—প্রতীকী ছবি।
এই পৃথিবীর বুকে এক জীবনহানিকর সংক্রামক রোগ-বীজ কোভিডের আগমন ঘটেছিল চার বছর আগে। কোভিডের ভাইরাস কিন্তু শেষ হয়ে যায়নি, বরং মাঝেমধ্যেই তার রূপান্তর ঘটিয়ে চরিত্র বদলে আবির্ভূত হচ্ছে এবং এখনও চোখ রাঙিয়ে যাচ্ছে। সম্প্রতি এক নতুন জেএন.১ কোভিড উপরূপের আবির্ভাব সম্পর্কে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (হু) সব দেশকে সতর্ক করেছে।
হিসাবের খাতা বলছে, কোভিড-১৯’এ সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হয়েছে আমেরিকা, ১১ কোটিরও বেশি, মারা যান বারো লক্ষ। এর পরেই এশিয়ার মধ্যে প্রথমে ভারতের স্থান। সাড়ে চার কোটি ব্যক্তি আক্রান্ত, মৃত্যু হয় পাঁচ লক্ষ ত্রিশ হাজার। উত্তর কোরিয়া, টুভালু, তুর্কমেনিস্তান ইত্যাদি কয়েকটা দেশ থেকে কোভিডের কোনও তথ্য পাওয়া যায়নি। কোভিডে আক্রান্ত ও মৃত্যু সম্পর্কিত নির্ভুল তথ্য প্রায় কোনও দেশ থেকেই নথিভুক্ত করা যায়নি মূলত সামাজিক ও রাজনৈতিক কারণে। কোমর্বিডিটি-সহ কোভিডে আক্রান্ত হলে যে সব মৃত্যু ঘটে, তার অনেকগুলিই সংক্রমণে মৃত্যু বলে রেকর্ড করা হয়নি। এ ছাড়াও অনেক দেশে সরকারি স্তরে সংখ্যা লুকোনোর প্রবণতা যেমন দেখা গেছে, তেমনই সামাজিক ভাবে ‘অচ্ছুত’ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কায়, হেনস্থা এড়ানোর জন্য সরকারকে না জানিয়ে গোপনে মৃতদেহ সৎকার করা হয়েছে। সম্প্রতি পূর্ব আফ্রিকা এবং মধ্য এশিয়ার কয়েকটা দেশে গিয়ে জানা গেল, আক্রান্তের সংখ্যা বেশি হলেও অপর্যাপ্ত কোভিড পরীক্ষার কিট এবং টিকা না থাকায় অসম্পূর্ণ পরিসংখ্যান ও প্রতিরোধ ব্যবস্থা পুরো সমাজকে এক অতিমারির মুখোমুখি নিয়ে আসে, বিশেষত শহরাঞ্চলের জনবহুল এলাকায়। অবশেষে সংবাদমাধ্যমের প্রচারে সাড়া দিয়ে লোকে নিজেরাই বিচ্ছিন্ন হয়ে প্রতিরোধ গড়ে তোলে, আর তাতেই ভাল কাজ হয়েছে। জনসংখ্যা কম হওয়ায় এবং ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকায় এই ব্যবস্থা কাজ দিয়েছে জেলা ও গ্রামগুলোতে। বিচ্ছিন্ন অবস্থায় বাস করেও এলাকার পরিবারগুলোর মধ্যে প্রয়োজনীয় খাদ্যদ্রব্য ও অন্যান্য জিনিস আদানপ্রদান চলতে থাকে। ফলে অলক্ষ্যে পরিবারগুলোর মধ্যে সৌহার্দ তৈরি হয়, যা হয়তো কোভিডের আগে ছিল না।
আমেরিকা ও ইউরোপে প্রথম দিকে হু কর্তৃক প্রচারিত বিধিনিষেধের তোয়াক্কা না করে স্বাভাবিক জীবন চালাতে গিয়ে অনেক প্রাণ অযথা চলে যায়। অনুন্নত বা উন্নয়নশীল দেশগুলোতে শহরাঞ্চলে কোভিডের কামড় যতটা মারাত্মক ছিল, শহর থেকে দূরে সংক্রমণ সেই তুলনায় কম। কারণ, লকডাউনের ফলে শহর থেকে গ্রামীণ এলাকাগুলো বিচ্ছিন্ন ছিল। এটা প্রথম ঢেউয়ের সময়। তার পর লকডাউন শিথিল হলে প্রয়োজনের খাতিরেই লোকজন গ্রাম থেকে শহরে এলে ছড়িয়ে পড়ে দ্বিতীয় ঢেউ। প্রকট হয়ে ওঠে জেলার ও গ্রামে চিকিৎসাকেন্দ্রগুলোর অব্যবস্থা। ভারতের ছবিটাও একই। সমাজ শিক্ষা ও স্বাস্থ্যব্যবস্থার করুণ হাল চোখের সামনে ভেসে ওঠে, যার প্রভাব কোভিড-উত্তর কালে আরও প্রকট হয়ে দেখা দেয়।
সামাজিক ও আর্থিক নিরাপত্তার অপ্রতুলতা বহু মানুষকে শারীরিক ও মানসিক বিপর্যয়ের মুখে ঠেলে দেয়। সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের কর্মচারীদের ‘ওয়ার্ক ফ্রম হোম’-এর নিদান দিয়ে আর্থিক বিপর্যয়ের হাত থেকে বাঁচিয়েছে। কিন্তু বাড়িতে থেকে কাজের সময়সীমা বলে আর কিছু রইল না। বারো ঘণ্টা বা তারও বেশি সময় এখন কাজ করতে হয়। অসংগঠিত ক্ষেত্রে শ্রমিকদের অবস্থা কোভিডকালে শোচনীয় হয়েছিল। কাজ বন্ধ, মালিকপক্ষ থাকা-খাওয়ার দায়িত্ব না নেওয়ায় পরিযায়ী শ্রমিকদের যানবাহনহীন দেশে হেঁটে বাড়ি ফিরতে হয়। কত হাজার শ্রমিকের পথেই মৃত্যু হয়। সরকার থেকে বিনামূল্যে খাদ্যশস্য বিতরণ করায় আর্থিক ভাবে পিছিয়ে পড়া মানুষদের কিছু সুরাহা হলেও যে-হেতু জীবন যাপনের জন্য আরও কিছু সামগ্রীর প্রয়োজন, তা রোজগারহীন মানুষকে জোগাড় করতে হিমশিম খেতে হয়েছিল। সেই ভেঙে পড়া জীবন আজও মাথা তুলে দাঁড়াতে পারেনি। অতিমারির প্রভাব কমলে কিছু শ্রমিক আগের বা নতুন কাজে যোগ দিলেও, আর্থিক সচ্ছলতা ফিরে আসেনি। এর ফলে ভেঙে পড়েছে মানসিক স্বাস্থ্য। বেড়ে যাচ্ছে আত্মহননের সংখ্যা। কোভিডকালে সওয়া তিন লক্ষের বেশি লোক আত্মহত্যা করেন। আত্মহননকারীদের মধ্যে এক-চতুর্থাংশই দিনমজুর। সেই অবস্থা আজও বহাল।
শহরাঞ্চলে বেসরকারি স্কুল-কলেজে বাড়িতে বসে অনলাইন পড়া চালু হলেও সবাই সে সুযোগ পায়নি, বিশেষত সরকারি এবং গ্রামীণ স্কুলগুলোয়। প্রযুক্তিগত ব্যবস্থা সামর্থ্যের মধ্যে না থাকায় একটানা দু’বছর শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত থেকে গেল এক বিশাল সংখ্যক পড়ুয়া। আর্থিক সঙ্কটে স্কুল ছেড়ে কেউ সামান্য কাজে যোগ দিল, আর নাবালিকাদের বিয়ে হয়ে গেল। বর্তমানে হাজার হাজার ছোট শিল্প বন্ধ হয়ে যাওয়ায় বেকারের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে, নতুন কাজের সুযোগ কমেছে, এমনকি কারিগরি ক্ষেত্রেও। কোভিডকালে আর্থিক লেনদেনে ডিজিটাল ব্যবস্থা বেড়ে যাওয়ায় সাইবার জালিয়াতি বর্তমানে এক সামাজিক ব্যাধি হয়ে দাঁড়িয়েছে। সামান্য অসতর্কতায় অর্থ হারাচ্ছেন সব শ্রেণির মানুষ।
কোভিড-সংক্রমিত ব্যক্তিদের দুর্বল প্রতিরোধ ক্ষমতা দীর্ঘ সময়ের জন্যে সুস্বাস্থ্য বজায় রাখার প্রতিকূল বলে মনে করছেন হু-র বিশেষজ্ঞরা। বিশেষত অসুস্থ এবং প্রবীণদের। কোভিড কার কোন অন্ত্রে বা যন্ত্রে কী ক্ষতি করেছে, তা সময়ই বলতে পারবে। আনুষঙ্গিক অসুস্থতার কারণেও ক্ষতিগ্রস্ত অন্ত্র বা যন্ত্রের বিকল হওয়ার সম্ভাবনা প্রবল। বলা হচ্ছে, সব বয়সিদের মধ্যে হার্ট অ্যাটাকে মৃত্যুর সংখ্যা বেড়ে যাওয়ার এটা অন্যতম কারণ। এই রোগ-বীজের সংক্রমণ মানসিক স্বাস্থ্যেও প্রবল আঘাত করেছে। দীর্ঘ সময় গৃহে অন্তরিন হয়ে থাকায় শিশু থেকে বৃদ্ধ, সকলেরই মানসিক স্বাস্থ্য ভেঙেচুরে গিয়েছে। গার্হস্থ হিংসা ২৫% বেড়ে গিয়েছে বলে সমীক্ষায় জানা গেছে।
দু’-আড়াই বছরের মতো স্বল্প সময়ের জন্যে হলেও কোভিড অতিমারি সমগ্র মানবজীবনে একটা প্রলয়। কোভিডকালেই মানুষের ভিতর যে সহযোগিতা সমানুভূতির মতো মানবিক বোধ জেগে উঠেছিল, অতিমারি শেষ হতেই সেই আবরণ সরে আবার নৃশংসতা জেগে উঠেছে। ক্ষতের ঘা সারার আগেই নেমে এসেছে দুর্বলের উপর অত্যাচার, যুদ্ধের কালো ছায়া। ক্ষেপণাস্ত্রের নিশানায় হতভাগ্য সাধারণ মানুষ। মানবিক হয়ে ওঠার এমন সুযোগ মানুষ আর পাবে কি?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy