেশে বাজির শব্দমাত্রা ১২৫ ডেসিবেল হলেও পশ্চিমবঙ্গে তা ৯০ ডেসিবেল থাকাটা কতটা যুক্তিযুক্ত? আইন, বিজ্ঞান, উভয়েই বলছে যুক্তি যথেষ্ট। দেশের পরিবেশ আইনের নিয়মাবলিতে স্পষ্ট বলা আছে, কোনও রাজ্য প্রয়োজনে কেন্দ্রীয় পরিবেশ আইন এবং দূষণের মাপকাঠিকে কঠিন করতে পারবে। ঠিক যে কারণে দিল্লি সরকার সবুজ বাজিকেও সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করলে তা সুপ্রিম কোর্টের স্বীকৃতি পায়, বা আগে এ রাজ্যে শিল্পদূষণের জন্য কেন্দ্রীয় আইনের থেকে কঠিন মাপকাঠি দূষণ পর্ষদ স্বচ্ছন্দে করতে পেরেছিল। বস্তুত সেপ্টেম্বর, ২০০০ সালে কেন্দ্রীয় পরিবেশ দফতর চিঠি দিয়ে জানায় যে, রাজ্য দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের স্থির করা ৯০ ডেসিবেল সম্পূর্ণ আইনসম্মত। পাশাপাশি এ-ও মনে রাখতে হবে, সুপ্রিম কোর্টের ২০১৮ সালের বাজির রায়টি মূলত ছিল বায়ুদূষণের উপর ভিত্তি করে, সেখানে শব্দসীমা মূল আলোচনায় ছিল না।
বিজ্ঞান বলছে, শব্দমাত্রা স্থির করা উচিত কত জন, কতটা, কত ক্ষণ শুনতে পাচ্ছেন, তার সম্মিলিত হিসাবনিকাশ করার পর। ২০১১-র জনগণনা অনুযায়ী, পৃথিবীতে ৫০টি সর্বোচ্চ জনবহুল শহরের মধ্যে ১২টির ঠিকানা পশ্চিমবঙ্গ। এ রাজ্যে জনঘনত্ব সারা দেশের গড়ের প্রায় তিন গুণ। স্পষ্টতই এক্সপোজার বা শব্দদূষণে আক্রান্ত হওয়ার প্রশ্নে এ রাজ্যের মানুষের বিপন্নতা অনেক বেশি। পাশাপাশি মূলত অপরিকল্পিত বৃদ্ধি এবং শহরাঞ্চলে সবুজ ও ফাঁকা জায়গা কম থাকার কারণে সে বিপন্নতা আরও তীব্র হয়। কালীপুজো বা দেওয়ালির দিন এই শহর ও রাজ্যে যে ভাবে গভীর রাত অবধি মুহুর্মুহু বাজি ফাটে, তার তুলনা দেশে কোথাও নেই।
মনে রাখতে হবে, কয়েক বছর আগে জাতীয় পরিবেশ আদালতের নির্দেশে দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের নিজেরই তৈরি এক বিশেষজ্ঞ কমিটি স্পষ্ট বলেছিল যে, ৯০ ডেসিবেলের উপর শব্দমাত্রা গেলে সাধারণ মানুষের শারীরিক সমস্যা বাড়ে; এবং সেই সিদ্ধান্তকে আদালতে জানিয়ে সে সময় পর্ষদ ৯০ ডেসিবেল শব্দমাত্রা বজায় রাখার নির্দেশ দিয়েছিল। মাত্র সাত মাস আগে পর্ষদ সভাপতি সাংবাদিক সম্মেলনে স্পষ্ট বলেছিলেন, তাঁরা নিরি-কে নির্দেশ দিয়েছেন পশ্চিমবঙ্গের জন্য ৯০ ডেসিবেলের মধ্যে থাকে, শুধুমাত্র এমন সবুজ বাজি তৈরি করার। হঠাৎ কী এমন ঘটল যে, পর্ষদকে নিজের দেওয়া ৯০ ডেসিবেলকেই বাতিল করে ১২৫ ডেসিবেল-এর জন্য সওয়াল করতে হল? কোন বিশেষ কারণে সুপ্রিম কোর্টের পাঁচ বছর পুরনো নির্দেশ মানা হচ্ছে না বলে আজ বোধোদয় হল পর্ষদ ও প্রশাসনের?
পরিবেশবিদরা বলছেন যে, বাজির শব্দসীমা শিথিল করাটা ব্যতিক্রম নয়। এ রাজ্যে গত কয়েক মাস ধরেই একের পর এক সিদ্ধান্ত হচ্ছে বাজির পক্ষে। সবুজ বাজি রাজ্যে বিশেষ তৈরি না হলেও সবুজ বাজির বাজার বসছে। বিশেষ নজরদারি নেই, প্রশাসন প্রায় যত্রতত্র বাজি বিক্রির অনুমতি দিচ্ছে— তালিকা দীর্ঘ। অভিযোগ, পুরো বিষয়টাই ঘটছে এক শ্রেণির বাজি ব্যবসায়ীর স্বার্থরক্ষার্থে, যাঁদের সাহায্য করছেন কিছু রাজনৈতিক নেতা ও প্রশাসনের একাংশ।
কেন্দ্রীয় সরকারও দায়িত্ব এড়াতে পারে না। কেন্দ্রীয় সরকারের বিশেষজ্ঞ কমিটি ২০০২ সাল থেকে ১২৫-এর শব্দসীমা কমাতে বললেও আজ অবধি কিছু হয়নি, কাজ হয়নি সবুজ বাজির নির্দেশ দিতে গিয়ে সুপ্রিম কোর্ট বায়ুদূষণ কমানোর পাশাপাশি ‘শব্দ কমানো’র কথা বললেও। শব্দসীমা শিথিল করা নিয়ে চাপানউতোর চলবে। কিন্তু সাধারণ মানুষ ও আইনভঙ্গকারীদের কাছে সঙ্কেত গেল যে, শব্দ নিয়ে রাজ্য প্রশাসনের বিশেষ মাথাব্যথা নেই। এটাই বেশি চিন্তার। আগামী দীপাবলিতে নিদারুণ শব্দযন্ত্রণাই হয়তো আমাদের ভবিতব্য।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy