রাত পৌনে এগারোটায় এক রেস্তরাঁর চাতালে বসে আছেন দেবাশিস দাশ। বার বার তাকাচ্ছেন মোবাইলের দিকে, খাবারের অর্ডার ঢুকবে। খাবার তৈরি হবে, সেই খাবার সময়ের মধ্যে পৌঁছাতে হবে কোনও ফ্ল্যাটবাড়ি চার বা চল্লিশতলায়— চোদ্দো নম্বর অর্ডারটা হয়ে গেলেই ‘ইনসেন্টিভ’ মিলবে। কিন্তু ফুড ডেলিভারি কোম্পানির ‘অ্যালগরিদম’-এর জ্বালায় তেরো নম্বরেই আটকে আছেন এক ঘণ্টা ধরে। ‘সংখ্যাটা বড় অপয়া, বুঝলেন’— বিষণ্ণ হেসে জানালেন। তেরোটা অর্ডারে এই ‘ফুড পার্টনার’দের বরাদ্দ পাঁচশো টাকা, চোদ্দো হলেই সাতশো।
সুভাষগ্রাম থেকে সাইকেলে রোজ আসেন বাইপাসের ধারে অজয়নগরে। যাওয়া-আসা, আর চোদ্দোটা খাবার ডেলিভারি মিলিয়ে সারা দিনে একশো কিলোমিটার সাইকেলের প্যাডেল ঠেলেন তিনি। দূরত্বের উপর নির্ভর করে ডেলিভারি-প্রতি পঁচিশ থেকে চল্লিশ টাকা মেলে। সাইকেলে ডেলিভারি করলে বাইকে ডেলিভারির চাইতে ট্রিপ প্রতি একটু কম রেট মেলে। তবু সাইকেল ব্যবহারের প্রবণতা বাড়ছে, তেলের দাম বাইকধারীদের গলায় কাঁটার মতো বেঁধে। তেলের খরচ কোম্পানি দেয় না।
দেবাশিসবাবুর বাড়ির লোকেরা এখনও বুঝতে পারেননি, রেস্তরাঁ থেকে খাবার পৌঁছে দেওয়া কেমন চাকরি? দেবাশিসবাবুও বোঝাতে পারেননি যে, ডিজিটাল প্রযুক্তি, লগ্নিপুঁজি ও নয়া উপভোক্তা-সংস্কৃতি মিলে কী করে নতুন নতুন পরিষেবা তৈরি হচ্ছে। ফ্ল্যাটবাড়ির মানুষ আর বাজারে গিয়ে আনাজ কিনবেন না, রেস্তরাঁয় গিয়ে খাবেন না, সেলুনে গিয়ে চুল কাটাবেন না, ওষুধের দোকানে যাবেন না, ট্যাক্সি ধরতে স্ট্যান্ডে যাবেন না। মোবাইলের স্ক্রিন বেয়ে বাজারই তাঁদের দরজায় বেল বাজাচ্ছে। নয়া পরিষেবা সংস্কৃতি এক নতুন শ্রম সংস্কৃতিরও জন্ম দিচ্ছে, যেখানে কাজ অস্থায়ী, তাৎক্ষণিক, এবং পারিশ্রমিক পাওয়ার শর্ত শ্রমিকের কাছে অস্বচ্ছ।
খাবার ডেলিভারি বা অ্যাপ ক্যাব পরিষেবায় বছর তিন-চার আগে ছিল স্বর্ণযুগ— যখন ইচ্ছে কাজ করার সুযোগ, ট্রিপ-প্রতি উঁচু রেট, বাড়তি উৎসাহ ভাতা মিলত। মাসে কুড়ি-পঁচিশ হাজার টাকাও ঢুকেছে অনেকের ই-ওয়ালেটে। শহর ও শহরতলির যুবকরা ঝাঁকে ঝাঁকে যোগ দিয়েছিলেন। অনেকে অন্য পেশা ছেড়ে এসেছেন। ভারতের এক প্রধান খাবার ডেলিভারি সংস্থার শীর্ষকর্তা ২০১৯ সালে গর্বের সঙ্গে জানান, ভারতীয় সেনা ও রেলের পরে সর্ববৃহৎ কর্মী-সংস্থা হবে তাঁর কোম্পানি। অনলাইন খাবার সংস্থা ও অ্যাপ ক্যাব বেকারত্বের মোকাবিলা করতে পারে, এ কথা সরকারকে চিঠি লিখে জানিয়েছিলেন বাণিজ্যিক সংগঠন ‘ফিকি’-র তৎকালীন প্রেসিডেন্ট সন্দীপ সোমানি।
কিন্তু শ্রমিক যত বেড়েছে, তত ব্যক্তি-প্রতি অর্ডার কমেছে। স্বাধীন পেশায় তাৎক্ষণিক উপার্জনের খোয়াব ফিকে হয়ে যায় অর্ডার ঢোকার তিতিবিরক্ত অপেক্ষায়। দুনিয়া জুড়ে ‘গিগ ইকনমি’-র চিত্রটি একই রকম— কর্মীরা ক্রমাগত লড়ে যাচ্ছেন কাজের অনিশ্চয়তা, মজুরির ওঠা-নামা, খামখেয়ালি ‘ইনসেন্টিভ’ নীতির সঙ্গে। অধিকাংশ ডেলিভারি কোম্পানি প্রতি বছর বিপুল লোকসান দেখায়, অথচ বছরের পর বছর নতুন পুঁজি আসতেই থাকে।
এ দিকে রোজগার কমছে উমেশ মাহাতোদের। উমেশের মতে, এখন অর্ডার ঢোকা, ‘ইনসেন্টিভ’ পাওয়া, দূরত্বের উপর নির্ভর করে ট্রিপ-প্রতি রেট, সবটাই ভূতুড়ে হিসেব— কী ভাবে সেগুলো ঠিক হয় উমেশরা জানেন না, বোঝেনও না। উমেশ এই বছর উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করেছেন, বাইক থাকার সুবাদে গত বছর থেকে পার্ট-টাইম ডেলিভারি করতেন বিকেল ছ’টা থেকে সাড়ে দশটা— গড়ে ছ’টা-সাতটা অর্ডার ঢুকলে তিনশো টাকা, তেলের দাম বাদ দিলে হাত খরচটুকুই উঠত। এখন কলেজে ভর্তির প্রস্তুতির পাশাপাশি ফুলটাইম কাজ করছেন ডেলিভারির, দৈনিক ছ’শো টাকার অর্ডারের কোটা পূর্ণ হলে তিনশো টাকার ইনসেন্টিভ পাওয়া যাবে, কিন্তু তাতে দিনে সতেরো-আঠারোটা অর্ডার চাই। উমেশ এক দিনও ইনসেন্টিভ পাননি গত কয়েক সপ্তাহে।
রেস্তরাঁর ভিতরে যখন সুখাদ্য রান্না হয়, তখন বাইরে চলে বিড়ি আর চায়ের রোজনামচা। ফুলটাইম কর্মীরা বাড়ি থেকে টিফিন নিয়ে আসেন, রুটি-তরকারি। শহরের ভাতের হোটেলগুলো খোলেনি। কমবয়সিরা এগ রোল খান, চিকেন রোল পঞ্চাশ টাকা ছাড়িয়েছে সর্বত্র। ব্যাগে যে মূল্যের খাবার বইছেন প্রতি বার, সেটা তাঁদের দৈনিক আয়ের চেয়ে বেশি। ব্যাগগুলিও কিনতে হয় কোম্পানির থেকে, দাম সাতশো টাকা। একটা বিদেশি কোম্পানির আইসক্রিম ডেলিভারির অর্ডার এল উমেশের, দুটো স্কুপ সাড়ে তিনশো টাকা, উমেশের দশটা ট্রিপের আয়। পিঠের ব্যাগ থেকে উঠে আসা সুগন্ধ মাথায় ধাক্কা মারলে নির্বিকার হয়ে থাকাটাই এদের শিক্ষা।
ইরানের পরিচালক জাফর পানাহির ক্রিমসন গোল্ড ছবিতে যুদ্ধফেরত নায়ক পিৎজ়া ডেলিভারি করেন। তাঁর চোখ দিয়ে দর্শক দেখেন সমাজের উঁচু মহল্লার ক্রেতাদের জীবনযাপন, সংস্কৃতি, প্রাধিকার। শহরে এখন দু’টি জগৎ, একটা হাউসিং কমপ্লেক্স ও রিয়াল এস্টেটের নিরাপত্তার ঘেরাটোপে, অন্যটি নিম্ন আয়ের মানুষের টিকে থাকার ভয়াবহ সংগ্রামে। ডেলিভারি কর্মীরা এই দুই জগতের মধ্যে নিয়ত যাতায়াত করছেন।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy