এক মাসের মধ্যে তিন জায়গায়। প্রথমে বেঙ্গল কেমিক্যাল, তার পর বাগবাজার এবং তার পর দিনই খবর এল আগুনে ভস্মীভূত নিউটাউনের একাধিক ঝুপড়ি। এর মাত্র চার মাস আগে নারকেলডাঙার ৭০টির কাছাকাছি ঝুপড়ি আগুনে ছাই হয়ে যায়, আর তার কিছু দিনের মাথায় তপসিয়া, নিউটাউন থেকেও একই ঘটনার খবর আসে। ছ’মাসের মধ্যে ছ’টি ঝুপড়ি-বস্তি আগুনে পুড়ল। প্রতি বার বছর ঘোরার সময়টা খবর হয় বস্তির আগুন। বাসন্তী কলোনি, ট্যাংরা, কালিকাপুর, পার্ক সার্কাস, ব্রেস ব্রিজ, তিলজলায় গত ১০ বছরে বস্তিতে বড় মাপের আগুন লাগার ঘটনা ঘটেছে। প্লাস্টিক-দরমার ঝুপড়ি থেকে ইট-কাঠের পাকা ঘর, সব রকম বস্তির ঘরই ফি-বছর পোড়ে। সহ-নাগরিকরা দৌড়ে যান, সাধ্যমতো পাশে দাঁড়ান। সরকার বস্তিবাসীকে নানা প্রতিশ্রুতি দেয়, কিছুটা পালনও করে। দেখা যায়, সরকারি সহায়তা কেমন মিলবে তা নির্ভর করে বস্তির মানুষের দরকষাকষির ক্ষমতার উপর। পুড়ে যাওয়ার পর নারকেলডাঙা বস্তিতে স্রেফ ত্রিপল মিলেছে ঘর বাঁধার জন্য। বেঙ্গল কেমিক্যালের কাছে ‘নেতাজি কলোনি’ বা গুলমাঠে আবার পাকা ঘর বানিয়ে দিচ্ছে সরকার, যদিও তার মান নিয়ে বিস্তর অভিযোগ। সামনে ভোট। তাই, বস্তির ভোটার সংখ্যাও হিসেবে আসে।
বছর দশেক আগের তথ্য অনুযায়ী, কলকাতা পুর নিগমের অন্তর্ভুক্ত এলাকায় বস্তিবাসী মানুষের সংখ্যা ১৫ লক্ষ, যা কলকাতার তৎকালীন জনসংখ্যার প্রায় এক-তৃতীয়াংশ। কলকাতা, সল্টলেক, নিউটাউন ধরলে শহরে বস্তিবাসিন্দার সংখ্যা কত হতে পারে, আন্দাজ মেলে এর থেকে।
কারা এই সব বস্তিবাসী? এঁরা পেটের টানে ভিন্জেলা, বা অন্য রাজ্য থেকে এসেছিলেন এক সময়। শহরটাকে সাফ-সুতরো রেখেছেন, অন্যের বাড়িতে গৃহশ্রম দিয়েছেন, রিকশা, বাসে টেনে নিয়ে গিয়েছেন অন্য নাগরিকদের, ফুটপাতে সস্তার দোকান দিয়েছেন, ট্রলি ঠেলেছেন হাসপাতালে। নানা ভাবে মিটিয়ে চলেছেন নাগরিক জীবনের দৈনন্দিন প্রয়োজন। কিন্তু বাস করার জমির উপর আইনি অধিকার না থাকায় পাকা বাড়ি তৈরি করতে পারেননি। ত্রিপল, দরমা, বাঁশ ইত্যাদি দিয়ে যে ধাঁচাটা দাঁড়ায়, সেটা ভয়ানক দাহ্য।
শহরের ‘উন্নয়ন’-এর পরিকল্পনা কি এতগুলো মানুষের এই জতুগৃহে বাসের রূঢ় বাস্তবকে অস্বীকার করে হতে পারে? যাঁরা এই শহরটাকে গড়েপিটে তৈরি করছেন, টেনে নিয়ে চলেছেন রোজ, সস্তায় খাবার জোগাচ্ছেন, তাঁদের নিরাপদ, স্বাস্থ্যসম্মত বাসস্থানের প্রশ্নটিকে আর কত দিন এড়িয়ে যাব আমরা? বস্তি উন্নয়ন নিয়ে রাজ্যের কোনও নীতি নেই, আইনও নয়। পুনর্বাসন আইন আছে একটি, যদিও দুর্বল, বস্তিবাসীর স্বার্থরক্ষার অনুপযোগী। কিছু বস্তিকে উদ্বাস্ত কলোনি/বস্তি হিসেবে চিহ্নিত করে পাট্টা বা ফ্ল্যাট দেওয়া হয়েছে কয়েকটি জায়গায় (যেমন, বাগবাজারেই ‘মায়ের বাড়ি প্রকল্প’)। কিন্তু সেগুলো ব্যতিক্রম। শহরের দরিদ্রদের জন্য বাসস্থানের প্রকল্প আছে ‘অটল মিশন ফর আর্বান রিজুভিনেশন অ্যান্ড ট্রান্সফর্মেশন’ বা ‘অম্রুত’। কিন্তু তার অধীনে ঘর তৈরি করার অনুদান পেতে জমির মালিকানা দরকার। ফলে বস্তিবাসীদের তার সুবিধে বিশেষ মেলে না। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক চুক্তিতে ভারত সরকার ‘সকলের জন্য বাসস্থান’ নীতিতে স্বাক্ষর করে এসেছে। সেই অঙ্গীকার সরকারি ফাইলেই আটকে রয়েছে। বস্তি মানে আসলে স্বল্প পরিসরে, স্বল্প রসদ নিয়ে বহু মানুষের জীবনযাপন। যা এমন এক পরিস্থিতিতে এই মানুষগুলোকে আটকে রাখে, যেখানে তাঁরা প্রায় সর্বক্ষণ নিজেদের মধ্যে প্রতিযোগিতা করেই টিকে থাকতে বাধ্য হন। ফলে পুঁজির সঙ্গে, প্রশাসনের সঙ্গে দরকষাকষিতে এই শ্রমবাহিনীর পাল্লা হয় দুর্বল, শ্রম হয় সস্তা। ন্যায্য মজুরি বা বৈধ বাসস্থান, কোনওটিই তাঁরা পান না।
‘জীবনের অধিকার’ মানে যেমন সম্মান নিয়ে বাঁচার অধিকার, তেমনই ‘শহরের অধিকার’ মানে এই শহরে কাজ করে সম্মান নিয়ে বেঁচে থাকার অধিকার। সুস্থ কাজের পরিবেশ, ন্যায্য মজুরি, কাজের শেষে একটা স্বাস্থ্যকর বিশ্রামের, অবসর যাপনের, গৃহকর্মের পরিবেশ। বস্তি এর পরিপন্থী। অনেক ঝুপড়ি বস্তিতে পানীয়জল, বিদ্যুৎ, শৌচাগারের মতো ন্যূনতম নাগরিক পরিষেবার ছিঁটেফোঁটাও নেই। যেখানে আছে, সেখানেও ঘিঞ্জি কর্দমাক্ত গলি, জলের কলের বা বাথরুমের লাইন মনুষ্যেতর একটা অবস্থা সৃষ্টি করেছে। শহরবাসী শ্রমিক হিসেবে এঁদের স্বীকৃতি না দিলে অবস্থা বদলাবে না। ওড়িশা-সহ কিছু রাজ্য বস্তিবাসী মানুষের বাসের জমির উপর অধিকার দিয়ে আইন করেছে, যদিও সেই অধিকারে নানা সমস্যা আছে।
বস্তিবাসী মানুষের জন্য নিরাপদ ও বৈধ বাসস্থানের পরিকল্পনাকে স্থান না দিয়ে ‘স্মার্ট সিটি’, ‘গ্রিন সিটি’ বা শহর উন্নয়নের কোনও নীতি তৈরি করা অর্থহীন। বস্তি সমস্যার সমাধান প্রথম চিন্তার বিষয় হওয়া উচিত। নইলে এই শহরের এক-তৃতীয়াংশ মানুষ রোজ রাতে জতুগৃহে ঘুমোতে যাবেন। অপেক্ষা করবেন পরবর্তী দহন পর্বের জন্য।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy