—প্রতীকী চিত্র।
বিধ্বস্ত সময়ের বিপন্নতা নিয়ে রাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে চিৎকার করছে এক জন। মঞ্চ বাঁধা হয়েছে, মাইক আছে তাতে। কিন্তু সেই মঞ্চের বিশ পা দূরে সারি সারি দোকানের কর্ণধাররা কেউ কথা শুনছেন না সেই বক্তার। এমন নয় যে তাঁদের সামনে তখন রাশি রাশি খরিদ্দার। বরং চত্বর রীতিমতো ফাঁকা। তবু সেই নির্জনতাও, প্রায় কাউকেই, দেশ ঠিক কতখানি বিপদের মধ্যে রয়েছে, তা শুনতে উৎসাহ জোগাতে পারছে না। তাঁরা শুনছেন, কিন্তু শুনছেন ছোট্ট একটা যন্ত্রের থেকে। খালি হাতে ছুড়ে দেওয়া বুলেট কিছুই করতে পারে না, তার সার্থক হওয়ার জন্য দরকার অন্তত একটি রিভলভার; কথাকেও যেন আজ কার্যকর হতে গেলে আসতে হবে মোবাইলের ভিতর দিয়ে ‘ফিল্টার্ড’ হয়ে। কিন্তু সত্যিই কি কথা পরিস্রুত হয়, মোবাইলের ভিতর দিয়ে মানুষের কানে যখন সে পৌঁছয়? না কি কান্নার সঙ্গে মিশে যায় উদগ্র কৌতূহল, বীভৎসতার মধ্যে থেকেও ডানা মেলে বিনোদন, প্রতিবাদের শরীরে ফুটে ওঠে প্রতিহিংসা?
দোকানে দোকানে মালিক এবং কর্মচারীরাও যে মোবাইলগুলোয় বুঁদ হয়ে আছে তাদের দিকে যদি একাগ্র হয়ে তাকাই তবে কী দেখব? দেখব, কোনও একটিতে মণিপুর জ্বলার কোনও ছবি। অন্য আর একটিতে তখনই ভেসে উঠছে বাংলা কোনও পোর্টাল, যেখানে দু’টি অসহায় মেয়েকে বিবস্ত্র করে মারধরের ভিডিয়ো ঝাপসা করে দিয়ে চালানো হয়েছে যাতে বোঝা না গেলেও খানিকটা বোঝা যায়। তৃতীয় একটি মোবাইলে তখনই আর একটি টিভি চ্যানেল দেখা যাবে, যারা উচ্চারণ করছে, “অ্যাজ় মণিপুর ভার্সেস মালদা প্লেজ় আউট।”
গা গুলিয়ে উঠলেও নিস্তার নেই, দেখতেই হবে সেই বাইনারি যেখানে অনেক জনপ্রতিনিধি মণিপুরের ঘটনা নিয়ে অবস্থানে বসেছেন, আবার আরও অনেকে ছত্তীসগঢ় কিংবা রাজস্থান নিয়ে বসেছেন ধর্নায়। ওই অবস্থান আর পাল্টা অবস্থানের সূত্রে, চ্যানেলে চ্যানেলে ভেসে উঠবে হাথরস, উন্নাও, হাঁসখালি, কামদুনি; স্মৃতি বিস্মৃতি এক্সপ্রেস দিল্লির নির্ভয়া কিংবা পার্ক স্ট্রিটের সুজ়েট হয়ে তিরিশ বছর আগের বানতলা পর্যন্ত পৌঁছে যাবে। পৌঁছে গিয়েই অ্যাবাউট টার্ন নেবে, কারণ বানতলার তো কোনও ভিডিয়ো নেই। আচ্ছা, তিরিশ বছর আগে ফুটেজ পাওয়া যেত না বলে কি নৃশংসতার মূল্য কম ছিল? ভিডিয়ো কি বীভৎসতার দাঁড়িপাল্লায় অতিরিক্ত একটা বাটখারা চাপায়?
উত্তর, না এবং না। দিল্লির নির্ভয়া কাণ্ডের ভিডিয়ো থাকলে তা বীভৎসতায় হয়তো মণিপুরের ঘটনাকেও ছাপিয়ে যেত। কারণ, সেখানে মেয়েটিকে খুনই করে ফেলা হয়েছিল। কিন্তু মণিপুরের ক্ষেত্রে শিহরিত হওয়ার বড় কারণটা অন্যত্র। সেটা হল, কেন ভিডিয়ো আসার আগে অবধি সাতাত্তর দিন অপরাধীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি? স্রেফ এই কারণেই বরখাস্ত হওয়া উচিত একটা সরকারের। এ বার এই কথা শুনেই যদি অন্যত্র আরও কী কী ঘটনা ঘটেছে তার বিবরণ শুনতে হয় তবে উত্তর হল, অন্যায় যেখানে, দৃষ্টান্তমূলক শাস্তিও সেখানেই। কিন্তু তার বদলে যা ঘটছে তা হল, সন্ধ্যার টিভি বিতর্কে, দুই দলের প্রতিনিধির ভিন্ন-ভিন্ন রকমের বর্বরতার ভিডিয়ো আনকাট দেখানোর অপচেষ্টা।
এখানে অবশ্যই মনে রাখা প্রয়োজন, যে কোনও অত্যাচারিত মানুষের কাছে তার উপর ঘটে যাওয়া অত্যাচারটাই সর্বোচ্চ। সবচেয়ে বড় অন্যায় তাই, একটি পৈশাচিকতার সঙ্গে আর একটি পৈশাচিকতাকে লড়িয়ে দেওয়া। ক্ষমতা দখলের লড়াইয়ে নৃশংসতাকে কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহারের এই প্রবণতা যে বিরাট মরীচিকার সৃষ্টি করে তা হল, মোবাইলে তোলা ভিডিয়ো, বিচারের সহায়ক। আসলে কি তাই? উদুপিতে মেয়েদের হস্টেলের বাথরুমে মোবাইল বসিয়ে ছবি তুলে নেওয়ার যে ঘটনায় তোলপাড় পড়ে গেছে, তার কী ব্যাখ্যা তবে?
সম্প্রতি বীরভূম সীমান্তের একটি গ্রামে গিয়ে দেখা গেল, প্রায় প্রতিটি বাড়িতে পাম্প বসেছে জল তুলে স্নান করা হবে বলে। এতে যে ভূগর্ভস্থ জলস্তর একেবারে নীচে নেমে যাবে, চাষবাসের ভয়ানক ক্ষতি হবে, সেই কথা বললেই শুনতে হচ্ছে যে, আগেকার মতো দল বেঁধে মেয়েরা গ্রামের পুকুরে স্নান করতে যায় না আর। যাওয়া সম্ভব নয় কারণ, পুকুরে স্নান করতে গেলেই গাছের ডালে কিংবা আড়ালে বসে থাকা দুর্বৃত্তের দল মোবাইলে ভিডিয়ো বানিয়ে হোয়াটসঅ্যাপে ছড়িয়ে দেয়। মেয়েদের হাত-পা ছুড়ে পুকুরে স্নান করা বন্ধ হয়ে গেল যে যন্ত্রের দৌলতে তার হাত ধরে নারীমুক্তি ঘটবে— এটা ধরে নেওয়াও খানিকটা আকাশকুসুম।
দৃশ্যম্ সিনেমার কথা মনে পড়ে যায় এই সূত্রে। এ রকমই এক ভিডিয়োর হাত থেকে নিজের কিশোরী কন্যাকে বাঁচাতে চতুর্থ শ্রেণি অনুত্তীর্ণ এক পিতা জীবন বাজি রাখেন সেখানে। সেই পিতাই যেন আজকের ভারত, যিনি নিজের কন্যাকে বাঁচাতে গিয়ে বুঝতে পারেন, রাষ্ট্র-প্রশাসন-পুলিশ, যার যার উপরে অন্ধের মতো বিশ্বাস রাখে সাধারণ মানুষ, প্রত্যেকেই পাল্টে যেতে পারে পলকে।
অন্ধের বিশ্বাস কিন্তু অন্ধ-বিশ্বাস নয়। দ্বিতীয়টা হল চোখ খুলেও যা দেখতে চাই না, তা না দেখা। আর প্রথমটা অনুভবে যাকে দেখেছি, চোখ না থাকলেও, তাকেই সত্য বলে উপলব্ধি করা। অন্ধের সেই বিশ্বাস নির্যাতিতা প্রতিটি মেয়েকে একটা মেয়ে বলেই চেনে, কারণ তার চেনা, দৃশ্যের মাধ্যমে হয় না। আর্তনাদের শব্দ শুনে হয়। আর্তনাদের সেই শব্দ নাগা-কুকি-মেইতেই-যাদব-হরিজন-ব্রাহ্মণ-ক্ষত্রিয়-মুসলমান-হিন্দু— কিছুই চেনায় না। চেনায় কেবল কান্না। যা আগেও কেউ কেঁদেছেন, আজও কাঁদছেন। এ বার একটি কান্না দিয়ে অন্য কান্নাকে লঘু বা গুরু করার চেষ্টা এক অপরিণামদর্শী ঔদ্ধত্য, যা আগুনকে আর কখনও নিবতেই দেবে না।
প্রশ্ন জাগে, যে মণিপুরের ঘরে ঘরে শ্রী চৈতন্যের প্রতিকৃতি রাখা, বৈষ্ণব ভাবান্দোলন যেখানে বিপুল সাড়া ফেলেছিল, সেখানে সমাজ এমন আড়াআড়ি ভাগ হয়ে গেল কী ভাবে যে, দুই জনগোষ্ঠীর শিশুরাই অন্য জনগোষ্ঠীর মানুষকে মেরে ফেলতে চাইছে আর খবর হচ্ছে তাই নিয়ে? দিল্লির সেলুনে কিংবা হোটেলে কাজ করা যে মণিপুরী মানুষদের কুকি অথবা মেইতেই নির্বিশেষে, চিনে বা কোরীয় বলে ব্যঙ্গের শিকার হতে হয়, নিজেদের জন্মভূমিতে তারা পরস্পর পরস্পরের এত বিরুদ্ধে গেল কেন? এখানে মাদক ব্যবসা, তার চোরাচালান, হেরোইন আর মারিহুয়ানার স্বর্গরাজ্য যে লাও-তাইল্যান্ড-মায়ানমার, তার সঙ্গে মণিপুরের নিবিড় সংযোগ, সবটাই আতশকাচের নীচে ফেলে দেখা জরুরি।
‘বেঙ্গল ইস্টার্ন ফ্রন্টিয়ার রেগুলেশন’ আইনের মাধ্যমে ব্রিটিশ শাসক ভারতের অন্যান্য অঞ্চলের লোক যাতে মণিপুর বা উত্তর-পূর্বাঞ্চলে যেতে না পারে, তার ব্যবস্থা করেছিল। সেই সময় থেকেই এই অঞ্চলকে বিচ্ছিন্ন করার প্রক্রিয়া চলছে। এই প্রসঙ্গে আর একটি কথাও বলা দরকার। ভারতে সংরক্ষণের সৃষ্টি হয়েছিল সবচেয়ে পিছিয়ে পড়া মানুষটাকে হাত ধরে এগিয়ে আনার জন্য। সংরক্ষণের ফল যদি হয়ে দাঁড়ায় একটা জনগোষ্ঠীর সঙ্গে আর একটা জনগোষ্ঠীর দাঙ্গা, বা এমন একটি ভূখণ্ড যেখানে সবাই, যে কোনও উপায়ে সংরক্ষণের সুবিধা চাইছে, (যখন সরকারি চাকরির সংখ্যাই কমতে কমতে তলানিতে) তা হলে নতুন করে ভাবার সময় এসেছে।
দেখবে কে? ভাববে কে? ভারত ইদানীং এমন একটি উচ্চ বিদ্যালয় হয়ে দাঁড়িয়েছে যেখানে প্রধানশিক্ষক নিজে অঙ্ক করান আর ছাত্রছাত্রীরা অঙ্কে ফেল করেছে শুনলেই বলে ওঠেন যে, ওরা ভূগোলেও ফেল করেছে, জীবনবিজ্ঞানেও পাশ করতে পারেনি। যদি তাই হয়ে থাকে তবে তার দায়ও যে হেডমাস্টারের, এই সরল সত্য শীর্ষ চেয়ারকে বোঝাবে কে?
হীরেন মুখোপাধ্যায় সংসদে দেওয়া তাঁর একটি ভাষণে বলেছিলেন, “থিংস উইল হ্যাপেন ইন ইন্ডিয়া, কম্পেয়ারড টু হুইচ দ্য রাশিয়ান রেভলিউশন উইল অ্যাপিয়ার টু বি আ টি পার্টি।” অন্ধের বিশ্বাস ভেঙে গুঁড়িয়ে দেওয়ার এই প্রক্রিয়াকে আটকানো না গেলে, ওই কথাগুলোর সত্যি হয়ে ওঠা কেবল সময়ের অপেক্ষা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy