Advertisement
০১ নভেম্বর ২০২৪
নির্বাচনী জোট তৈরির চাবিকাঠিই হল আসন ভাগাভাগি
Opposition Alliance

‘যত দূর’-এর যাত্রাপথ

বিরোধী শিবিরে কংগ্রেস সবচেয়ে বড় এবং প্রকৃত অর্থে জাতীয় দল, এতে কোনও দ্বিমতের জায়গা নেই।

Opposition party meet.

সঙ্গী: মুম্বইয়ে ইন্ডিয়া জোটের বৈঠকে উপস্থিত অন্য নেতাদের সঙ্গে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ও সনিয়া গান্ধী। ১ সেপ্টেম্বর ২০২৩। ছবি: পিটিআই।

দেবাশিস ভট্টাচার্য
শেষ আপডেট: ০৭ সেপ্টেম্বর ২০২৩ ০৪:৪৯
Share: Save:

রাজনীতি যেমন কৌশলের অঙ্ক, তেমনই সম্ভাবনার শিল্প। সেই সব শিল্পকর্ম এক বা দু’রঙা হতে পারে। একেবারে ধূসর হতে পারে। আবার বহুবর্ণে রঞ্জিতও হতে পারে। একই ভাবে অঙ্কে কেউ একশোয় একশো। কেউ ষাট-সত্তর বা টেনেটুনে পাশ। কারও হাতে পেনসিলটিই সম্বল! এই মুহূর্তে বিরোধী-জোটের দিকে তাকালে এমন অনেক কিছুর আঁচ মিলতে পারে।

এ কথা বলার কারণ হল, পটনার পরে বেঙ্গালুরুতে এসে বিরোধী দলগুলির মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্কের জায়গাটি যতটা মসৃণ বলে মনে হয়েছিল, মুম্বই বোধ হয় সেই ধারায় একটু ব্যতিক্রমী। অবশ্যই তার অর্থ এই নয় যে, জোট গড়ে বিজেপি-কে হারানোর উদ্যোগে দৃশ্যত কারও কোনও খামতি আছে। বরং তাড়াতাড়ি আসন ভাগাভাগি করে নেমে পড়ার কথাই শোনা গিয়েছে সেখানে।

কিন্তু এরই পাশাপাশি ‘যত দূর সম্ভব এক সঙ্গে লড়া’র সূত্রটি কিছুটা সংশয়ের উদ্রেক করে। সবাই এটাও বোঝেন, অন্য অনেক রাজ্যের ক্ষেত্রে যা-ই হোক, বিশেষত আমাদের এখানে ‘যত দূর সম্ভব’ কথাটির অর্থ ও তাৎপর্য সুদূরপ্রসারী এবং বহুমাত্রিক। বামশাসিত কেরলের বেলাতেও খানিকটা তা-ই। আর দুই রাজ্যেই বিষয়টি মূলত কংগ্রেস-কেন্দ্রিক।

বিরোধী শিবিরে কংগ্রেস সবচেয়ে বড় এবং প্রকৃত অর্থে জাতীয় দল, এতে কোনও দ্বিমতের জায়গা নেই। যদিও বৃহত্তর রাজনীতিতে প্রভাব ও কৌশলের অঙ্কে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, নীতীশ কুমার, শরদ পওয়ারের মতো নেতারাও যথেষ্ট ওজনদার। তাঁদের রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা অনেকের চেয়ে বেশি। তাই তাঁদের ঘিরে ‘সম্ভাবনার শিল্পচর্চা’ও চলে অবিরত।

কিন্তু এঁরা বা জোটের অধিকাংশ দলই আঞ্চলিক। ফলে শেষ লাফে বাজিমাত করার মতো কোনও পরিস্থিতি তৈরি হলেও এখনকার অবস্থায় দাঁড়িয়ে কংগ্রেসের কিছুটা সক্রিয়তা ছাড়া কারও পক্ষে সেই বাজি জেতা খুব অনায়াস না-ও হতে পারে। আরও একটি কথা হল, অন্য গুরুত্বপূর্ণ নেতাদের নিজ নিজ রাজ্যে কংগ্রেসের সঙ্গে সম্পর্ক ভাল। বাংলায় মমতার তা নয়। জোট-বৈঠকের তৃতীয় পর্বেও সেই জট বহাল। এবং শীতলতার বার্তা এখানে রাজ্য কংগ্রেসের দিক থেকেই যেন অধিক জোরালো।

তথাপি দেখা গেল, মুম্বইয়ে মমতাই কিছুটা অগ্রণী হয়ে অবিলম্বে আসন সমঝোতার আলোচনা শুরু করতে সকলকে আহ্বান জানালেন। খবর বলছে, তৃণমূল নেত্রী অন্য বিষয়ে ‘সময় নষ্ট’ না করে আগে আসন ভাগাভাগির কাজ শুরু করতে ব্যগ্র। এক দিক থেকে তিনি হয়তো ঠিক কথাই বলেছেন। কারণ ভোটের রাজনীতিতে জোট বা ঐক্য গড়ার অন্যতম চাবিকাঠিই তো এটি।

এখন বাংলায় সেই আলোচনা শুরু হবে কোথা থেকে, কিসের ভিত্তিতে এবং কত দূর যাবে? এটা অবশ্যই লাখ টাকার প্রশ্ন। কারণ রাজ্য কংগ্রেস মমতার সঙ্গে যাবে না, এটা এখনও তাদের ঘোষিত অবস্থান। আবার মমতাও বলে রেখেছেন, যেখানে যে দল শক্তিশালী সেখানে সেই দলকে সমর্থন জোগানোই তাঁর মতে জোট-নীতি হওয়া উচিত।

উভয়পক্ষ নিজেদের এই জায়গায় অনড় থাকলে কী দাঁড়াতে পারে? সহজ উত্তর, সে ক্ষেত্রে রাজ্যে লোকসভার বিয়াল্লিশটি আসনেই তৃণমূল এবং কংগ্রেস (সঙ্গে বামেরা) পরস্পরের বিরুদ্ধে লড়বে। বিজেপি তো আছেই। অতীতে এমন লড়াইতে শাসক তৃণমূল নিজেকে অপ্রতিরোধ্য প্রমাণ করেছে ঠিকই, কিন্তু পরিবর্তিত রাজনৈতিক আবহকে ভুললে চলবে না, যে-হেতু শুধু রাজ্য নয়, এ ক্ষেত্রে দেশের প্রেক্ষিতে তা বিচার্য।

লোকসভার আগেই পাঁচটি রাজ্যে বিধানসভার ভোট হওয়ার কথা। তাতে যদি বিজেপির বিরুদ্ধে কংগ্রেসের অগ্রগতি বোঝা যায়, তা হলে জাতীয় স্তরে যেমন তার প্রভাব পড়বে, তেমন রাজ্য রাজনীতিও সেই অভিঘাতের বাইরে থাকতে পারবে না। আর সেটা হলে তৃণমূলের পক্ষে খানিকটা চাপের হতে পারে বাংলায় বিজেপি-বিরোধী ভোটে কংগ্রেসের অংশীদারির ‘শঙ্কা’। তখন কংগ্রেস (বামেদের সঙ্গে জোট ধরে) রাজ্যে কত আসন পেতে পারে, তার চেয়েও কোন ভোটব্যাঙ্কে কতটা ভাগ বসাতে পারে, সেই হিসাবনিকাশ হয়ে উঠবে বেশি প্রাসঙ্গিক।

তবে যদি বিজেপি-কে হারানোর তাগিদে বাংলায় আসন-সমঝোতার কোনও সম্ভাবনা সামনে আসে, তখন? অনুমানে বলা যায়, ২০২১-এর বিধানসভা এবং ২০১৯-এর লোকসভার ফল ধরে আলোচনা শুরু হলে তা ফলপ্রসূ হওয়ার আশা কম। কারণ কংগ্রেস লোকসভায় মাত্র দু’টি আসন জিতেছিল। বিধানসভায় শূন্য। তথ্যের খাতিরে এটাও বলে রাখা দরকার, বামেরা কোনওটিতেই কিছু পায়নি। তাই রাজ্যে সমঝোতার কোনও উদ্যোগে মূলত তৃণমূলের ভূমিকাই হবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। অর্থাৎ, লাটাই থেকে কতটা সুতো ছাড়তে তারা প্রস্তুত।

এই সূত্রেই রাহুল গান্ধীর সঙ্গে অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের একান্ত বৈঠকের দিকে দৃষ্টি দেওয়া প্রয়োজন। দিল্লিতে কাকভোরে রাহুলের বাসভবনে তাঁর সঙ্গে বৈঠক করেছেন তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেক। এই প্রথম বার দু’জনের এমন মুখোমুখি বসা। আর সেটি হল বিরোধীদের মুম্বই বৈঠকের কয়েক ঘণ্টা আগে।

দিল্লির বৈঠক সাতসকালে হবে বলেই আগের দিন রাতে পৌঁছে গিয়েছিলেন অভিষেক। তা শুরু হয় সাড়ে ছ’টা নাগাদ। এর থেকে বোঝা যায়, বৈঠকটিকে তৃণমূল নেতা যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়েছিলেন। প্রস্তাব গিয়েছিল তাঁর দিক থেকেই। রাহুলেরও অবশ্যই তাতে সায় ছিল।

দু’টি দলের শীর্ষস্তরের দুই নেতা যখন একান্তে কথা বলেন এবং প্রকাশ্যে সে ব্যাপারে নীরবতা পালিত হয়, তখন বাস্তবতা এবং অনুমানই ভরসা! দু’জনের মধ্যে কী কথা হয়েছে, তা হলফ করে বলা সত্যিই শক্ত। ধরে নেওয়া যাক, প্রাতরাশের টেবিলে হয়তো ফ্ল্যাকসিড বান, দুধ, চা ইত্যাদি সহযোগে তাঁদের মধ্যে আলোচনা হয়েছে। এবং সেখানে অনিবার্য ভাবে উঠেছে তৃণমূলের সঙ্গে রাজ্য কংগ্রেসের ‘রসায়ন’ প্রসঙ্গ।

কী বলতে পারেন তৃণমূলের ‘দু’নম্বর’ নেতা? কী জবাব দিতে পারেন কংগ্রেসের শীর্ষজন? সে সব নিয়ে ভাবার আগে বলি, সম্প্রতি এখানে একটি সামাজিক আমন্ত্রণের পরিসরে কংগ্রেসের এক বর্ষীয়ান ও অভিজ্ঞতা-সমৃদ্ধ নেতার সঙ্গে কথা হচ্ছিল। নেতাটি এখনও রাজনীতিতে সক্রিয়। ‘হাই কম্যান্ড’-এর মতিগতি সম্পর্কেও একে বারে অজ্ঞ নন।

ভদ্রলোক বলছিলেন, “কংগ্রেসের সঙ্গে তৃণমূলের দূরত্ব তৈরি হওয়ার মূলে মর্যাদার প্রশ্ন। সেটুকু ভেবে এগোলে বাকি কিছুতে খুব আটকাবে বলে মনে হয় না।” তার মানে? তিনি বোঝালেন, “আসন রফায় বসতে হলে তৃণমূলকে আগে স্থির করতে হবে তারা কংগ্রেসকে কতটা সম্মানজনক জায়গা দিতে চায়। সেখানে আসনের সংখ্যা এবং বাছাই উভয়ই সমান গুরুত্বের। দু’টি জেতা আসন দিলাম, আর দু’-একটি খুব শক্ত আসন দিলাম— এ ভাবে ভাবলে বোধ হয় সবটা ঠিক হবে না।”

ফিরে যাই রাহুলের বাড়ির বৈঠকে। অনুমান করা যায়, প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরীর তীব্র তৃণমূল-বিরোধিতা নিয়ে রাহুলের দৃষ্টি আকর্ষণ করে থাকবেন অভিষেক। তিনি হয়তো বলেছেন, সিপিএমের হাতে ‘অত্যাচারিত’ কংগ্রেস এখন ওই দলের সঙ্গে জোট বেঁধে তৃণমূলের বিরোধিতা করতে থাকলে বিজেপি তার ‘সুযোগ’ নিতে চেষ্টা করবে। তাতে আখেরে বিরোধী-জোটের ক্ষতি। হয়তো তিনি খোলাখুলি এটা বলেননি যে, রাজ্যের সংখ্যালঘু ভোটব্যাঙ্কের অঙ্কটিও তৃণমূলের মাথায় আছে।

আর আসন ভাগাভাগি? ধারণা, প্রসঙ্গটি উঠে থাকলে আগে রাজ্য দলের মতামত নেওয়ার কথাই হয়তো ফের শুনিয়েছেন রাহুল। অনেকে আবার মনে করেন, বাংলায় যদি আসন-রফা হয়, তৃণমূলও তা হলে মেঘালয়ের মতো দু’-একটি রাজ্যে লড়ার জন্য কংগ্রেসের সমর্থন ‘প্রত্যাশা’ করতে পারে। সেটা দলের ‘সর্বভারতীয়’ তকমা ফেরানোর একটি উপায়ও বটে।

অন্য বিষয়গুলি:

Congress TMC
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE