সম্প্রতি কেন্দ্রীয় সরকার যে পরিসংখ্যান প্রকাশ করেছে, তাতে দেখা গেছে যে, পশ্চিমবঙ্গের গ্রামাঞ্চলে খুচরো মূল্যবৃদ্ধির হার সর্বোচ্চ।
নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসের দাম যে ভাবে প্রায় প্রতি দিন বেড়ে চলেছে, তাতে ধনী-নির্ধন নির্বিশেষে সবাই বিপর্যস্ত। দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে ধারাবাহিক ভাবে শাসকের আশ্বাস, বিরোধীদের সমালোচনা, একের পর এক আইন প্রণয়ন কিংবা সংশোধন, সবই নিষ্ফল প্রমাণিত হয়েছে।
সম্প্রতি কেন্দ্রীয় সরকার যে পরিসংখ্যান প্রকাশ করেছে, তাতে দেখা গেছে যে, পশ্চিমবঙ্গের গ্রামাঞ্চলে খুচরো মূল্যবৃদ্ধির হার সর্বোচ্চ। বাজারে জিনিসের সরবরাহ কমলে দাম বাড়ে বটে, কিন্তু আমাদের দেশে এবং অবশ্যই আমাদের রাজ্যে সরবরাহে ঘাটতি সর্বদা উৎপাদন-নির্ভর নয়। উদাহরণ হিসেবে চালের কথাই ধরা যাক। ২০২০ সালের এক রিপোর্ট অনুযায়ী পশ্চিমবঙ্গ চাল উৎপাদনে সারা ভারতে প্রথম। কিন্তু এই রাজ্যেই গত দু’বছরে চালের দাম প্রবল ভাবে বেড়েছে।
আলুর ক্ষেত্রেও একই অবস্থা। ২০২২-এর মার্চ-এপ্রিল নাগাদ, অর্থাৎ চাষির ঘরে যত দিন নবোৎপাদিত আলু ছিল, দাম ছিল ১০ থেকে ১২ টাকার মধ্যে। অথচ সেই আলু হিমঘরে ঢুকে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আলুর দাম বাড়তে বাড়তে তিন-চার মাসের মধ্যে জ্যোতি আলু ৩০-৩২ টাকা ও চন্দ্রমুখী আলু ৪০ টাকা ছুঁয়েছে। অথচ এখনও হিমঘরে এত আলু মজুত আছে যে, ৩০ নভেম্বর পর্যন্ত ভাড়া নেওয়া হিমঘরের সময়সীমা ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত বাড়ানোর আর্জি জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা।
আনাজ উৎপাদনে এ রাজ্য যথেষ্ট এগিয়ে থাকলেও, যতই ‘ডাইরেক্ট সেলিং’-এর ঢক্কানিনাদ বাজুক না কেন, কৃষকরা তাঁদের উৎপাদিত আনাজপত্র মান্ডিতে সরাসরি বিক্রি করতে পারেন না। সেখানেও মধ্যস্বত্বভোগীদের দাপাদাপি। ফলে এক দিকে যেমন কৃষক তাঁর ফসলের ন্যায্য মূল্য থেকে বঞ্চিত হন, তেমন ক্রেতারাও অনেক বেশি দাম দিতে বাধ্য হন।
সম্প্রতি বাজারে একটা চালু মত হল, পেট্রল এবং ডিজ়েলের দাম যথাক্রমে ৩৬% এবং ৪০% বৃদ্ধির জন্যেই জিনিসপত্রের দাম আকাশ ছুঁয়েছে। পণ্য সামগ্রীর খুচরো বিক্রয়মূল্যের সঙ্গে পরিবহণ খরচের প্রত্যক্ষ যোগ অবশ্যই আছে, কিন্তু তা কতটুকু? কোনও পণ্য উৎপাদনস্থল থেকে ক্রেতার হাতে পৌঁছনো পর্যন্ত পরিবহণ খরচ নির্ভর করে দূরত্বের উপরে। তর্কের খাতিরে যদি ধরেও নেওয়া হয় যে, সেই খরচ ওই পণ্যের খুচরো দামের ১০%, তা হলে জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধির কারণে খুচরো দাম বাড়ার কথা ৩.৬% থেকে ৪%। অথচ চাল, ডাল, আটা, ভোজ্য তেল, মাছ-মাংস’সহ নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের মূল্যবৃদ্ধির হার এর কয়েকগুণ।
অনেকে মনে করেন, আমাদের রাজ্যে এই নিয়ন্ত্রণহীন মূল্যবৃদ্ধির নেপথ্যে ফড়ে, দালাল, সিন্ডিকেট এবং তোলাবাজি অনেকাংশে দায়ী। কথাটাকে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। তবে, এ কথাও সত্যি যে, সাম্প্রতিক কালে দেশের কয়েকটি আইনের পরিবর্তন এবং সংশোধনও এই মূল্যবৃদ্ধির জন্যে কম দায়ী নয়। ২০২০ সালে ‘আত্মনির্ভর ভারত অভিযান’ প্রকল্পের হাত ধরে অত্যাবশ্যক পণ্য আইন, ১৯৫৫-তে বেশ কিছু উল্লেখযোগ্য সংশোধনী পাশ হয়। এই সংশোধনী অনুযায়ী, চাল, ডাল, আলু, পেঁয়াজ, তৈলবীজ, ভোজ্য তেলের মতো কৃষিজ পণ্যকে অত্যাবশ্যক পণ্যের আওতা থেকে বাদ দেওয়া হয়। সেই সময়ে সরকারের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছিল, এর ফলে কৃষিক্ষেত্রে বিনিয়োগ বাড়বে এবং কৃষকরা লাভবান হবেন। ভারতের মতো ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষকের দেশে এই সংশোধনীর ফলে কৃষকরা কতটা লাভবান হয়েছেন, তা বলা শক্ত। তবে, ২০২২ সালে দেশে প্রতি দিন গড়ে ৩০ জন করে কৃষক আত্মহননের পথ বেছে নিয়েছেন, যা আগের তুলনায় অনেকটাই বেশি। অপর পক্ষে, উপভোক্তাদের উপরে এই সংশোধনী অভিশাপের মতো নেমে এসেছে। ওই সব কৃষিজ পণ্যের মজুতের ঊর্ধ্বসীমা উঠে যাওয়ায় বাজারের নিয়ন্ত্রণ চলে গিয়েছে কতিপয় বিত্তশালী মজুতদারের হাতে। সরবরাহ নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে কৃত্রিম ভাবে খাদ্যসামগ্রীর দাম বাড়ানো হলেও আমজনতার হাত কামড়ানো ছাড়া গত্যন্তর নেই।
এখানে ওজন ও পরিমাপ সংক্রান্ত আইনটির বার বার সংশোধনের কথাও উল্লেখ করা যেতে পারে। ‘স্ট্যান্ডার্ড অব ওয়েটস অ্যান্ড মেজারস (প্যাকেজড কমোডিটিজ়) রুলস, ১৯৭৭’ অনুযায়ী শিল্প ও গবেষণায় ব্যবহার্য ব্যতিরেকে অনূর্ধ্ব ২৫ কিলোগ্রাম পর্যন্ত ‘প্যাকেজড কমোডিটি’-র মোড়কের ভিতরের সামগ্রীর ওজন, পরিমাণ কিংবা সংখ্যা সুনির্দিষ্ট করা ছিল। যেমন, ১ কেজি, ৫০০ গ্রাম, ২০০ মিলিলিটার ইত্যাদি। ২০১১ সালে এই আইন প্রত্যাহার করে যে ‘লিগাল মেট্রোলজি (প্যাকেজড কমোডিটিজ়) রুলস, ২০১১’ কার্যকর করা হল, তাতে মোড়কের মধ্যেকার সামগ্রীর নির্দিষ্ট পরিমাণের বাধ্যবাধকতা তুলে দিয়ে যে কোনও ওজন বা পরিমাপের প্যাকেজ আইনসিদ্ধ করা হল। শুধু সে ক্ষেত্রে ওই মোড়কের উপর ‘নন-স্ট্যান্ডার্ড’ প্যাক সম্পর্কিত একটি ঘোষণা লিখতে হত। ২০১৬ সালে এই আইনে আরও একটি সংশোধনী এনে উৎপাদক বা মোড়ককারীকে ‘নন-স্ট্যান্ডার্ড প্যাক’ সম্পর্কিত ঘোষণা লেখা থেকেও অব্যাহতি দেওয়া হল। ফলে এখন যে কোনও ওজন বা পরিমাপের প্যাকেজ আইনসিদ্ধ, শুধু মোড়কের ভিতরের সামগ্রীটির ‘ইউনিট সেল প্রাইস’ বা ‘একক বিক্রয়মূল্য’ জানানোটা বাধ্যতামূলক।
এই সংশোধনীর বলে দাম অপরিবর্তিত রেখে উৎপাদক বা মোড়ককারীরা মোড়কের ভিতরের সামগ্রীর পরিমাণ ইচ্ছেমতো কমিয়ে দেওয়ার অবাধ ছাড়পত্র পেয়ে গিয়েছেন। ক্রেতা জানতেই পারছেন না, দাম একই থাকলেও প্যাকেট ছোট হয়ে গেছে। ১০০ গ্রামের সাবানটি ৭০ গ্রাম, ৫ কেজির আটার প্যাক ৪.৫ কেজি, ১০০ গ্রামের ক্রিম ৮০ গ্রাম কিংবা দেশলাইয়ের প্যাকেটে কাঠির সংখ্যা ৫০ থেকে ২৫-এ নেমে গিয়েছে। প্রস্তুতকারকরা জানেন, বেশির ভাগ ক্রেতা দাম এবং পরিমাণ খুঁটিয়ে দেখার মতো সচেতন নন। আর সচেতন হলেও কিছু লাভ নেই, কারণ দেশের আইনই তাঁদের এই বিভ্রম সৃষ্টির অবাধ স্বাধীনতা দিয়েছে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy