একত্র: বিরোধী সমাবেশ ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল ডেভলপমেন্টাল অ্যান্ড ইনক্লুসিভ অ্যালায়েন্স (‘ইন্ডিয়া’), বেঙ্গালুরু, ১৮ জুলাই। ছবি: পিটিআই।
২০১৪-র লোকসভা নির্বাচনে নরেন্দ্র মোদীর জয়জয়কার। তার পর ২০১৯-এর লোকসভা নির্বাচনে আরও সংখ্যা বাড়িয়ে, তিনশোর বেশি আসন নিয়ে বিজেপির ক্ষমতায় ফেরা। এই দুইয়ের পর অনেক রাজনৈতিক বিশ্লেষকই ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন, জোট রাজনীতির যুগ আপাতত শেষ।
মাত্র চার বছর। এর মধ্যেই ফের প্রমাণ হয়ে গেল রাজনীতি অসীম সম্ভাবনাময়। যে নরেন্দ্র মোদীর উত্থান দেখে জোট রাজনীতির অবসানের ভবিষ্যদ্বাণী করা হয়েছিল, তিনিই এখন যাঁকে যেখানে পাওয়া যায়, তাঁদের ধরে নিয়ে এসে এনডিএ-র বৈঠক করছেন। গুনে দেখানো হচ্ছে, এই দেখুন, এনডিএ-তে এখন ৩৮টি দল। উল্টো দিকে রাহুল গান্ধী কিছু দিন আগেও ‘একলা চলো রে’ গান গেয়ে শুধুই কংগ্রেসের নিজস্ব শক্তি বাড়ানোর কথা বলতেন। তিনিই এখন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় থেকে অরবিন্দ কেজরীওয়ালদের সঙ্গে এক টেবিলে বসে পড়ছেন। তাঁদের মনোবাঞ্ছা নিয়ে মনে সংশয় থাকলেও রাহুল গান্ধী এখন বুঝতে পারছেন, এ ছাড়া উপায় নেই। বেঙ্গালুরুতে যখন কংগ্রেস ও ছোট-বড় আঞ্চলিক দল মিলিয়ে ২৬টি বিজেপি বিরোধী দলের সম্মেলন চলছে, তখনই নরেন্দ্র মোদী অমিত শাহ জে পি নড্ডাকে দিল্লিতে এনডিএ বৈঠকের আয়োজন করতে হয়েছে। ১৯৮৪-র লোকসভা নির্বাচনই হোক বা ২০১৪ ও ২০১৯-এর লোকসভা ভোট— দু’ক্ষেত্রেই দেখা যায়, জোট রাজনীতিকে তুড়ি মেরে বিশেষ কোনও রাজনৈতিক নেতার ব্যক্তিগত জনপ্রিয়তা ও তাঁকে ঘিরে আবেগ বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। ২০১৪-য় বিজেপি মোদী ম্যাজিকে ভর করে ২৮২টি আসন জিতেছিল। বিজেপি একাই ৩১ শতাংশের বেশি ভোট পেয়েছিল। ১৯৮৪ সালের পরে আর কোনও দল একার জোরে লোকসভায় সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়নি। ১৯৮৪-তে ইন্দিরা গান্ধীর মৃত্যুর পরে রাজীব গান্ধীর নেতৃত্বে কংগ্রেস একাই লোকসভায় ৪১৫টি আসন পেয়েছিল। কংগ্রেসের ঝুলিতে সে বার ৪৮ শতাংশের বেশি ভোট পড়েছিল। তার পিছনে ছিল ইন্দিরা-হত্যার পরে রাজীবকে ঘিরে মানুষের আবেগ। তখন বিজেপি ৭ শতাংশের মতো ভোট নিয়ে মাত্র দু’টি লোকসভা আসনে জিতে খাতা খুলেছে। সেই বিজেপি ২০১৯-এ একাই ৩০৩টি আসন জিতে এসেছে। ভোটের হার বেড়ে ৩৭ শতাংশের বেশি হয়েছে। নরেন্দ্র মোদীর ব্যক্তিগত ক্যারিসমা সেখানে প্রধান হয়ে উঠেছে। সেই কারণেই অনেকে জোট রাজনীতির বিদায় ঘণ্টা শুনতে পেয়েছিলেন। গত ন’বছর বিজেপি নিজেও এনডিএ-র কথা ভুলেই গিয়েছিল। শিবসেনা, অকালি দল, তেলুগু দেশম পার্টি, জেডিইউ-র মতো শরিকরা বিজেপির সঙ্গ ত্যাগ করলেও ‘গেল-গেল’ রব ওঠেনি। অতীতে জওহরলাল নেহরু, ইন্দিরা গান্ধীর সময়েও কংগ্রেস তাঁদের ব্যক্তিগত ক্যারিসমা-তে ভর করেই একার জোরে সরকার তৈরি করেছে। জোট শরিকদের প্রয়োজন পড়েনি।
একার জোরে কংগ্রেসকে ভোটে জেতানোর মতো ব্যক্তিগত জোর রাহুল গান্ধীর কোনও দিনই ছিল না। এখনও নেই। কিন্তু নরেন্দ্র মোদী নিজেই কি আর তাঁর ব্যক্তিগত জোরের উপরে ভরসা করতে পারছেন না? কর্নাটকে বিজেপির হারের পরেই আরএসএস মুখপত্রে বলা হয়েছিল, শুধু প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত জনপ্রিয়তায় ভর করে বৈতরণি পার হওয়া যাবে না। তার পরেই বিজেপি সভাপতি জে পি নড্ডা যে ভাবে এনডিএ-র নতুন-পুরনো শরিকদের সঙ্গে দৌত্য শুরু করলেন, তাতে মনে হচ্ছে, বিজেপি নিজেও ওই সতর্কবার্তা ফেলে দিতে পারছে না। নতুন করে জোট রাজনীতির প্রয়োজন মেনে নিচ্ছে।
এ দেশের রাজনীতিতে জোট তৈরি করে সরকার গঠনের প্রথম মাইলফলক ১৯৮৯-এর লোকসভা ভোট। বফর্স কেলেঙ্কারির জেরে রাজীব গান্ধীর ব্যক্তিগত জনপ্রিয়তা তখন তলানিতে। তা সত্ত্বেও সেই ভোটে কংগ্রেস একা ৩৯ শতাংশের বেশি ভোট পেয়েছিল। বিজেপি ২০১৯-এ যত ভোট পেয়েছে, তার থেকেও বেশি। কিন্তু বিশ্বনাথ প্রতাপ সিংহের নেতৃত্বে জোট সরকার তৈরি হয়েছিল। তার পর থেকে ২০০৯-এর লোকসভা নির্বাচন পর্যন্ত ৮টি জোট সরকার তৈরি হয়েছে। ১৯৮৯-এর পর থেকেই রাজনৈতিক দলের সংখ্যা বেড়েছে। জাতীয় দলের সংখ্যা মোটামুটি এক থাকলেও রাজ্যভিত্তিক দলের সংখ্যা লাফিয়ে লাফিয়ে বেড়েছে। জাতীয় দলগুলি, বিশেষত কংগ্রেসের ভোটের হার কমেছে। তার বদলে আঞ্চলিক দলগুলির ভোটের হার বেড়েছে। ১৯৯১-এ নরসিংহ রাওয়ের নেতৃত্বে কংগ্রেস জোট সরকার তৈরি করলেও সংখ্যালঘু সরকার চালাতে হয়েছিল। ১৯৯৬-এ বিজেপি প্রথম বার কেন্দ্রে জোট সরকার গঠন করে। ১৩ দিন সেই সরকার টিকেছিল। ১৯৯৮ ও ১৯৯৯, দুই লোকসভা ভোটের পরেই অটলবিহারী বাজপেয়ীর নেতৃত্বে এনডিএ সরকার তৈরি হয়। এই তিনটি নির্বাচনেই বিজেপি কংগ্রেসের থেকে সামান্য হলেও কম ভোট পেয়েছিল। যদিও লোকসভায় আসন বেশি পেয়েছিল। কারণ, বিজেপি তখনও পূর্ব ভারত এবং দক্ষিণ ভারতে পা ফেলতে পারেনি। বিজেপির অধিকাংশ আসনই এসেছিল মূলত উত্তর ভারত ও কিছুটা পশ্চিম ভারত থেকে।
এর পিছনেও সেই জোট রাজনীতির অঙ্ক। এ দেশের নির্বাচনী ব্যবস্থায় কোনও দল একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে সরকার গঠন করছে বা কোনও লোকসভা আসনে জিতছে মানেই এমন নয় যে, সেই দলই গোটা দেশে বা ওই লোকসভা কেন্দ্রে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ভোট পেয়েছে। কোনও প্রার্থী একটি লোকসভা কেন্দ্রে ১০০ জনের মধ্যে মাত্র ২৫ জনের ভোট পেয়েও সাংসদ হতে পারেন। যদি বাকি ৭৫ জনের ভোট অন্য প্রার্থীদের মধ্যে ভাগাভাগি হয়ে গিয়ে সবাই ২৫টি-র কম ভোট পান। জোটের লক্ষ্যই হল এই ভোট ভাগাভাগি হতে না দেওয়া এবং নিজের ঝুলিতে শরিকদের ভোট জড়ো করা। সে কারণেই এ বার বিরোধী জোট বিজেপির বিরুদ্ধে যত দূর সম্ভব ভোট বিভাজন রুখতে একের বিরুদ্ধে এক প্রার্থী দিতে চাইছে। বিজেপিও এনডিএ-র পুরনো শরিকদের ফের কাছে টেনে, ছোট দলকে জোটে নিয়ে এসে ঝুলিতে ভোট জড়ো করতে চাইছে।
১৯৯৮-এ অটলবিহারী বাজপেয়ী ও লালকৃষ্ণ আডবাণী যখন এনডিএ তৈরি করেছিলেন, সে সময় এনডিএ-তে বিজেপি-সহ ২৪টি দল ছিল। লালকৃষ্ণ আডবাণী বলতেন, কংগ্রেস, সমাজবাদী পার্টি, রাষ্ট্রীয় জনতা দল, বামদল ও মুসলিম লীগ ছাড়া বাকি যে কারও সঙ্গে বিজেপি জোট করতে পারে। এই দলগুলির সঙ্গে তা সম্ভব নয়। কারণ এরা প্রত্যেকেই বিজেপি-আরএসএস’কে সাম্প্রদায়িক ও দেশ-বিরোধী মনে করে। আডবাণী প্রয়োজনীয় জোট শরিকের তত্ত্বও খাড়া করেছিলেন। সেই তত্ত্ব অনুযায়ী শিবসেনা ও অকালি দল স্বাভাবিক নিয়মেই বিজেপির শরিক হয়ে ওঠে। কারণ দুই দলই বিশেষ একটি ধর্মের ভোটারদের কাছে ভোট চায়। ধর্মনিরপেক্ষ হওয়ার ভান করে না। বিজেপি এখন আবার শিবসেনার একটি গোষ্ঠী ও অকালি দলকে এনডিএ-র ছাতার তলায় টেনে আনছে।নির্বাচনের পরিসংখ্যান বলছে, ২০১৪ ও ২০১৯-এ বিজেপি একাই লোকসভায় ৩০ শতাংশের বেশি ভোট পেয়েছিল। ২০২৪-এর লোকসভা ভোটেও বিজেপি ৩০ শতাংশের বেশি ভোট পাবে এমন সম্ভাবনা যথেষ্ট। কিন্তু তা হলেই যে বিজেপির নেতৃত্বে কেন্দ্রে সরকার গঠন হবে, এমন কোনও নিশ্চয়তা নেই। ১৯৮৯-এর লোকসভা ভোটে কংগ্রেস একা ৩৯ শতাংশের বেশি ভোট পেয়েও সরকার গঠন করতে পারেনি। ১৯৯১-এ কংগ্রেস ৩৬ শতাংশের উপরে ভোট পেলেও একার জোরে সরকার গড়তে পারেনি। নরসিংহ রাওকে সরকার বাঁচাতে ছোটখাটো দলের উপরেই নির্ভর করতে হয়েছিল। নরেন্দ্র মোদীরা সেই ইতিহাস জানেন। যে ৩৮টি দলকে নিয়ে দিল্লিতে এনডিএ-র বৈঠক হয়েছে, এমন ন’টি দল রয়েছে, যাদের মাত্র এক জন সাংসদ। তিনটি দল রয়েছে, যাদের সাংসদ মাত্র দুই।
কংগ্রেস তা নিয়ে কটাক্ষ করছে। কিন্তু কংগ্রেসের ২৬টি দলের জোটেও এমন অনেক দল রয়েছে, যাদের এক জন বা দু’জন সাংসদ। তবেসরকার গঠনের বৈতরণি পার করে দিতে যে এই দলগুলিই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে। তাই ইতিহাসের চাকা ঘুরে গিয়ে ২০২৪-এর লোকসভা ভোটের ময়দানে নতুন করে জোট রাজনীতির প্রত্যাবর্তন।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy