Advertisement
২৪ নভেম্বর ২০২৪
বিপজ্জনক প্রশ্নের মুখে পড়লে নীরব থাকাই প্রধানমন্ত্রীর কৌশল
Narendra Modi

‘উত্তরে থাকো মৌন’

নরেন্দ্র মোদীর দুই প্রধান রাজনৈতিক অস্ত্র হল তাঁর ব্যক্তিগত দুর্নীতিমুক্ত স্বচ্ছ ভাবমূর্তি এবং দেশের নিরাপত্তার নামে উগ্র জাতীয়তাবাদ।

Opposition MPs.

মুখর: সংসদের বাজেট অধিবেশনে আদানি গোষ্ঠী-কাণ্ডের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে শামিল বিরোধী সাংসদরা, নয়া দিল্লি, ২৭ মার্চ। পিটিআই।

প্রেমাংশু চৌধুরী
শেষ আপডেট: ১৩ এপ্রিল ২০২৩ ০৫:৫৩
Share: Save:

মাস ফুরোলেই সেঞ্চুরি। শততম পর্ব। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর ‘মন কি বাত’-এর কথা হচ্ছিল আর-কি! সেই ২০১৪ সালের ৩ অক্টোবর থেকে শুরু হয়েছিল প্রতি মাসের শেষ রবিবার সকালে প্রধানমন্ত্রীর বেতার-বার্তা। গত ন’বছরে হেন কোনও বিষয় নেই, যা নিয়ে প্রধানমন্ত্রী ‘মন কি বাত’-এ তাঁর মনের কথা ব্যক্ত করেননি— সরকারের কাজকর্মের কথা বলেছেন; নিজের নানা অভিজ্ঞতা শুনিয়েছেন; বিবিধ বিষয়ে উপদেশ দিয়েছেন; কিছু ক্ষেত্রে নিজের হতাশাও লুকিয়ে রাখেননি।

তা বলে কি সব বিষয়েই নিজের মনের কথা বলেছেন প্রধানমন্ত্রী? না। বিশেষত যে সব বিষয়ে তাঁর ও সরকারের সমালোচনা হয়েছে, বিরোধীরা জবাব চেয়েছেন, বা যে সব প্রশ্নে দেশ জুড়ে বিতর্ক চলেছে— তা নিয়ে প্রধানমন্ত্রী নীরব থেকেছেন। শুধু বেতার-বার্তায় নয়, ও-সব বিষয়ে সংসদের ভিতরে, বাইরে, সরকারি অনুষ্ঠান বা জনসভাতেও তিনি নীরবতা বজায় রেখেছেন। এখন যেমন প্রধানমন্ত্রী আদানি-কাণ্ড নিয়ে নীরব। যেমন, গত তিন বছর ধরে তিনি লাদাখে চিনের ভারতীয় জমি দখল নিয়ে নীরব। চিনের সেনার সঙ্গে সংঘর্ষে ভারতীয় জওয়ানদের মৃত্যু হলেও তিনি মুখ খোলেননি। বিরোধীদের শত প্রশ্ন, সহস্র কটাক্ষও তাঁর সেই নীরবতা ভঙ্গ করতে পারেনি।

এই নীরবতা রাজনীতির অন্যতম কৌশল, যাকে বলে ‘নীরবতার রাজনীতি’। মুখ বন্ধ রেখে কোনও প্রশ্ন যেমন এড়িয়ে যাওয়া যায়, তেমনই নীরব থেকে বিরোধীদের অভিযোগকে অপ্রাসঙ্গিক বা খাটো করে দেখানোর চেষ্টা করা যায়। নীরবতা এ ক্ষেত্রে সম্মতির লক্ষণ নয়। নরেন্দ্র মোদী তাঁর রাজনৈতিক জীবনে বরাবরই এই কৌশল প্রয়োগ করে সফল হয়েছেন। তিনি কোন ময়দানে লড়বেন, সেটা তিনি নিজেই ঠিক করেন। কোথাও বিরোধীদের দুরমুশ করার সুযোগ পেলে তিনি মাঠে নামতে দেরি করেন না। কোথাও বেগতিক দেখলে আবার মাঠেই নামেন না। যেখানে তিনি ফাঁদে পড়ে যেতে পারেন বা বলার মতো জোরালো কিছু নেই, সেখানে চুপ থাকেন। মুখ বন্ধ রেখে সঠিক সময়ের অপেক্ষা করেন। অথচ ওই একই সময়ে তিনি অন্য সব বিষয়ে কথা বলতে থাকেন।

নরেন্দ্র মোদীর দুই প্রধান রাজনৈতিক অস্ত্র হল তাঁর ব্যক্তিগত দুর্নীতিমুক্ত স্বচ্ছ ভাবমূর্তি এবং দেশের নিরাপত্তার নামে উগ্র জাতীয়তাবাদ। আদানি-কাণ্ড ও চিনের জমি দখলের ক্ষেত্রে দুই অস্ত্রই প্রশ্নের মুখে। তাঁর বহু দিনের ঘনিষ্ঠ শিল্পপতি গৌতম আদানির সংস্থার বিরুদ্ধে শুধু যে প্রতারণার অভিযোগ উঠেছে, তা নয়— সব দেখেও মোদী সরকার চোখ বুজে ছিল বলে অভিযোগ উঠেছে। খোদ প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে আদানিকে নানা সুবিধা পাইয়ে দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে।অথচ প্রধানমন্ত্রী একটি কথাও বলেননি। কেউ বেআইনি কাজ করে থাকলে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা হবে— এমন সাধারণ মন্তব্যও করেননি। দাবি করেননি যে, তাঁর সঙ্গে আদানির ব্যক্তিগত পরিচয় থাকলেও তিনি তাঁকে কোনও বিশেষ সুবিধা পাইয়ে দেননি। চিনের প্রশ্নেও প্রধানমন্ত্রী একই রকম মৌন। পাকিস্তানের বেলায় ‌তিনি ঘরে ঢুকে মারার হুঁশিয়ারি দিয়ে থাকেন। চিনের বেলায় ‘চ’ শব্দও তাঁর মুখে শোনা যায়নি। এক বারই মুখ্যমন্ত্রীদের সামনে তিনি বলেছিলেন, ভারতের এলাকায় কেউ ঢোকেনি, কেউ ঢুকে বসেও নেই। তাতে চিনের জমি দখলেই সিলমোহর পড়ে যায় দেখে প্রধানমন্ত্রীর দফতরকে সেই মন্তব্য শোধরাতে হয়েছিল।

নরেন্দ্র মোদীর ক্ষেত্রে এই নীরবতা স্বাভাবিক ভাবেই বেশি কানে বাজে। কারণ দেশের হালফিলের রাজনীতিকদের মধ্যে বাক্‌পটুত্বে তাঁর জুড়ি মেলা ভার। মনমোহন সিংহের মতো তিনি কদাচিৎ মুখ খোলেন, এমন নয়। সপ্তাহের সাত দিনের মধ্যে পাঁচ দিনই তিনি কোনও না কোনও অনুষ্ঠানে বক্তৃতা করে থাকেন। ২০১৪-র লোকসভা নির্বাচনের প্রচারে তিনি মনমোহন সিংহকে ‘মৌন-মোহন’ বলে কটাক্ষ করেছিলেন। অথচ তিনি নিজে প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পরে দেখা গেল, সাংবাদিক সম্মেলনে প্রশ্নের মুখোমুখি হওয়াই বন্ধ করে দিলেন। সংবাদমাধ্যমকে এড়িয়ে সরাসরি মানুষের সঙ্গে কথা বলার পন্থা নিলেন। সেখানেও স্পর্শকাতর বিষয়ে নীরবতা বজায় রাখলেন। গণতন্ত্রে মানুষের কাছে জবাবদিহি করাটাই যে স্বাভাবিক দায়িত্ব, সেটা তিনি বেমালুম ভুলিয়ে দিলেন।

গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রী থাকার সময় থেকেই নরেন্দ্র মোদী নীরবতাকে শুধু ঢাল নয়, হাতিয়ার হিসাবে কাজে লাগিয়েছেন। গুজরাতের দাঙ্গা নিয়ে প্রশ্নের মুখে পাঁচ মিনিটের মধ্যে তাঁর সাক্ষাৎকার থেকে বেরিয়ে যাওয়ার ঘটনা সুবিদিত। তিনি প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পরেই ললিত মোদীর দেশ ছেড়ে পালানো, মধ্যপ্রদেশে ব্যপম কেলেঙ্কারি, ছত্তীসগঢ়ে রেশন দুর্নীতি নিয়ে কেন্দ্রে বিজেপি প্রশ্নের মুখে পড়েছিল। বিজয় মাল্যর দেশ ছেড়ে পালানো আটকাতে না-পারা থেকে নীরব মোদী-মেহুল চোক্সীদের সঙ্গে মোদীর ঘনিষ্ঠতার অভিযোগ উঠেছে। মোদী নীরব থেকেছেন। গোরক্ষক বাহিনীর দাপট, গণপ্রহারে মুসলমান-হত্যা, দলিতদের উপরে নির্যাতনের ক্ষেত্রেও একই নীরবতা। বিজেপির নেতা-মন্ত্রীরা সংখ্যালঘুদের পাকিস্তানে চলে যাওয়ার ‘পরামর্শ’ দিয়েছেন। মোদী মুখ খোলেননি। সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিদের মধ্যে থেকে মোদী সরকারের দিকে প্রভাব খাটানোর অভিযোগ উঠেছে। প্রধানমন্ত্রীর দফতরের অধীন সিবিআইয়ের সদর দফতরে দুই শীর্ষকর্তার মধ্যে গৃহযুদ্ধ বেঁধেছে। মোদী চুপ থেকেছেন। কৃষক আন্দোলনের সময় লখিমপুর খেরিতে তাঁর সরকারের মন্ত্রী-পুত্রের গাড়িতেই চাষিদের পিষে মারার অভিযোগ উঠেছে। প্রধানমন্ত্রী একটি শব্দও উচ্চারণ করেননি।

এই নীরবতার সঙ্গে তিনটি রাজনৈতিক কৌশল জড়িয়ে থাকে। এক, নিজেকে যাবতীয় দোষারোপের ঊর্ধ্বে রাখা; দুই, তুচ্ছ অভিযোগের জবাব দেওয়ার বদলে বৃহত্তর দায়িত্ব পালনে বা গুরুত্বপূর্ণ কাজে ব্যস্ত রয়েছেন বলে প্রমাণ করা; তিন, অনুকূল পরিস্থিতির জন্য অপেক্ষা করা।গোরক্ষক বাহিনীর দাপট নিয়ে নীরব থেকে মোদী বরাবরই নিজেকে এ সবের ঊর্ধ্বে রেখে, তাঁর সঙ্গে এ সবের যোগ নেই বলে দেখাতে চেয়েছেন। কোভিডের দ্বিতীয় ঢেউয়ের সময় গোটা দেশে মৃতদেহের স্তূপ তৈরি হচ্ছে, নদীতে শব ভাসছে, শ্মশানে শবদাহের জায়গা মিলছে না, অক্সিজেন থেকে ইনজেকশনের সঙ্কটে হাহাকার চলছে, তখন নরেন্দ্র মোদী নীরব থেকেছেন। কোভিডের প্রথম থেকেই বার বার টিভির পর্দায় উদয় হলেও এমন সঙ্কটের সময় হয় তিনি নীরব, নয় একেবারে অদৃশ্য থেকেছেন। বিজেপি নেতারা বলেছেন, প্রধানমন্ত্রী নীরবে নিজের কাজ করে চলেছেন। কোভিড পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক হতেই প্রধানমন্ত্রী প্রকাশ্যে এসে অতিমারি সামলানোর কৃতিত্ব নিতে অবশ্য দেরি করেননি।

গত ন’বছরে নীরবতাকে এমন রাজনৈতিক কৌশল হিসেবে ব্যবহার করার নজির খুব বেশি নেই। নরেন্দ্র মোদীর সাফল্য হল, তিনি চিন নিয়ে মুখ খুলছেন না বলে মানুষ তাঁকে ভিতু বলে ভাবতে শুরু করেছে এমন নয়। আদানি নিয়ে মুখ খুলছেন না বলে তিনি কিছু শিল্পপতিদের স্বার্থে সরকার চালাচ্ছেন বলে অভিযোগও মানুষ বিশ্বাস করছেন না। ২০১৯-এর আগে তাঁর বিরুদ্ধে রাফাল যুদ্ধবিমান কেনার সময় অনিল অম্বানীর সংস্থাকে বরাত পাইয়ে দেওয়ার অভিযোগ উঠেছিল। সেটাও রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা হ্যাল-কে বঞ্চিত করে। গত চার বছরে মোদী এ নিয়ে মুখ খোলেননি। দু’মাস আগে কর্নাটকে হ্যাল-এর হেলিকপ্টার কারখানার উদ্বোধন করতে গিয়ে মোদী বলেছেন, এত দিনে সব অভিযোগ মিথ্যা প্রমাণ হল!

যুদ্ধবিমানের বরাতের সঙ্গে অবশ্য হেলিকপ্টারের কারখানার সম্পর্ক নেই। প্রধানমন্ত্রী তবু তাকে হাতিয়ার করেই রাফাল নিয়ে মুখ খুলেছিলেন। আশা করা যায়, আদানি-কাণ্ড বা চিন নিয়েও তিনি কোনও এক দিন তাঁর সুযোগ-সুবিধামতো মৌনব্রত ভাঙবেন।

অন্য বিষয়গুলি:

Narendra Modi Adani Group China
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy