ধর্মীয় জাতীয়তাবাদ মানেই একটা তীব্র আবেগ, যার মূলে থাকে সাম্প্রদায়িক চেতনা। এই জাতীয়তাবাদ নিজের গোষ্ঠী ও সম্প্রদায়কেই শুধু গৌরবান্বিত করার চেষ্টা করে, সেই স্বার্থসিদ্ধির জন্য অন্য গোষ্ঠী, জাতি, দেশ বা সম্প্রদায়ের প্রতি অসহিষ্ণুতা ও ঘৃণার বীজ বোনে। ধর্মীয় জাতীয়তাবাদী আবেগের আড়ালে লুকোনো এই বিদ্বেষকেই বাংলা ও বাঙালি প্রত্যাখ্যান করল এই নির্বাচনে।
প্রাক্-স্বাধীনতা যুগের জাতীয়তাবাদ এই জাতীয়তাবাদের থেকে আদর্শগত ভাবে একেবারে আলাদা। তা ছিল সাম্রাজ্যবাদ ও তার শোষণ, লুণ্ঠনের বিরুদ্ধে প্রতিরোধের হাতিয়ার, অন্যকে অপদস্থ করা তার লক্ষ্য ছিল না। জাতীয়তাবাদের সেই পরিমণ্ডলেও রবীন্দ্রনাথ বার বার আমাদের সংযত হতে বলেছেন। ঘরে বাইরে ও চার অধ্যায়-এ অন্ধ দেশভক্তির সমালোচনা ও তাঁর দূরত্ব সুস্পষ্ট। অন্যত্রও তিনি জানিয়েছেন, যে শিক্ষাব্যবস্থা মানবিকতার আগে দেশভক্তিকে প্রাধান্য দেয়, আমাদের কর্তব্য তেমন চিন্তাধারার বিরোধিতা করা। তাঁর ভাষায় জাতীয়তাবাদ অতি ভয়াবহ, কারণ ভারত ভাষায়, ধর্মে, আচার-রুচিতে, জাতিগত ভাবে বিচিত্র। সেই বিবিধতা ও তার সহনশীলতা আমাদের একত্রবাসের ভিত্তি। আর এই বিবিধতায় আঘাত হানাই হিন্দুত্বের উদ্দেশ্য— হিন্দু রাষ্ট্র নির্মাণের অস্ত্র।
এখনকার সাম্প্রদায়িক শক্তি নির্বাচনী স্বার্থে রবীন্দ্র-আত্মসাৎ প্রকল্পে ঝাঁপ দিয়েছিল। শান্তিনিকেতনে পা রাখার আগে বা পোস্টারে রবীন্দ্রনাথেরও উপরে নেতার ছবি সাঁটার আগে রবীন্দ্রচর্চার প্রয়োজন বোধ করেনি। তাদের রাজনীতি আত্মপ্রচারের সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে স্রেফ আত্মনির্ভরতার বুলি আওড়ানো, বাঙালির আদৃত বহুত্বের মর্ম স্পর্শ করা নয়। শান্তিনিকেতনে রবীন্দ্রকক্ষে নিজেদের নেতাকে অধিষ্ঠিত করা বা সুযোগ বুঝে রবীন্দ্রনাথ, বিবেকানন্দ ও নেতাজিকে ব্যবহার করে রাজনৈতিক ফয়দা তোলাই তাদের লক্ষ্য, সহিষ্ণু চিন্তন ও মননের স্থান তাদের ভাবনার একেবারে উল্টো মেরুতে।
রবীন্দ্রনাথের মননে রাজনৈতিক স্বাধীনতার থেকেও বেশি গুরুত্বপূর্ণ মনের স্বাধীনতা। স্বাধীন চিন্তা, স্বাধীন বাচন, স্বাধীন যাপনের উৎস এই স্বাধীনতা এ কালে সাম্প্রদায়িক জাতীয়তাবাদের কবলে বিপন্ন হয়ে পড়েছিল। বাঙালি সেই জাতীয়তাবাদকে প্রত্যাখ্যান করে উদারমনস্কতার নিদর্শন স্থাপন করল। বাক্স্বাধীনতা হরণ যে জাতীয়তাবাদের ভিত্তি, রাবীন্দ্রিক চিন্তাধারার সূক্ষ্মতা ও উৎকর্ষ তার নাগালের বাইরে। সেই মতবাদে বিশ্বাসীরা শুধু জাতীয়তাবাদের নামে ইতিহাসের নির্বাচিত অংশ বিকৃত করে লোক খেপাতে পারে। প্রকৃত জাতি ও জাতীয়তাবাদের বিকাশের শর্ত যে সহমর্মিতা ও সহিষ্ণুতা, সেই সব কিছুকে খণ্ডন করার রাজনীতিই তাদের সহজাত। রাবীন্দ্রিক আদর্শের মাটি সে রাজনীতিকে প্রশ্রয় দেয় না।
বিভাজনের ঔদ্ধত্য ও মোহে আচ্ছন্ন সঙ্কীর্ণ জাতীয়তাবাদীরা জানে না রবীন্দ্রনাথের মন্তব্য— রাজনৈতিক স্বাধীনতা অনেক ক্ষেত্রেই হয়ে দাঁড়ায় ক্ষমতালোভীর ক্ষমতা লাভের পথ। এই ক্ষমতালোভীরা মানবিকতাকে প্রতিনিয়ত ঠেলে দেয় শোষণ ও নিপীড়নের মুখে। রাজনীতি আর ব্যবসায়িকতার যে আঁতাঁত ও আধিপত্যবাদ আজ আমাদের সামনে, প্রায় একশো বছর আগেই তার সম্পর্কে সাবধান করে গিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ।
প্রযুক্তিধন্য এই যুগে অনায়াসেই হয়তো অমিত শাহের পাশে রবীন্দ্রনাথকে বসানো যায়, মতাদর্শগত দূরত্ব তাতে বিন্দুমাত্র ঘোচে না। বরং প্রমাণ হয়, এই আরোপিত নৈকট্য আসলে ভোট পাওয়ার স্থূল চেষ্টা মাত্র। ভোটের ফলাফলে এটাই প্রমাণিত, সেই অপচেষ্টা বিফল হয়েছে, রবীন্দ্রনাথকে আত্মসাৎ করতে চাওয়ার এই ছেলেখেলা বাঙালি ভাল চোখে দেখেনি। বরং এই ফাঁপা জনসংযোগ বাঙালিকে মনে করিয়ে দিয়েছে দুই জাতীয়তাবাদের তফাতকে। রবীন্দ্রনাথের জাতীয়তাবাদ-ভাবনা আমাদের উদ্বুদ্ধ করে সঙ্কীর্ণ জাতীয়তাবাদের সমালোচনা করতে। আর এ কালে বিজেপির জাতীয়তাবাদ চায়, তাদের নেতাদের দম্ভিত ভাষণ মানুষ ভক্তিভরে মেনে নিক। বাঙালি এই অন্যায় মেনে নেয়নি।
রাবীন্দ্রিক চেতনা ধর্ম থেকে রাজনীতির বিযুক্তি কামনা করে। অন্য দিকে, হিন্দু জাতীয়তাবাদের কাজ ধর্ম নিয়ে বিভাজনের রাজনীতি করা। রবীন্দ্রনাথ সর্বজনীন মানবিকতার প্রচারক, ক্ষমতা তাঁর কাছে অভ্যন্তরীণ, শান্ত, সুগভীর এক শক্তি। এ যুগের রবীন্দ্রবেশী নেতার কাছে ক্ষমতা হল আস্ফালন— রাষ্ট্রশক্তিকে কাজে লাগিয়ে বিভেদের পোষণ। তাঁর দল সদা ব্যস্ত ‘শত্রুপক্ষ’ খোঁজার কাজে— সংখ্যালঘু, ছাত্রদল, ভিন্নমত-পোষণকারী বা বুদ্ধিজীবী, সবাই শত্রু। আপাদমস্তক বিদ্বেষপ্রসূ এই জাতীয়তাবাদের বিপরীত মেরুতে, সকল মানুষকে কাছে টেনে নেওয়ার মানবিক আদর্শ রবীন্দ্রনাথের। নিষ্প্রশ্ন ভক্তিতে ডুবে থেকে সব সমস্যা ও অভাবের বিস্মরণ নয়, বিশ্বমানবতা ও ঐক্যের সূত্রে মানুষে-মানুষে দূরত্ব ঘোচাবার আহ্বান।
সমাজতত্ত্ব বিভাগ, শিব নাদার বিশ্ববিদ্যালয়
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy