নিরাশ্রয়: পঞ্চায়েত নির্বাচনে হিংসার পর, বারুইপুরে। ১৯৯৩ সালের ছবি।
এক সময়ের সাড়া জাগানো একটি বই, বন্যার পর বাড়ি ফেরা। মফস্সল শহরের সব কিছু ভেসে গেছে, তার পরও জীবন শুরু হয়, এই নিয়ে আখ্যান। বন্যার পর বাড়ি ফেরা যায়, কিন্তু নির্বাচনের পর বাড়ি ফেরা হয় না অনেকের। বিরোধী দলের অফিসে বিছানা পেতে শুয়ে ঘরছাড়া দলীয় কর্মী, পঞ্চায়েতে জয়ী প্রার্থী, তাঁদের পরিবার। কবে ফিরবেন জানেন না। গত বার পঞ্চায়েত নির্বাচনের পর বাড়ি ফিরতে অনেকের বছর ঘুরেছিল, কারও আরও বেশি। এ বার?
পশ্চিমবঙ্গে এ হয়তো নতুন নয়, ১৯৭২-এর বিধানসভা নির্বাচনের পর বামপন্থী কর্মীরা অনেকেই বাড়ি ফিরতে পারেননি বছরের পর বছর। ১৯৬৭ থেকে ১৯৭২ পর্যন্ত, পশ্চিমবঙ্গে কংগ্রেস শাসনের পতন ও পরবর্তী বছরগুলিতে সরকার গঠন ও পতনের নৈরাজ্য চলছিল, চলছিল নকশালপন্থী অতিবিপ্লবী হত্যা ও পাল্টা হত্যার চক্র। ১৯৭২-এ রাষ্ট্রপতি শাসনের সু্যোগ নিয়ে পশ্চিমবঙ্গে বিধানসভা নির্বাচন হল কংগ্রেস নিয়ন্ত্রিত গুন্ডাবাহিনী দিয়ে। ফলে ১৯৭১-এর নির্বাচনে ১১৩টি আসন জয়ী সিপিএম ’৭২-এ পেল মাত্র ১৪টি আসন, শোচনীয় ভাবে হারলেন জ্যোতি বসু। ইন্দিরা কংগ্রেস পেল ২১৬টি আসন, সহযোগী সিপিআই পেল ৩৫টি। এই ভয়ঙ্কর নির্বাচনী জুয়াচুরির পর, পরের পাঁচ বছর সিপিএম বিধানসভায় যোগদান করেনি। কিন্তু কংগ্রেস পশ্চিমবঙ্গে নির্বাচন জেতার জন্য ব্যাপক সন্ত্রাসের অস্ত্র ব্যবহারের পথটি দেখিয়ে দিল। এই আধা-সরকারি সন্ত্রাসে নকশালপন্থীরা নিশ্চিহ্ন হল, নির্বাচনের পর আর বাড়ি ফেরা হয়নি হাজার হাজার বামপন্থী কর্মীর।
১৯৭৭-এ দেশে জরুরি অবস্থা প্রত্যাহারের পর মার্চে জাতীয় নির্বাচনে কংগ্রেস কেন্দ্রে শাসনক্ষমতা হারালে পশ্চিমবঙ্গে নির্বাচন হয় জুনে। কংগ্রেসের এই দুঃসময়ে পাঁচ বছর পরে ভগ্ন সাংগঠনিক অবস্থা নিয়েও সিপিএম নেতৃত্বের বামফ্রন্ট ২২৯ আসন নিয়ে পশ্চিমবঙ্গে শাসন শুরু করে। কিন্তু তার পর চৌত্রিশ বছর সেই শাসন চালু রাখতে তারা কংগ্রেসের সন্ত্রাসের শিক্ষাকেই অস্ত্র করেছে। কমিউনিস্ট আদর্শে অবশ্য হিংসার জোরে ক্ষমতা দখল ও বহাল রাখার প্রয়োজনীয় মার্ক্সবাদী তত্ত্ব রয়েছে, ফলে সেটির প্রয়োগে তাদের তাত্ত্বিক বা আত্মিক কোনও অসুবিধা হয়নি। বামফ্রন্ট শাসনে প্রধান গণহত্যাগুলিতে— মরিচঝাঁপি থেকে নন্দীগ্রাম— আপাতত প্রবেশ না করে কেবল পঞ্চায়েত নির্বাচন দেখলেই যথেষ্ট। এ বারের পঞ্চায়েত নির্বাচনের সঙ্গে গত দু’দশকের পঞ্চায়েত নির্বাচনগুলির শেষ পর্যন্ত খুব একটা তফাত নেই। বেসরকারি হিসাবে বামফ্রন্ট আমলে ২০০৩ ও ২০০৮-এর পঞ্চায়েত নির্বাচনে ৮০ জন ও ৪৫ জন নিহত হন। ক্ষমতায় এসে তৃণমূল কংগ্রেস সেই হিংসার ধারাই বজায় রেখেছে। তৃণমূল শাসনে ২০১৩-র পঞ্চায়েত নির্বাচনে নিহত হন ৩১ জন, ২০১৮-তে ৭৫ জন। এ বার মৃত্যুর সংখ্যা ইতিমধ্যেই ষাটে পৌঁছেছে। ২০১৮-তে বিনা নির্বাচনে তৃণমূল কংগ্রেস ৩৩ শতাংশ আসন জিতেছিল, এ বার তা কমে হয়েছে ১১ শতাংশ, এ-ই যা তফাত।
কেন এত রাজনৈতিক হিংসা? সারা ভারতে বিভিন্ন নির্বাচন হয়ে চলেছে, তেমন হিংসার খবর নেই। এমনকি কুখ্যাত বিহার-উত্তরপ্রদেশও গুড বয় হয়ে গেছে। দুর্নীতি সারা দেশে সব দলেই রয়েছে, সে জন্য সারা দেশে নির্বাচনে হিংসা ঘটছে না। অনেকে বলছেন, পশ্চিমবঙ্গে উন্নয়নের অভাবই হিংসার কারণ, গরিব মানুষ সামান্য কিছু পাওয়ার জন্য হিংস্র হয়ে উঠছে। নীতি আয়োগ প্রকাশিত (২০২২) সমীক্ষায় বহুমুখী দারিদ্র সূচকের (লিভিং বিলো মাল্টিডাইমেনশনাল পভার্টি ইন্ডেক্স) নীচে পশ্চিমবঙ্গে বাস করছেন ২১.৭ শতাংশ, জাতীয় গড়ের (২১.৯২) সামান্য উপরেই। ওড়িশা (২৯.৩৫), রাজস্থান (২৯.৪৬), ছত্তীসগঢ় (৩৯.০৩), মধ্যপ্রদেশ (৩৬.৬৫) আরও অনেক নীচে, অথচ সেখানে এ ধরনের নির্বাচনী হিংসা হচ্ছে না। ফলে অনুন্নয়নের যুক্তিটি জোরালো নয়।
তা হলে বামফ্রন্ট হেরেছিল কেন? বামফ্রন্ট ক্ষমতায় এসেছিল এক বিশেষ সময়ের কল্যাণে। আর হেরেছিল চৌত্রিশ বছরের অপশাসনের ভারে ও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো বিরোধী নেত্রীর অবিচল সংগ্রামী ভূমিকায়। মানুষ কোনও উন্নত সমাজ, নীতি, আদর্শের জন্য তৃণমূল কংগ্রেসকে ভোট দেয়নি, ভোট দিয়েছিল বাম অপশাসন সহ্যেরও সীমা পেরিয়ে যাওয়ায়। এর জন্য মূল্য দিতে হয়েছে চৌত্রিশ বছর, তার আগে কংগ্রেস বিদায় নিয়েছিল ত্রিশ বছর পর। কেবল শাসক দলের অপশাসনে সরকার পতনের অপেক্ষায় তা হলে কি আরও কুড়ি-কুড়ি বছর কাটাতে হবে? ২০৪১-এর আগে বাড়ি ফেরা যাবে না?
এমন এক ভাগ্য-নির্ধারিত রাজ্যে বিরোধীদের বেঁচে থাকতে হয় আশায়, আর কিছু সত্যকে এড়িয়ে। পঞ্চায়েত নির্বাচনের ফল ঘোষণা শেষে প্রধান বিরোধী দলের প্রতিক্রিয়ায় রবীন্দ্রনাথের ‘জীবিত ও মৃত’-র কাদম্বিনীর কথা মনে এল, দল হারিয়া প্রমাণ করিল সে হারে নাই। রাজ্য নেতৃত্ব অভিনন্দন জানিয়েছে দলের আসন দ্বিগুণ হওয়ার জন্য, সর্বোচ্চ নেতৃত্ব অভিনন্দন জানিয়েছে দলের ভাল ফলে। প্রায়-ডুবন্ত সিপিএম-কংগ্রেস জোটও খুশি, তাদের জোটের আসন বিজেপির থেকে খুব দূরে নয়। তবে ২০১৮-তে প্রবল হিংসার সময় বিজেপি পঞ্চায়েতে ভোট পেয়েছিল প্রায় ২১ শতাংশ, ২০১৯-এ মোদী হাওয়ায় বেড়ে হয় লোকসভায় ৪১ শতাংশ, ২০২১-এ বিধানসভা নির্বাচনে ৩৮ শতাংশ এবং ২০২৩-এর পঞ্চায়েত নির্বাচনে তা কমে দাঁড়িয়েছে ২২ শতাংশে। অর্থাৎ জনসমর্থন কমেই চলেছে। যে ৭৬২টি বুথে পুনর্নির্বাচন হয়েছে সেখানেও তৃণমূলের জয় ৬২ শতাংশ আসনে। এই সব সত্য এড়িয়ে লাভ নেই।
হিংসা আর দারিদ্রকে গুলিয়ে দিয়ে আর একটি সত্যকে মনে হয় এড়িয়ে যাওয়া হচ্ছে। প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী পঞ্চায়েত নির্বাচনের সময় ৫০ জন নিহত হয়েছেন (পরে বেড়েছে, এই আলোচনায় তা অন্তর্ভুক্ত নয়)। দলীয় হিসাবের বাইরে এসে এই নিহতদের মধ্যে ৩২ জন (৬৪%) এক বিশেষ সম্প্রদায়ের। এই ৫০ জনের মধ্যে ৩৭ জনের (৭৪%) মৃত্যু হয়েছে মূলত এই জেলাগুলিতে (মুর্শিদাবাদ, দুই ২৪ পরগনা, উত্তর দিনাজপুর, মালদহ, নদিয়ার উত্তরাংশে)। আরও বলার, এই সব মৃত্যুর প্রায় সবই বোমা বা আগ্নেয়াস্ত্রের দ্বারা। ফলে শুধু নির্বাচন বা গণতন্ত্র নয়, এই বোমা-বন্দুকের শক্তির সামনে আগামী দিনের পশ্চিমবঙ্গের অস্তিত্বের প্রশ্নটিও সরিয়ে রাখা যাচ্ছে না।
তা হলে বিরোধীরা কি আরও কুড়ি বছর বসে থাকবেন, নির্বাচন-জ্যোতিষীদের দুয়ারে ঘুরবেন? কিছু কি নতুন ভাবা যায়? বামপন্থীদের সঙ্গে কোনও আলোচনা অর্থহীন, কারণ ‘মার্ক্সবাদ একটি সত্য’ সেই কষ্টিপাথর ওঁদের ঝোলায় আছে। পশ্চিমবঙ্গে কংগ্রেসের অস্তিত্ব ইলেকট্রন কণার মতো অনিশ্চিত, উপস্থিতি টের পেলেও মতিগতি বোঝা ভার। পড়ে রইল জনগণ ও বাকি বিরোধীরা। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের মানুষকে সঙ্গে পেতে হলে পশ্চিমবঙ্গকে জানতে হবে, জানা মানে তার সমাজ, ইতিহাস, সংস্কৃতি, শিক্ষা, শিল্প-সাহিত্য, রাজনীতি, অর্থনীতি সব কিছুই। এ সবের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সংগঠন, মানুষের সঙ্গে কাজকর্মে জড়িত থাকতে হবে। বামপন্থীরা কেবল শাসকের দুর্নীতি বা আইনি মারপ্যাঁচে বা মাঠের লড়াইয়েই ব্যস্ত থাকেননি, চিন্তার লড়াইটাও জারি রেখেছিলেন। মাঠের লড়াইয়ের কমরেডদের চোখে তা কিছু স্বপ্ন এঁকে দিয়েছিল। আজকের প্রধান বিরোধী পদাতিকেরা শুধু জানে তৃণমূল কংগ্রেস খারাপ, এটুকুই। পশ্চিমবঙ্গের মানুষকে কোনও নতুন কথা, নতুন স্বপ্ন এঁরা জানাতে পারেননি। কেবল অনুদান, দুর্নীতির বাইরেও পশ্চিমবঙ্গের মানুষের অন্য সমস্যা, অন্য আকাঙ্ক্ষা আছে। এর জন্য প্রয়োজন নতুন কিছু ভাবনা, নতুন স্লোগান, নতুন প্রতীক।
আর তা খুঁজতে হবে বাংলার মাটিতেই, যমুনাপাড় থেকে পাঠানো সুবেদারদের দ্বারা তা সম্ভব নয়। তা না হলে নির্বাচনের পরে বাড়ি ফেরা দুরাশাই মনে হবে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy