Advertisement
২৩ নভেম্বর ২০২৪
Interim Budget 2024

গলদ যখন গোড়ায়

। শিশুর ছ’বছর বয়সের মধ্যেই মস্তিষ্কের ৯০ ভাগের বিকাশ ঘটে থাকে। তাই বিশ্বের উন্নত দেশগুলিতে প্রাক্‌-প্রাথমিক নিয়ে এত তোড়জোড়, নানা রকম গবেষণা, চিন্তাভাবনা।

An image of children

— প্রতিনিধিত্বমূলক ছবি।

আশিস কুমার রায়
শেষ আপডেট: ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ ০৮:২৪
Share: Save:

২০২৪ সালের অন্তর্বর্তী বাজেটের মাত্র ২.৩ শতাংশ শিশুদের জন্য বরাদ্দ করা হয়েছে। এই শিশুরাই নাকি ২০৪৭ সালের মধ্যে ‘বিকশিত ভারত’ তৈরি করবে। এই অমৃত কালে দাঁড়িয়ে যদি এক দশক পিছনে ফিরে তাকাই, দেখব যে ২০১৪-১৫ সালে শিশুদের জন্য বরাদ্দ ছিল সমগ্র বাজেটের ৪.৫২ শতাংশ। উন্নত ভারত তৈরির কাজে গোড়ায় গলদ থেকে যাচ্ছে।

এবং তা একেবারে আক্ষরিক অর্থেই। জাতীয় শিক্ষানীতিতে (২০২০) শিক্ষার যে চারটি স্তম্ভের কথা বলা হয়েছে, তার প্রথমটি হল ‘প্রবেশ’— সহজে যাতে শিক্ষার আঙিনায় শিশুদের আনা সম্ভব হয় তার ব্যবস্থা করা। এই নীতি প্রাক্-প্রাথমিক শিক্ষাকে গুরুত্ব দিয়েছে। শিশুর ছ’বছর বয়সের মধ্যেই মস্তিষ্কের ৯০ ভাগের বিকাশ ঘটে থাকে। তাই বিশ্বের উন্নত দেশগুলিতে প্রাক্‌-প্রাথমিক নিয়ে এত তোড়জোড়, নানা রকম গবেষণা, চিন্তাভাবনা। কোভিড-পূর্ব কালে এক গবেষণায় দেখা গিয়েছিল, ভারতে প্রায় ৩৫ শতাংশ শিশু প্রাক্‌-প্রাথমিক শিক্ষার আঙিনার বাইরে। বাকি ৬৫ শতাংশের অনেকেই জাতীয় সুসংহত শিশু বিকাশ প্রকল্পের সঙ্গে যুক্ত। যে ৩৫ শতাংশ শিশুকে আমরা এখনও প্রাক্-প্রাথমিক শিক্ষার সঙ্গে যুক্ত করতে পারিনি, তাদের আগামী দিনে প্রাথমিক শিক্ষার সঙ্গেও যুক্ত করা যাবে না, সে সম্ভাবনাই বেশি। বাকি ৬৫ শতাংশের প্রাক্-প্রাথমিক শিক্ষার মান কেমন, তার একটা ধারণা অনেকেরই আছে। পশ্চিমবঙ্গ সরকারের শিশু ও নারী কল্যাণ দফতরের উদ্যোগে কয়েক হাজার অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্রকে শিশুবান্ধব কেন্দ্রে উন্নীত করা হয়েছে। কিন্তু রাজ্য তথা দেশ জুড়ে লক্ষ লক্ষ কেন্দ্র রয়েছে, যেগুলিতে শিক্ষাদান দূরে থাক, যথেষ্ট নিরাপত্তাও নেই। পানীয় জল, শৌচাগার, রান্নার উপযুক্ত ব্যবস্থা বেশির ভাগ কেন্দ্রেই নেই। প্রাক্‌-প্রাথমিক শিক্ষাদানের উপযুক্ত প্রশিক্ষণের অভাবও রয়েছে কর্মীদের মধ্যে। পরিদর্শকরা প্রশাসনিক কাজেই ব্যস্ত, শিক্ষার মান নিয়ে মাথা ঘামানোর সময় তাঁদের নেই।

এই পরিস্থিতিতে প্রাক্-প্রাথমিক শিক্ষার পরিকাঠামো মজবুত করার দিশা মিলল না বাজেটে, বরং ইঙ্গিত মিলল যে, এমন নড়বড়ে ভাবেই তা চলবে। গত অর্থবর্ষে সুসংহত শিশু বিকাশ প্রকল্পের জন্য বরাদ্দ করা হয়েছিল ২০,৫৫৪ কোটি টাকা, এই অর্থবর্ষে (২০২৪-২৫) বরাদ্দ একটু বেড়ে হয়েছে ২১,২০০ কোটি টাকা। মূল্যস্ফীতির হিসাবে তা বাস্তবিক বৃদ্ধি কি না, সে প্রশ্ন নাহয় থাক। সুসংহত শিশু বিকাশ প্রকল্পের অধীনে ১৬.৬৩ লক্ষ অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্রের বর্তমানে প্রায় ৮ কোটি ৯০ লক্ষ শিশু পরিষেবা পেয়ে থাকে। কেন্দ্রীয় বরাদ্দের সব অর্থ ভাগ করে দিলে প্রতি কেন্দ্র হাজার চারেক টাকার কিছু বেশি হতে পারে। এটা কি যথেষ্ট? বাস্তবে অবশ্য বরাদ্দের সবটা কেন্দ্রে আসে না, সিংহভাগ খরচ হয় প্রশাসনে। আরও প্রশ্ন, এ বছর ১৪ লক্ষ অঙ্গনওয়াড়ি কর্মীকে যুক্ত করা হল আয়ুষ্মান ভারত প্রধানমন্ত্রী জনআরোগ্য যোজনায়। এই অর্থ কি অঙ্গনওয়াড়ি প্রকল্পের জন্য বরাদ্দ টাকা থেকেই নেওয়া হবে? তা হলে প্রাক্-প্রাথমিক শিক্ষার জন্য বাকি আর থাকবে কতটুকু?

প্রাক্-প্রাথমিক শিক্ষাকে সবার কাছে পৌঁছতে হলে বিভিন্ন বিভাগের সমন্বয় প্রয়োজন। নতুন শিক্ষানীতি অনুযায়ী প্রাক্-প্রাথমিক স্তরকেও বর্তমানে স্কুলের সঙ্গে যুক্ত করতে বলা হয়েছে। তার জন্য শিক্ষক-শিক্ষিকাদের প্রশিক্ষণ, স্কুলে উপযুক্ত পরিকাঠামো তৈরি করা দরকার। সামগ্রিক ভাবে শিক্ষাখাতে যেটুকু বরাদ্দ বেড়েছে (০.১২ শতাংশ), তাতে স্কুলের পরিকাঠামোর প্রসার সম্ভব বলে মনে হয় না।

প্রাক্-প্রাথমিক স্তরে শিশুদের ‘শিক্ষার জন্য তৈরি’ করে নিতে পারলে আগামী দিনে তাদের বিদ্যালয়ে ধরে রাখা সহজ হবে। শিশুদের সামাজিক ও মানসিক শিক্ষা গ্রহণের প্রথম স্তর হিসাবে প্রাক্-প্রাথমিকের গুরুত্ব সর্বাধিক। শিশুমনের সার্বিক বিকাশের জন্য সমবয়সিদের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন, সামাজিক মেলামেশা ও আত্মবিশ্বাস তৈরি অত্যন্ত প্রয়োজন। তাই এই স্তরের শিক্ষার গুরুত্ব অপরিসীম।

ইউনিসেফ-এর শিশুশিক্ষা বিষয়ক আন্তর্জাতিক রিপোর্ট (২০১৯) দাবি করেছিল যে, দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলির প্রায় সাড়ে তিন কোটি শিশু বয়সের উপযুক্ত প্রাক্-প্রাথমিক শিক্ষায় অংশ নিচ্ছে না। প্রাক্-প্রাথমিক ও শিক্ষায় সরকারি বিনিয়োগের অভাবই এর জন্য দায়ী, বলেছিল রিপোর্ট। বিভিন্ন রিপোর্ট, গবেষণা ও প্রকল্পগুলির মাধ্যমে যে বাস্তব সামনে আসছে, তা সত্যিই উদ্বেগজনক। তা সত্ত্বেও প্রাক্-প্রাথমিক স্তরের জন্য যথেষ্ট বরাদ্দ করে বাস্তবমুখী পরিকল্পনা গ্রহণ করা হচ্ছে না।

প্রাক্-প্রাথমিক স্তরের শিক্ষার জন্য বরাদ্দকে আগামী দিনের বিনিয়োগ হিসাবে দেখা উচিত। এ ছাড়াও বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুদের কথা, বিভিন্ন সামাজিক কারণে, দীর্ঘ দিনের প্রচলিত রীতিনীতির দ্বারা প্রভাবিত সমাজের মূলস্রোত থেকে দূরে সরে থাকা বিভিন্ন গোষ্ঠীর ছেলে-মেয়েদের জন্যও প্রাক্-প্রাথমিক শিক্ষাকে উন্মুক্ত করতে হবে। তার দিশা দেখাতেও অক্ষম এই অন্তর্বর্তী বাজেট। এখানে উল্লেখ করা দরকার যে, সংখ্যালঘু দফতরের বরাদ্দ ১৪ শতাংশ কমানোর কথা বাজেটে বলা হয়েছে। এ ছাড়াও প্রাক্-প্রাথমিক স্তরকে মিড-ডে মিলের আওতায় আনা উচিত ছিল, কিন্তু তা করা হয়নি। গত দু’বছরে মিড-ডে মিলে বরাদ্দ বাড়েনি। ‘মিশন বাৎসল্য’-এর জন্য বরাদ্দ একই রেখে, একলব্য মডেল রেসিডেন্সিয়াল বিদ্যালয় প্রকল্পে বরাদ্দ বাড়ানো হয়েছে। এই এলোমেলো নকশা থেকে উন্নয়নের যাত্রাপথ আন্দাজ করা বড়ই কঠিন।

অন্য বিষয়গুলি:

Children Money Allocation West Bengal government
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy