মাতৃরূপেণ: দুর্গাপ্রতিমার চোখ আঁকছেন শিল্পী। ছবি সৌজন্য: তথাগত সিকদার।
এই যাঃ, এসেই তো গেল তবে, দুর্গাপুজো! বেশ একটা আসছে-আসছে ভাব ছিল চার পাশে, একটা অপেক্ষা ছিল, সেটুকুও মুড়িয়ে দিয়ে মহালয়া চলে এল, দেবীপক্ষ শুরু হল, এখন আর কেউ “পরশু তো ষষ্ঠী, আপনার কাজ পরশুর মধ্যে শেষ হবে?”— শুধোয় না, বড় বড় পুজো মহালয়াতেই ফিতে কেটে রেডি। এখন সব আগেভাগে, এখন সব আগাম। প্রকৃতির ঘড়িটাই শুধু কেমন ঢিমিয়ে গেছে, মানুষের ঘড়ি গিয়েছে বাঁইবাঁই এগিয়ে। দুর্গাপুজো নেহাত তিথি-টিথি মেনে হয় বলে এখনও পাঁজি ধরে সে সবের অপেক্ষা করতে হয়, উৎসবের তো আর ক্যালেন্ডার হয় না। তাই বাঙালি তাকে ঘাড় ধরে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে এসে বসিয়ে দিয়েছে মহালয়াতেই। গত কাল থেকেই আলোর বেণু বেজে উঠেছে, সে সুর শুনে মন খুলে না দেয় সাধ্য কার!
কিন্তু বাঙালি তো অপেক্ষায় বাঁচে। বাঁচত অন্তত। তার জাতিগত অস্তিত্বের একটা মূল সুর হল অপেক্ষা: তা সে স্বাধীনতার জন্য হোক কি অধিকারের জন্য, প্রেম-ভালবাসার জন্য বা উজ্জ্বল ভবিষ্যতের জন্য। অপেক্ষার মধ্যে সে যেন একটা তপস্যা দেখতে পায়, গোড়া থেকেই তেড়েফুঁড়ে সে কিছু করে না, পিঠ ঠেকে না যাওয়া পর্যন্ত সে অপেক্ষা করে। প্রখর খরাতেও কৃষকের অপেক্ষা, নিশ্চয়ই মেঘ জমবে, বৃষ্টি নামবে, ধানের শিষে ঘন হবে ক্ষীর। মালিকের শাসন-শোষণ সয়েও শ্রমিকের অপেক্ষা, কারখানা খুলবে এক দিন, লকআউট উঠবে। কবি অপেক্ষা করবেন তাঁর এখনও না-লেখা কবিতার এক-একটি শব্দের নিঃশব্দ পদপাতের, মাতঙ্গিনী হাজরার মূর্তির নীচে বসে থাকা চাকরিপ্রার্থী অপেক্ষা করবেন আর একটা প্যানেল ঘোষণার, রাজনৈতিক দল অপেক্ষা করবে পরবর্তী নির্বাচনের, ক্ষয় আর ভাঙনের মধ্যে দাঁড়িয়েও সমাজচিন্তক ভাববেন: নিশ্চয়ই আসল কথা, কাজের কথাটা ভাববে এ বার বঙ্গসমাজ। অপেক্ষার ভাষায় চর্যাপদের কবি আর রবীন্দ্রনাথে তফাত নেই; বাঙালি তার আশ্চর্য ক্ষমতায় অপেক্ষাকে পাল্টে নিয়েছে— হাল ছেড়ে-দেওয়া নিয়তিবাদ থেকে আশাবাদের জীবনদর্শনে।
এই অপেক্ষা দুর্গাপুজোর জন্যও বা কম কী! বচ্ছরকার চারটে দিনের জন্য আকুল চেয়ে থাকা— অষ্টমীর অঞ্জলি, সন্ধিপুজোর একশো আট প্রদীপে কারও আগ্রহ থাকুক কি না-ই থাকুক, আলো মেলা মাইক নতুন জামা খাওয়াদাওয়া ঠাকুর দেখার ভিড়-হুল্লোড়ে কেউ অংশভাক হোক বা না-ই হোক। দুর্গাপুজোর জন্য বাঙালির অপেক্ষাটা আসলে অন্য এক স্তরের। এ স্রেফ ছুটির অপেক্ষা নয়— ছুটি তো কতই থাকে বছরে, দু’দিনের ছুটিও সরকার বাহাদুরের বদান্যতায় ইদানীং তিন-চার দিনে গড়িয়ে যাওয়াটা নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ স্রেফ চার-পাঁচ দিন ধরে দশভুজাকে খুবসে পুজো করব তারও অপেক্ষা নয়: দেখনদারির পুজো-আচ্চা তার আসে না, বাকি ভারতের মতো নবরাত্রির পূজা-উপবাস-কৃচ্ছ্র তার মনে ধরেনি। তার প্রথানিষ্ঠতা আছে, প্রথাসর্বস্বতা নেই। পুজোকে সে অনায়াসে মিলিয়েছে সামাজিকতার সঙ্গে, তাই কোন বাড়ির পুজোয় অষ্টমীতে ইলিশভোগ হয় আর কোথায়ই বা নিয্যস নিরিমিষ, তা নিয়ে সরস কপট তর্কে মাততে তার দ্বিধা নেই।
আসলে সে অপেক্ষা করাটা উপভোগ করে। তার অন্য ভারতীয় ভাই-বেরাদররা যখন সময়কে ট্যাঁকে পুরে ছুটতে বদ্ধপরিকর, বাঙালি তখন সময়কেই সময় দেয় ষোলো আনা। অন্যেরা যখন ভাবছে পুজো দোরগোড়ায়, এই বেলা উদয়াস্ত খেটে, অষ্টপ্রহর বেওসা চালু রেখে লাভের উপরিটুকুও কামিয়ে নিই, সে তখন হিসাবের খাতায় শক্তিসঙ্গীত লিখছে— আর কী আশ্চর্য, সেই গান থেকে যাচ্ছে ইতিহাসে, একুশ শতকেও বাজছে দুর্গাপুজোর প্যান্ডেলে। সময় আর তার অপেক্ষাকে সে নিয়ে গিয়েছে উদ্যাপনের পর্যায়ে, ভাবখানা এমন যে পুজোর চারটে দিন তো স্রেফ আয়ারাম-গয়ারাম, ‘পুজো আসছে’-র এই অপেক্ষাকেও উপভোগ আর উদ্যাপন না করতে পারলে তার বাঙালি জীবনটাই বৃথা!
উপভোগ, উদ্যাপন শব্দগুলো শুনলে আনন্দের অনুষঙ্গই তো মনে জাগে, তাই না? এখানেও এই জাতটা ব্যতিক্রমী— অপেক্ষার যন্ত্রণাও সে প্রিয় শুকপক্ষীটির মতো দানাপানি দিয়ে লালন করে অন্তরে। মরু থেকে মেরু, সব দেশের মানুষই গান গায়, সবার গানেই প্রিয়জনবিরহ, বিচ্ছেদযন্ত্রণা থাকে, মানুষী কাঠামো পেরিয়ে ঈশ্বর-অবয়বেও সেই বেদনা প্রতিস্থাপন করেন অনেকে। তুমি দেখা দাও, তোমা বিনা প্রাণ বাঁচে না— সারকথা এমন। কিন্তু এমন গান কি আর কেউ কোথাও লিখেছে, যেখানে মহৈশ্বর্যময়ী ঈশ্বরী সামনে এসে দাঁড়ান ঘরের অতি সাধারণ মেয়েটি হয়ে? দশপ্রহরণধারিণী দুর্গা নন তিনি, বিয়ে হয়ে স্বামীগৃহে সংসার করতে যাওয়া গৌরী। মহিষমর্দিনী নন, বাপের বাড়ি আসতে না পেরে গুমরে-মরা উমা। বাঙালি দুর্গাপুজোর অপেক্ষা করতে করতে শিল্পসৃষ্টি করে ফেলল, তার আগমনী গান এমন এক অনবদ্য বিচিত্র সৃষ্টি যা কেবল গাওয়া চলে এই ‘পুজো আসছে পুজো আসছে’ সময়টুকুতেই। এ গান ক্ষণজীবী মরসুমি গান, অন্য দিকে চির-অপেক্ষারও গান। ঘরের মেয়েটিকে বিয়ে দিতেই হবে, এমনকি নেশাখোর বাউন্ডুলে অপাত্র-কুপাত্র হলেও সমাজের ভয়ে না দিয়ে গতি নেই, আর এক বার স্বামীগৃহে চলে গেলে ফের কবে সে দিনকয়েকের জন্য বাড়ি আসবে তারও নিশ্চয়তা নেই— এই পুরুষতন্ত্র পরিবারতন্ত্র ও তথাকথিত গ্রামীণ আর্থ-সামাজিক নিগড়ের পরিপ্রেক্ষিত থেকে উদ্ভব হচ্ছে এমন এক গানের, যেখানে মা আর থাকতে না পেরে স্বামীকে বলছেন চারটে দিনের জন্য অন্তত মেয়েটাকে বাড়ি নিয়ে আসতে, আর তাঁর অপেক্ষা সইছে না।
বিয়ে হওয়া ইস্তক বাপের বাড়ি আসতে পারাটা বাংলার মেয়েদের কাছে একদা সত্যিই এক ব্যাপার ছিল, এখন তা অলীক মনে হয়। কিন্তু অপেক্ষাটা থেকেই যায়, বিশেষত মায়েদের অপেক্ষা। অপেক্ষায় লিঙ্গভেদ নেই— ছেলে বড় হয়ে কলকাতায় পড়তে গেছে, নিশ্চিন্দিপুরে সর্বজয়া একা দাওয়ায় বসে অপুর শহর-ফেরতা ট্রেনের ভোঁ কান পেতে শোনেন, সেও কি উমারই ঘরে ফেরার অপেক্ষা নয়? এ কালে কত গৌরী-উমা স্বয়ংবরা স্বয়ম্ভরা দুই-ই, দূরদেশে তাঁদের ঘর-সংসার, কাজ ও পড়াশোনার বিপুলা পৃথিবী। সেখানে ঘড়ি ঘোরে অন্য কাঁটায়, ছুটির ক্যালেন্ডারও আলাদা, পুজোর সময়েও বাড়ি ফেরা যায় না। ও দেশে পাতা ঝরার মরসুম শুরু, এখানে ছাতিমফুলের গন্ধে ম-ম করে পাড়া, ওখানে মেয়ে আর এখানে মায়েরা কী-ই বা করতে পারেন, অপেক্ষার প্রহর গোনা ছাড়া?
অপেক্ষার উপলক্ষটুকুও অনেকের থাকে না। পুজোয় কী কিনবেন কোথায় খাবেন ইত্যাদির চোখ-ধাঁধানো বিজ্ঞাপনস্রোতে উঁকিঝুঁকি দেয় বৃদ্ধাশ্রমের বাসিন্দাদের পুজো পরিক্রমার প্যাকেজ-কথা: পুজোয় ঘুরুন ঠাকুর দেখুন আনন্দে, একলাটি ঘরে বসে থাকবেন কেন, আমরা আছি। একাকিত্ব বড় বালাই, বাজার আর সোশ্যাল মিডিয়ার মায়াবাজার একা-মানুষকে বাঁচিয়ে দিয়েছে— ভুলেও যাতে কারও অপেক্ষা না করতে হয় তাই সামনে সাজিয়ে রেখেছে বিস্তর ‘অপশন’। সম্পূর্ণ অচেনা এক দল একা-মানুষ তাই দল বেঁধে পুজোয় বেরিয়ে পড়ে ‘ঠাকুর দেখা’র নামে সাময়িক ও কৃত্রিম এক যৌথতার নির্মাণে; মহানগরের বহুতল আবাসনের পুজোয় যোগ দিয়ে একটা বৃদ্ধ একাকী প্রজন্ম হাতড়ে বেড়ায় সাধের ‘কমিউনিটি ফিলিং’। আর যার কিছুই নেই তার তবু তো সোশ্যাল মিডিয়া আছে, ঝুড়ি ঝুড়ি কথা-ছবি-রিল-ভিডিয়োতে বুঝিয়ে দেওয়া যায় এই তো দিব্যি আছি খাচ্ছিদাচ্ছি কলকলাচ্ছি, কোনও কিছুর পরোয়া নেই, কারও জন্য অপেক্ষা নেই— বাস্তব তা সে যতই ভিন্ন হোক।
পুজো আসার অপেক্ষার মিঠে অজুহাতে আসলে যে প্রিয় মুখগুলোর জন্য, অত্যাগসহন যৌথতার জন্য অপেক্ষা ছিল একদা বাঙালি জীবনে, সেটা হারিয়ে গেল বলেই কি আমরা পুজোর উদ্যাপনটা বাড়িয়ে নিলাম এক লপ্তে অনেকটা? এগিয়ে নিলাম ক্যালেন্ডারের পাতায় একেবারে মহালয়ার দিন থেকে? ভিতরে ভিতরে বিষণ্ণ মানুষ অনেক সময় বাইরে অদ্ভুত আচরণ করে, আমাদের সমষ্টিবিষাদ কি এতই গভীর যে আমরা তা থেকে বেরিয়ে আসতে চাইছি উপর্যুপরি আরোপিত আনন্দে? তাই জুলাইয়ে প্যান্ডেল বাঁধা, অগস্টে পুজো সেল, মহালয়ারও দু’দিন আগে থেকে ভার্চুয়াল পুজো উদ্বোধন, ‘ধর তক্তা মার পেরেক’ মণ্ডপে সাহেবসুবো ডেকে এনে সার্টিফিকেট-কাতরতা? এই কি বাঙালির আবহমান সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য, এই অলজ্জ মরিয়া কাঙালপনা?
শ্রীশ্রীচণ্ডী-তে আছে, তিনি শুধু ‘মাতৃরূপেণ’ই নন, ‘ভ্রান্তিরূপেণ’, আবার ‘লজ্জারূপেণ’ সংস্থিতাও। ভুলের মধ্যেও তিনি, লজ্জার মধ্যেও। পুজোর উৎসবময়তাকে আপ্রাণ টেনে হিঁচড়ে আমরা নিজেদের প্রতিই যে ভুল করছি, তার জন্য লজ্জাবোধ কি সঙ্গী হবে আমাদের? ফিরে আসবে কি আমাদের অপেক্ষার সাধন-ঐতিহ্য?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy